বাংলায় একই দিনে বর্ষবরণ উদ্‌যাপন এবং প্রসঙ্গ কথা by ড. পণ্ডিত দেবাচার্য

দুই গত ১৪ এপ্রিল কালের কণ্ঠ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম। লিখেছেন আজিজুল পারভেজ। প্রতিবেদনটি 'দুই বাংলায় একই দিনে বর্ষবরণে বাধা কোথায়'। প্রতিবেদনটির যথেষ্ট গুরুত্ব ও আকর্ষণ আছে বাঙালি জাতির কাছে। এখানে মানসিক দুর্বলতা, ভুলভ্রান্তি দূর করতে না পারলে সব বাঙালি জাতির মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিষবৃক্ষ ক্রমে বিস্তার লাভ করবে এবং তা ভবিষ্যতে বাঙালির জন্য সুখকর হবে না।


পৃথিবীতে বর্তমানে ৩০ কোটি বাঙালি রয়েছে এবং এ জাতির নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব অক্ষর ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আছে এবং ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস বিশ্বস্বীকৃত। সুতরাং বর্ষবরণের মতো মহান ঐতিহ্য এবং উৎসব, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামসহ মহান বাঙালিদের জন্ম-মৃত্যুর অনুষ্ঠান একই দিনে সর্বত্র পালন করা উচিত। আজিজুল পারভেজের লেখায় বাংলা সন, তারিখ ও মাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু বিতর্কিত বিষয়ের অন্তর্নিহিত তথ্যের অভাব লক্ষণীয়। বাংলা সন বা সাল সম্পর্কে দুটি মত লক্ষণীয়_একটি রাজা শশাঙ্ক, অন্যটি সম্রাট আকবর, কার রাজত্বকাল থেকে বঙ্গাব্দ প্রচলিত হয়েছে। এই দুজনের মধ্যে বিচার-বিশ্লেষণ করলে সম্রাট আকবরের কথাই প্রাধান্য পায়।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেক হয়। তখন ভারতবর্ষে হিজরি তারিখ প্রচলিত ছিল। হিজরি তারিখ চন্দ্রকেন্দ্রিক অর্থাৎ চন্দ্র উদয় থেকে পরের দিন চন্দ্র উদয় পর্যন্ত এক দিন। সম্রাট আকবর তাঁর পণ্ডিতমণ্ডলীর সহযোগিতায় চন্দ্রের পরিবর্তন করে হিজরি সনকে সৌরকেন্দ্রিক বঙ্গাব্দে রূপান্তর করেন। অনেকের মনে হতে পারে, বর্তমানে হিজরি ১৪৩২ এবং বাংলা ১৪১৮ সন কেন? কেন এই পার্থক্য? এখানে লক্ষণীয়, হিজরি চন্দ্র বর্ষ, অর্থাৎ হিজরি বর্ষে ৩৫৪-৩৫৫ দিনে এক বছর এবং বাংলা সূর্যকেন্দ্রিক সৌর বছর ৩৬৫ দিন ছয় ঘণ্টায় এক বছর। এ কারণে বাংলা এবং হিজরি বছরে বর্তমানে পার্থক্য লক্ষণীয়। মনগড়া বা অবৈজ্ঞানিকভাবে বঙ্গাব্দের সৃষ্টি হয়নি। আমাদের বঙ্গাব্দ অত্যন্ত সমৃদ্ধ, তবে তার অন্তর্নিহিত গাণিতিক বিষয় না জানা আমাদের দুর্বলতা, আমাদের বঙ্গাব্দের দরিদ্রতা নয়। নানা বিভ্রান্তি এবং কিছু ব্যক্তির কিছু করে দেখানোর মানসিকতার কারণে বঙ্গাব্দকে নিয়ে টানাহেঁচড়া হয়েছে। আমাদের ক্যালেন্ডার তাদের অনুকরণ করতে হবে। ভারতের বিজ্ঞানী ড. মেঘনাথ সাহা জ্যোতি পদার্থবিদ্যার প্রভাবে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের নিয়মানুযায়ী বঙ্গাব্দের সংস্কার প্রস্তাব করেন। ভারতের পণ্ডিত ব্যক্তিদের বিচার-বিশ্লেষণে ড. সাহার মতে, গ্রেগরীয় পদ্ধতি অবলম্বন করলে বঙ্গাব্দের