বাংলাদেশ-ভারত বিশেষজ্ঞ মতামত বাণিজ্য-উপ-আঞ্চলিক সম্পর্ককে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা জরুরি by মোস্তাফিজুর রহমান

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও আমরা দেখেছি যে এই দুই দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় একটি সম্পর্ক আছে। কিন্তু তবুও বাংলাদেশ-ভারত এবং উপ-আঞ্চলিক সম্পর্কটা আরও জোরদার করা উচিত এবং তা একাধিক কারণে জোরালোর দাবি রাখে।


সম্পর্ক উন্নয়ন হলে আমাদের অর্থনীতিতে তা স্পষ্ট ও দীর্ঘ প্রভাব রাখবে—এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। আর প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফর এতে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলবে।
সফর শেষে যৌথ ঘোষণায় যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়, তার মধ্যে বাণিজ্য, যোগাযোগ ও অবকাঠামো—এ বিষয়গুলো জড়িত ছিল। আর এ বিষয়গুলোতে আমাদের বেশ বড় ঘাটতি আছে। আমরা যদি এ ঘাটতিগুলো মেটাতে চাই, তাহলে অবশ্যই ঘোষণায় আলোচ্য তিনটি বিষয় সম্পৃক্ত করে দেখার অবকাশ আছে। আমাদের বাণিজ্যঘাটতির দিকে যদি আমরা দেখি, বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। যেমন ভারত থেকে ২০০৭-০৮ সালে আমাদের আমদানি ছিল তিন হাজার ৩২৪ মিলিয়ন ডলার। ২০০৮-০৯ সালে ছিল দুই হাজার ৮১৫ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারতে আমাদের রপ্তানি ২০০৭-০৮ সালে ছিল ৩৫৮ মিলিয়ন ডলার। ২০০৮-০৯ সালে ছিল ২৭৭ মিলিয়ন ডলার। অর্থাত্ বাণিজ্যঘাটতি ছিল যথাক্রমে দুই হাজার ৯৭৭ মিলিয়ন এবং দুই হাজার ৫৩৭ মিলিয়ন ডলার।
এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত এই বাণিজ্যঘাটতি কমানো, পাশাপাশি রপ্তানি বাড়ানো। আমদানির বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায়, আমদানিপণ্যের সঙ্গে ভোক্তা, উত্পাদন এবং রপ্তানি খাতের বিষয়গুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
ভারত থেকে আমাদের আমদানির অঙ্কটা লক্ষ করলে দেখব, ১৯৯০ সালে ভারত থেকে আমাদের আমদানি ছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার। ১৯৯৫ সালে ছিল ৪২০ মিলিয়ন ডলার। ২০০০ সালে ছিল ৫৭০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০৫ সালে ছিল এক হাজার ৬৪০ মিলিয়ন ডলার। এই সময়ে বাইরের অনেক দেশে বড় বড় শিল্প ও রপ্তানিমুখী খাতে বিভিন্ন কাঁচামাল এবং গার্মেন্টস কাপড়ের চাহিদাও বেড়েছে। তা প্রতিফলিতও হয়েছে আমাদের অর্থনীতিতে।
ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেসব ভোগ্যপণ্য সস্তা পড়েছে যেমন—চাল, ডাল ইত্যাদি আমরা সেখান থেকে নিয়মিতভাবেই নিয়ে এসেছি। তবে বিগত সময়ে আমরা আমাদের রপ্তানির সম্ভাবনাকে মোটেও কাজে লাগাতে পারিনি। যেখানে আমরা ভারত থেকে আমদানি করেছি ১৩ শতাংশ, সেখানে আমরা রপ্তানি করতে পেরেছি মাত্র দুই শতাংশ। এর পেছনে বড় কারণ, আমাদের রপ্তানি পণ্যসামগ্রীর সীমাবদ্ধতা। ভারতের বাজারে যেসব পণ্যের চাহিদাতালিকা আছে, তাতে সেই বাজারটা আমাদের ধরা সম্ভব হয়নি। অর্থাত্ আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণেই ভারত বাজারমুখী বিনিয়োগ করতে পারিনি। তবে মনে রাখতে হবে, গত কয়েক বছর ভারতে আমরা কিছুটা রপ্তানি বাড়াতে পেরেছি। ভারতে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬০ মিলিয়ন ডলার। ২০০৭-০৮ সময়ে তা ছিল ৩৬০ মিলিয়ন ডলার। এমনকি বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮০ মিলিয়ন ডলার।
ভারতের বাজারে আমাদের ঢুকতে না পারার কারণগুলোর মধ্যে যে কারণগুলো বেশ প্রভাব ফেলেছে, তা হলো—এক. ভারতের পণ্যের তালিকা সংকুচিতকরণ; দুই. আমাদের অর্থনীতিতে ভারতীয় পণ্যের আমদানি বাড়ার তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম হওয়া; তিন. ভারতের স্পর্শকাতর তালিকায় ছিল আমাদের পোশাকশিল্প; চার. ৪৭টি স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা; পাঁচ. অশুল্ক বাধা, অ্যান্টি ডাম্পিং, সারচার্জ বসানো এবং ছয়. অনেক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি। এ ছাড়া ভারতের বাজারে পণ্যসামগ্রী রপ্তানির জন্য আরও যেসব শর্ত থাকে সেগুলোর মধ্যে টেস্টিং, স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোলিং খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বাধা পেরোনোর জন্য আমাদের উত্পাদিত ভোগ্যপণ্যের মান বাড়ানোর পাশাপাশি বিএসটিআইকে শক্তিশালী করা জরুরি। এবারের চুক্তিতে ভারত বিএসটিআইকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। এটা একটা আশার কথা।
ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে আরেকটি বিষয় জড়িত, সেটা হলো উত্তর-পূর্ব ভারতে বাণিজ্যসুবিধা বাড়ানো। ভারতের উত্তর-পূর্বে বাণিজ্যসুবিধা খুবই কম, ফলে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সেখানে আমরা আমাদের পণ্য পৌঁছাতে পারছি না। ভারতে পাট রপ্তানিও একটি সম্ভাবনাময় বিষয় ছিল। কিন্তু পাটের ওপর লেভেলিং করাটাও পাট রপ্তানিতে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। ভারতের সঙ্গে আমাদের আমদানি-রপ্তানি মূলত ৯০ শতাংশ হয় ল্যান্ড কাস্টমসের মাধ্যমে। ল্যান্ড কাস্টমস পর্যায়েও আমাদের বেশ বড় দুর্বলতা আছে; সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। তাতে করে আমাদের সব ধরনের খরচই বেশি পড়ে যায়। রপ্তানি কমাতে এবং আমদানিকারক ও ভোক্তার খরচ বেশি পড়ে যায় আমাদের এই ল্যান্ড কাস্টমসের দুর্বলতার কারণে। তাই আমাদের ভালোর জন্যই আমাদের ল্যান্ড কাস্টমসের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া অতিজরুরি। এবারের বাংলাদেশ-ভারত বৈঠকে ১০০ কোটি ডলার বা সাত হাজার কোটি টাকা ঋণসহায়তার একটি সমঝোতা হয়েছে। এই টাকা দিয়ে আমাদের কী কাজ করা উচিত, তা আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং দ্রুত মাল আনা-নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। এতে করে অবশ্যই আমাদের আমদানি খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। চুক্তি অনুযায়ী রপ্তানি বাড়ানো; বিশেষ করে, সেবা খাতের রপ্তানি বাড়ানোর মতো বিষয়ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রেও যোগাযোগ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই আমাদের রেল, নৌপথ এবং সব ধরনের রাস্তার সম্প্রসারণ করাটাও খুবই জরুরি বলে মনে করি। আর চুক্তির এই অর্থ অবশ্যই দেশের স্বার্থের অনুকূলেই ব্যয় হবে, এমনটা সবাই আশা করেন। এবং তা যদি যথাযথভাবে হয়, তবে ভারতের বাজারে আমাদের রপ্তানির পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়াতে পারবে বলে অনেকে মনে করেন। পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের দুর্বল বাজার যদি শক্তিশালী হয়, সে ক্ষেত্রেও আমরা লাভবান হব। সেখানে আমাদের নিজস্ব বাজার সৃষ্টি হলে বাণিজ্যঘাটতি কমে আসতে সময় লাগবে না। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশ ৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছে, যা কিনা ভারতে মোট রপ্তানির ১০ ভাগের এক ভাগ মাত্র। আর আমরা আমদানি করেছি ৮১ মিলিয়ন ডলার, যা কিনা ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা মোট পণ্যের মাত্র ৩ শতাংশ। এ ছাড়া এশিয়ার এ উপ-অঞ্চলের কোনো দেশের সঙ্গে তেমন বড় কোনো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও আমরা জড়াতে পারিনি। তা যদি হয় যেমন চীন, ভুটান, মালদ্বীপ—এমন কিছু দেশের সঙ্গে যদি আমরা বাণিজ্যচুক্তিতে যেতে পারি, তবে আমাদের অর্থনীতিতে তা বড় ভূমিকা রাখবে। ভারতের পাশাপাশি ওই দেশগুলোতেও যদি বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা বাড়ে তবে রপ্তানির সুযোগ অবধারিতভাবেই বাড়বে। ১০০ কোটি ডলার যে বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে, আমাদের অর্থনীতিতে তার যথাযথ ব্যবহারের মধ্যে আমাদের বন্দরগুলোও জড়িত। বিশেষজ্ঞদের মতে, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্য উন্নয়নে সেগুলো খুব ভালোভাবে ব্যবহূত হচ্ছে না। আমরা যদি বন্দরগুলোর সঠিক ব্যবহার বাড়াতে পারি, তবে তা অর্থনীতিতে বিরাট সুফল বয়ে আনবে। তবে এই বন্দরগুলো আরও উন্নত করতে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নিউমুরিং নিয়েও একই কথা বলা যায়। সেখানেও বিনিয়োগ করে উন্নত সুবিধার ব্যবস্থা করা হলে বাণিজ্যসুবিধা বাড়বে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
একবিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিকতার যুগে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আমাদের এই উপ-আঞ্চলিক সম্পর্ককে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখার প্রয়োজন আছে। চুক্তিতে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে অশুল্ক বাধা দূরীকরণ একটি। সেটা কত দ্রুত কার্যকর হবে, তা আমাদের দেখতে হবে। সমঝোতা স্বাক্ষরের শর্তগুলো দ্রুত বাস্তবায়নেই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এ ছাড়া সাফটা কত দ্রুত কার্যকর হয়, সেটাও দেখার বিষয়। ভারত কত দিনে ক্রেডিট লাইন খুলে দেবে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। আর আমাদের অর্থনীতির চাকা আরও বেগবান করার জন্য দেশের ভেতর অবকাঠামো কোন কোন জায়গায় নির্মিত হবে, এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার বিষয়। এটি অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা হোমওয়ার্ক সেরে ফেলতে পারি। আমাদের উচিত আমলা পর্যায়ের কর্মকাণ্ড সঠিক পথে চালানো এবং সুনির্দিষ্ট করা। মোট কথা, যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েই আমাদের মাঠে নামতে হবে। সেটি আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা যদি আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮-৯ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। সঠিক ও সময়োপযোগী চিন্তা দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ।

No comments

Powered by Blogger.