চারদিক-পাখির খোঁজে বাংলার চরে by গাজী মুনছুর আজিজ

চারপাশেই নদী। মাঝখানে জেগে ওঠা বিশাল চর। নির্জন এই চরে মানুষের বসতি নেই। তবে বসতি করছে নানা প্রজাতির বর্ণিল রঙের ছোট-বড় হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। আর এ পাখি দেখার জন্যই প্রতিবছর শীতকালে একদল পাখিপ্রেমিক ছুটে যান উপকূলের চরগুলোতে।


কেবল পাখি দেখার জন্যই নয়, তাঁরা তুলে আনেন এসব পাখির সংখ্যা, পাখির জাত-প্রজাতি। আর ক্যামেরায় বন্দী করেন এসব পাখির আলোকচিত্র, ভিডিও এবং কণ্ঠ। তারপর মানুষকে জানিয়ে দেন পরিবেশ ও প্রকৃতির অনন্য বন্ধু এই পাখির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। আর এর মাধ্যমে তাঁরা খুঁজে পান অন্যরকম আনন্দ।
পাখি দেখার এমন আনন্দ পেতেই ৭ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা সদরঘাট থেকে একদল পাখিপ্রেমীর সঙ্গে লঞ্চযোগে রওনা দিই উপকূল জেলা ভোলায়। উদ্দেশ্য উপকূলীয় জলচর পাখিশুমারি। ১০ জনের এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও পাখি নিয়ে গবেষণাকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েটল্যান্ডস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের জাতীয় সমন্বয়কারী ইনাম আল হক। তাঁর নেতৃত্বেই প্রতিবছর বাংলাদেশে জলচর পাখিশুমারি হয়ে থাকে।
৮ জানুয়ারি সকালে আমরা ভোলার ঘোষেরহাট লঞ্চঘাটে পৌঁছাই। লঞ্চ থেকে নেমে ভাড়া করা ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় রওনা হই চরফ্যাশনের শাহজালালচরের দিকে। নৌকায় বসার পর চলে আসে গরম গরম খিচুড়ি, নাশতা হিসেবে তোফা! নৌকায় এই খিচুড়ি রান্না করেন শুমারির সহযোগী টুটুল।
মেঘনা নদী দিয়ে নৌকা এগিয়ে চলে। মাঝেমধ্যেই দেখা যায়, ছোট পানচিল নদী থেকে মাছ তুলে নিচ্ছে। অথবা চোখে পড়ে জেগে ওঠা ছোট ছোট চর। আর সে চরে বসে আছে নানা রঙের নানা প্রজাতির পাখি। আমাদের পাখিপ্রেমীরা দুরবিন দিয়ে এসব পাখি দেখেন, ছবি তুলেন এবং খাতায় লেখেন এর সংখ্যা। দুপুরের খাবারও হয় নৌকায়।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর নৌকা আসে শাহজালালচরে। এই চরের এক পাশে বিশাল কেওড়া বন আর অন্য পাশে মেঘনা নদী। চরে নেমে বনের পাশেই শুকনো বালুতে আমরা রাতে থাকার জন্য ছোট-বড় চারটি তাঁবু তৈরি করি। তাঁবু তৈরি করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে। সূর্য ডুব দেয় মেঘনায়। সন্ধ্যায় নদীর তীরে সবাই বসার পর চা খেতে খেতে পাখির গল্প শোনান ইনাম আল হক। কিছুক্ষণ পর নদীর তীরে বসেই রাতের খাবার খাই।
রাতে নিশিবকের ডাক শুনতে শুনতে ঘুমাই আর সকালে ঘুম ভাঙে বনের পাখির কিচিরমিচিরে। চরে ঘুমানোর এই প্রথম অভিজ্ঞতা। মনে হলো অন্যরকম ভালো লাগার কথা। প্রায় ১৫ বছর আগে এই চরটি জেগে ওঠে। তখন সরকারিভাবে একে বনায়ন করা হয়।
সকাল সাতটার আগেই সবাই ঘুম থেকে উঠি। তৈরি হই পাখি দেখতে। নৌকায় রান্না করা গরম খিচুড়ি খেয়ে রওনা দিই পাখির খোঁজে। আমাদের কারও হাতে ক্যামেরা, কারও হাতে দুরবিন বা টেলিস্কোপ। আবার কারও হাতে শুমারির কাগজ, কেউ বা করছেন ভিডিও। বিশাল এই চরে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে কিংবা কখনো ছোট নৌকায় করে দূরের ছোট্ট চরে গিয়ে অমরা দেখেছি ৪১ প্রজাতির প্রায় ১৪ হাজার পরিযায়ী পাখি।
এসব পাখির মধ্যে আছে দেশি কানিবক, গো বগা, মাঝলা বগা, ধুপনি বক, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি চকাচকি, ইউরেশিও সিঁথিহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, উত্তুরে লেঞ্জাহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, পাকড়া উল্টোঠুটি, ছোট নথজিরিয়া, কালালেজ জৌরালি, নাটা গুলিন্দা, ইউরেশিও গুলিন্দা, ছোট পানচিল, ছোট পানকৌড়ি, ছোট বগা, বড় বগা, পিয়ং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, মেটে জিরিয়া, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, পাতি বাটান, টেরেক বাটান, জুলফি পানচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কাসপিয়ান পানচিলসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
দলনেতা ইনাম আল হক টেলিস্কোপে এসব পাখি সবাইকে দেখান আর সেই সঙ্গে পাখির নাম, প্রজাতি, আবাসন, খাদ্যসহ বিভিন্ন বর্ণনা দেন। সত্যিই নতুন নতুন পাখি দেখে, তার নাম শুনে খুঁজে পাই অন্যরকম আনন্দ।
একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে পাখি দেখার কাজ। তারপর সন্ধ্যায় ফিরি তাঁবুতে। সারা দিন চরে রোদের মধ্যে কখনো বালুতে, কখনো কাঁদা মাটিতে কিংবা কখনো শক্ত ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে আমরা সবাই কিছুটা ক্লান্ত ছিলাম। তার পরও সবার মুখে ছিল নতুন পাখি চেনার নতুন আনন্দ।
পরদিন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে তাঁবু গুছিয়ে আমরা রওনা হই ঘোষেরহাট লঞ্চঘাটের উদ্দেশে। পথে আমরা পাখি দেখি ঢালচর, কলমীরচর ও এর আশপাশের ছোট ছোট চরগুলোতে। পৌঁছাই বেলা তিনটায়। তারপর উঠি লঞ্চে। লঞ্চ ছাড়ে। পরদিন ভোরে আসি ঢাকায়।
ইনাম আল হক জানান, স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেই তাঁরা প্রায় ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জলাশয়, হাওর, বাঁওড় ও উপকূলীয় এলাকায় পাখিশুমারি করে আসছেন। আর এই শুমারির ফলাফল ওয়েটল্যান্ডস ইন্টারন্যাশনাল আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রকাশানায় তুলে ধরে।
জলচর এই পাখিশুমারির কাজ চলবে জানুয়ারি মাসজুড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে।

No comments

Powered by Blogger.