শাস্ত্রীয় নিজস্ব এবং বাঙালি ঘরানা বিঘি্নত হয়। সে কারণে ভারত সরকার তা গ্রহণ করেনি। ভারত যখন ড. মেঘনাথ সাহার সুপারিশ গ্রহণ করেনি, তখনই বোঝা উচিত, এ নিয়ম ত্রুটিমুক্ত নয়। বাংলা ক্যালেন্ডারকে সংস্কার করতে গিয়ে মূল জায়গায় আঘাত করা হয় এবং এটি বাঙালির মধ্যে বিভেদ তৈরির চক্রান্ত। এখানে প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে, খ্রিস্টানদের নিয়ম রাত ১২টা থেকে পরের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত এক দিন। বঙ্গাব্দে সূর্য উদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এক দিন। এই মতাদর্শের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষণীয়। এর মধ্যে সূক্ষ্ম বিচারে আমাদের বঙ্গাব্দ ঘড়ির কাঁটাকেন্দ্রিক নয়, প্রাকৃতিক নিয়মে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। পৃথিবীর যেখানে যখন সূর্য উদিত হয়, তখন সেখানে দিনের পরিবর্তন। এই প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে অন্য কোনো নিয়ম গ্রহণ করা সমীচীন হবে কি না তা গভীর বিবেচনার বিষয়। বঙ্গাব্দের নিয়ম-শৃঙ্খলা ও গাণিতিক বিষয়, যে বিষয় হলো সূর্যকেন্দ্রিক, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে দিনপঞ্জিকা তৈরি হয়েছে। এখানে কোনো ধর্মের কারণে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান করা হয়নি। বাংলা বর্ষ ক্যালেন্ডারের, বিশেষ গাণিতিক বিষয় হলো পৃথিবীর বার্ষিক গতি এবং আহ্নিক গতির ওপর প্রভাবিত, অর্থাৎ পৃথিবী ৩৬০ ডিগ্রি কিভাবে সৌর বছরে অতিক্রম করে, সেই গাণিতিক হিসেবে সৃষ্ট, এখানে কোনো ব্যক্তি, জাতি বা ধর্মকে অনুসরণ করা হয়নি, এখানে সৌরমণ্ডলীর সৃষ্টির সত্যকে স্বীকার করা হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবী বার্ষিক গতিতে যেদিন ৩৬০ ডিগ্রি অতিক্রম করে ০ ডিগ্রিতে অবস্থান করে, সেদিন হবে চৈত্রসংক্রান্তি বা বছরের শেষ দিন। ০ ডিগ্রি থেকে যখন এক ডিগ্রিতে অবস্থান করবে, সেদিন পহেলা বৈশাখ। এখানে কোনো ধর্ম, দেশ বা স্বার্থকে অবলম্বন করা হয়নি। বিজ্ঞজন অনুধাবন করুন, বঙ্গাব্দ কতটা বৈজ্ঞানিক এবং আমরা যে সৌরজগতে অবস্থান করি, সেই সৌর বছরকেই বঙ্গাব্দ বলা হয়। এ হিসাবে অবৈজ্ঞানিক মতবাদ কোথায়? এই সূত্রমতে ১৩, ১৪, ১৫ এপ্রিল যেকোনো দিন পহেলা বৈশাখ হতে পারে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকেই পাকিস্তান সরকার বাঙালি জাতি সম্পর্কে সচেতন নয় এবং বিভিন্ন কলাকৌশলে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিঘি্নত করার জন্য হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির নানা কৌশল অবলম্বন করে। তারই একটি হলো ১৯৬৩ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, বাংলা একাডেমীর মাধ্যমে বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কারের বাহানা। তাদের সেই দিনের বপন করা বিষবৃক্ষের