স্মরণ-এ যাওয়া শেষ যাওয়া নয় by দিল মনোয়ারা মনু

আখতার চলে গেছে। আমি পাঠককে আগে আগেই জানিয়ে রাখতে চাই, আখতার আহমেদ আমার ভীষণ আদরের ছোট ভাই। ওর ডাক নাম কমল। আজকের লেখায় আমি তাকে সাংবাদিক হিসেবে মূল্যায়ন করব না। কিন্তু অনুসন্ধান করলে যে একেবারেই পাওয়া যাবে না, তা নয়।


স্মৃতিবহ রচনায় সময়, কাল, পরিবেশ এবং মানুষ প্রকাশগুণে উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত হয় তার প্রতিবাদী জীবন, পেশার প্রতি সততা, নিষ্ঠা এবং যে রাজনীতি করত, তার প্রতি কমিটমেন্ট থেকে কখনো বিচ্যুত না হওয়া, ধীরস্থির বুদ্ধিদীপ্ত বিনম্র—এ মানুষটির চরিত্রকে বলিষ্ঠ ও বহুমাত্রিকতা দান করেছে। আমার বিশ্বাস, এ উজ্জ্বলতার আলোকপাত তার সমস্ত দৈন্যকে অতিক্রম করবে।
কমল ছোটবেলা থেকেই আপসহীন মেধাবী এবং প্রচণ্ড রসবোধের অধিকারী। ওর ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। এমবিবিএস পরীক্ষা দেবে না বলে যেদিন পরীক্ষা, সেদিন আমার চাচার বাসায় সারা দিন লুকিয়ে থাকল। আমার বাবা সারা দিন খুঁজেও ওর সন্ধান পেলেন না। প্রচণ্ড রসবোধ ছিল ওর। নিজে হাসত না কিন্তু ওর কথায় হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যেত। একটি ঘটনার কথা বলি, আমি সকালে গানের রেওয়াজ করতাম, একদিন ‘আমি যখন তার দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই’ গানটি গাইছিলাম, ও তখন খুব গম্ভীরমুখে আমার সামনে এসে দাঁড়াল এবং বলল, কে বলেছে তোমাকে শুক্রবার যেতে। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লাম কিন্তু ও গম্ভীর এবং ভাবলেশহীন।
স্কুলজীবনে ও খুব ভালো নাচ করতে পারত। শুকনা পাতলা হওয়ায় বকের অনুকরণ করে নাচ করত এবং নানা ভঙ্গিমা নাচের ছন্দে সুকৌশলে ফুটিয়ে তুলতে পারত। আমার বাবা আমাদের স্কুলজীবনে নাটক করার জন্য বাড়ির উঠোনে মঞ্চ বানিয়ে দিতেন, তাতে আমরা বিভিন্ন ধরনের নাটক করতাম। নাটকের শুরুতে কমল চমত্কার বক ড্যান্স করে সবাইকে মুগ্ধ করত। বিতর্ক এবং আবৃত্তিতেও সে সমান দক্ষ ছিল।
এমনই শত শত সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে আমরা ভাইবোনেরা বড় হয়েছি। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিল, তাই ওকে নিয়ে আমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। ও যখন ম্যাট্রিকে খুব ভালো রেজাল্ট করল, তাঁদের আনন্দের সীমা থাকল না। বড় করে মিলাদ পড়ানো হলো। আর সেই মিলাদে ইমামতি করেছিলেন পীর দুদু মিঞা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করার পরপরই ও জয়েন করল সদ্য প্রকাশিত ডেইলি নিউজ-এ। এরপর বাংলার বাণী, অবজারভার, নিউএজ, নিউনেশন, বাসস, ইনডিপেনডেন্ট-এ কাজ করেছে। কিন্তু কখনই কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেনি। মতের মিল না হলেই চাকরি ছেড়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি। কোনো একটি বড় দৈনিকের কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা শুনে আমি প্রেসক্লাবে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত ভালো কাজটা কেন ছাড়লে? সে আমাকে বলেছিল, ‘তুমি কি চাও, আমি নীতিহীন মানুষের সঙ্গে কাজ করি।’ আমি উত্তরে বলেছিলাম, সারা দেশ নীতিহীন মানুষে ভরে যাচ্ছে, তুমি ভালো মানুষ কোথায় পাবে। আমাদের তো কাজ করেই খেতে হবে। সততা এবং আপসহীনতার জন্য সে নিজের ও পরিবারের জন্য কিছুই করে যেতে পারেনি। সাংবাদিক নেতা হিসেবে সে অন্যের দুঃখের কথা শুনেছে, কিন্তু নিজের দুঃখের কথা কখনো কাউকে বলেনি। সাংবাদিকদের চাকরির স্থায়িত্ব ওয়েজ বোর্ডের জন্য আন্দোলন করেছে। কিন্তু দীর্ঘ কর্মজীবনে নিজের চাকরির নিশ্চয়তা এবং ওয়েজবোর্ডের ধান্দা কখনো করেনি। আদর্শে অবিচল এ মানুষটি এখানেই স্বতন্ত্র। অত্যন্ত হাসিখুশি, সত্, নির্লোভ এ মানুষটি বর্তমান সরকারের কাছ থেকে সম্মানজনক পদের একটি চাকরি পেয়েছিল। ভীষণ আনন্দিত হয়েছিল সে। এক বুক খুশি ও গর্ব নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিল সুদূর আমেরিকায়। কিন্তু ফিরল এক অসহায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লাশ হয়ে—এ কষ্ট, এ যন্ত্রণা আমরা সইব কী করে। ঈদের আগের রাতে আমাদের পরিবারের অনেকের সঙ্গে একে একে সে কথা বলেছে। কী আনন্দ তার কণ্ঠে। মেরিল্যান্ডে বড় বাসা নিয়েছে, স্ত্রী মঞ্জুরী ও একমাত্র মেয়ে রোদেলা যাবে। খোলা জায়গায় রোদেলা খেলবে, গাড়ি চালাবে বলে এই ডুপ্লেক্স বাড়িটি নিয়েছিল সে। ডিসেম্বরের শেষে ওরা যাবে অথচ তার আগেই সব শেষ। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া নিদারুণ নির্মমতা আমাদের পুরো পরিবারকে এখন কুরে কুরে খাচ্ছে। বিএফ ইউজের দুই দুবার মহাসচিব ছিল আখাতার। প্রেসক্লাব আর সাংবাদিকতাই ছিল তার জীবন। জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে তার সেখানে। আজকে আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, এই সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রগুলো কি তাকে মনে রাখবে? বাঁচিয়ে রাখবে ওকে এবং ওর আদর্শকে?
আমরা জানি, ব্যক্তিত্ব কখনো একা বাস করে না, পরিবেশকে ছড়িয়েই সভাসীন থাকে। যে কেউ খোলা মেজাজে সেখানে ঢুকে যেতে পারে। তখন কে ছোট, কে বড় সেই ধান্দা থাকে না। একজনের মনের দর্পণে নানা মানুষের আনাগোনায়ই একজন দেশপ্রেমী মানুষ সার্থক হয়। লেখার চরিত্র হয়। আমি কখনো ভাবিনি, আমার অতি আদরের ছোট ভাই প্রিয় কমল আমার লেখার একটি স্মৃতিবহ চরিত্র হয়ে যাবে, হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণার বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.