বীজে ১৯৯৫ সালে অঙ্কুর গজিয়েছে। যেকোনো জাতীয় সংস্কৃতি, নিজস্ব ঘরানা, প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের কারণে যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়ায়। তা কোনো সরকারি আইন দিয়ে বেঁধে দেওয়া যায় না। কোনো রাষ্ট্রীয় আইন দিয়ে পৃথিবীর আহ্নিক গতি এবং বার্ষিক গতিতে পরিবর্তন আনা কি সম্ভব? এ সত্য বাঙালি জাতি বিশ্বের দরবারে প্রমাণ করে দিয়েছে অতীতে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত ১৪-০৪-২০১১ মন্তব্য সম্পর্কে। আপনার পরিচয় অত্যন্ত সমৃদ্ধ, তাই আপনার কোনো মন্তব্য গুরুত্ব বহন করে। আপনার এই দায়িত্ববোধ থেকে ভুল সিদ্ধান্ত হলে সব বাঙালি তার জীবনদর্শনে প্রভাবিত হবে। কারণ আপনি নয়, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষাপটেও আপনার মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পরিলক্ষিত, বঙ্গাব্দের দিনপঞ্জিকা ভারত বা বাংলাদেশ একই সৌরকেন্দ্রিক বার্ষিক গণনা এবং সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক।
বাংলা দিনপঞ্জিকায় গ্রহ-নক্ষত্রের যে বিচার-বিশ্লেষণ এবং অমাবস্যা, পূর্ণিমা, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, এর যে তারিখ ও সময় বলা হয়েছে_তা-ই সৌরমণ্ডলীর গাণিতিক ফলাফল। এখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, এমনকি কোনো রাজনৈতিককেন্দ্রিক বা ধর্মকেন্দ্রিক হিসেবে নয়, সৌরমণ্ডলীর নিয়মতান্ত্রিক হিসেবে গণনা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কেউ কেউ মনে করেন, আমাদের দিনপঞ্জিকা অবৈজ্ঞানিক। দয়া করে আমাদের সৌরমণ্ডলীর সঠিক তথ্য প্রকাশ করে বাঙালির জ্ঞানতৃষায় একটু অমৃত দান করবেন।
ঘড়ির কাঁটায় ঈদ বেঁধে দিলে চাঁদ দেখার আনন্দ, উচ্ছ্বাস বিলোপ পেত। ঈদের চাঁদ মানুষের কাছে কী এক উপভোগ্য বিষয়। এর ব্যাখ্যা নতুন করে দেওয়ার দরকার নেই। এটিই বিধাতার বিধান। এটিই বিশ্ব প্রকৃতির নিয়মের উপভোগ্য সময়, চাঁদ দেখাই হিজরি সনের রমজান এবং পবিত্র ঈদ পালনের মূল ঘরানা। এ নিয়ম বিঘি্নত হলে চন্দ্রকেন্দ্রিক হিজরি বর্ষ গণনার মূল স্তম্ভ বিঘি্নত হয়। আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে কোথায়, কোন অক্ষাংশে চাঁদ উঠবে বলে দেওয়া যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষ চাঁদ কখন দেখবে, তা বলা যায় না। এ বিষয় বিধাতা ও বিজ্ঞানের। বিজ্ঞান বিধাতারই দান। এ বিতর্কে আমরা বিধাতার কাছে অত্যন্ত অসহায়। সেই বিধাতার নিয়মতান্ত্রিক বিধানের ওপর নির্ভর করে বঙ্গাব্দ। আমাদের বর্ষ ক্যালেন্ডার, গ্রহ, নক্ষত্র বিচার-বিশ্লেষণে যেকোনো ক্যালেন্ডার থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে পৃথক। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, এখনই সময় বাংলা নববর্ষের সঠিক দিন নির্ধারণের।
লেখক : গবেষক

No comments

Powered by Blogger.