সাদাকালো-কবে এসব নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটবে? by আহমদ রফিক

ইদানীং নিষ্ঠুরতার ঘটনাগুলো যেন একটু বেশি করেই দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক ও নানা চরিত্রে এগুলোর প্রকাশ। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, এগুলো কি জিন প্রভাবিত ঘটনা? জিনঘটিত রোগের মতো এসবও কি কোনো ধরনের ব্যাধির বহিঃপ্রকাশ? নিষ্ঠুরতা, হত্যা ও নির্যাতন ঘিরে সংঘটিত অবিশ্বাস্য ঘটনার খবর পড়ে তা-ই মনে হচ্ছে।


একসময় মনে করা হতো, হনন প্রবৃত্তির সঙ্গে মানবদেহের জিনগত কোনো সম্পর্ক রয়েছে।
মানবতা, মানবিক চেতনা, মানবিক হৃদয়বৃত্তি_এসব কথা আমরা শুনি বিদগ্ধজনের কথায়, পড়ি তাঁদের লেখায়। কিন্তু সমাজের বৃহত্তর পরিসরে এসব নীতিকথার প্রতিফলন কতটুকু? তুলনায় নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার প্রকাশই বরং অনেক অনেক বেশি। উদাহরণ টানতে গেলে দিনকয়েকের কাগজ থেকেই এত সব নৃশংস ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা যাবে যে তাতেই লেখার নির্ধারিত আয়তন ভরাট হয়ে যাবে।
তবু দু-একটা ঘটনা উদ্ধার করা না হলে পাঠকের সংশয় থেকে যাবে। ২১ এপ্রিলের একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর : 'আতর আলীকে গাছে বেঁধে খুঁচিয়ে পুড়িয়ে হত্যা।' কেন? 'রাজমিস্ত্রি আতর আলী তার জমির ধান খাওয়ার কারণে গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির গরু খোঁয়াড়ে দিয়েছিল?' কাজটা কি খুব একটা অন্যায় ছিল? আতর আলী গরুকে মারেনি, গরুর মালিককেও ধান খাওয়ার অপরাধে কিছু বলতে যায়নি। শুধু আইনসিদ্ধ বা প্রচলিত রীতিমাফিক কাজটিই করেছিল। অপরাধী গরুকে খোঁয়াড়ে দেওয়া প্রথাসম্মত কাজ।
আর সে জন্যই গরুর মালিক, প্রভাবশালী ক্ষমতাবান ব্যক্তিটি ক্ষিপ্ত হয়ে 'আতর আলীকে আমগাছে বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পেট্রল ঢেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।' স্বভাবতই মৃত্যু ঘটে যশোর সদর উপজেলার শেখহাটি গ্রামের আতর আলীর। খবরে প্রকাশ, পুলিশ এখনো ওই মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বরং 'আসামিরা ওই পরিবারকে উল্টো হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।' এ পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার আইনি পরিণতি কী হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। গরু খোঁয়াড়ে দেওয়ার এতটা শাস্তি কি প্রাপ্য ছিল আতর আলীর?
এ ঘটনার তাৎপর্য একটি গরু খোঁয়াড়ে দেওয়ার উপলক্ষে একটি মানুষের প্রাণ গেল। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, একটি মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। দ্বিতীয় তাৎপর্য, গরুর মালিকের সঙ্গীসাথি যারা ওই অমানবিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল তাদের কারো এ কথা মনে হয়নি যে মানুষ হত্যা আইন ও ধর্মের চোখে বড় অপরাধ, আর একটি অপরাধী গরুর খোঁয়াড়ে যাওয়ার জন্য একজন মানুষকে খুন কোন যুক্তিতে? এখানেই মানবিক চেতনার প্রচণ্ড পরাজয়।
দ্বিতীয় বা শেষ ঘটনাটি হলো গৃহবধূ হত্যা। শরীয়তপুরের ডামুড্যা গ্রামের গৃহবধূ নার্গিস বেগমকে তাঁর স্বামী সেলিম ও সেলিমের মা নূরজাহান বেগম গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে। কারণ, চিরাচরিত ঘটনা_টাকা চাই শ্বশুরবাড়ি থেকে। টাকার সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় এ বিপত্তি। এ ধরনের ঘটনা অবশ্য বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটছে। সমাজ এসব ঘটনা বড় একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। শাসনতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের নৈতিক বোধ সম্ভবত এসব ঘটনা দেখতে দেখতে ভোঁতা হয়ে গেছে। তাই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের বক্তব্য, 'এটা হত্যাকাণ্ড না আত্মহত্যা তা এখনো বলা যাচ্ছে না।' এ ঘটনার প্রকাশ ২২ এপ্রিল, একটি দৈনিকে।
প্রতিদিন কাগজে এ ধরনের ঘটনা পড়ি। ছেলে বাবাকে, ভাই ভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে অকারণে বা যুক্তিহীন কারণে খুন করছে। এমনকি একজন মা সতিনের সন্তানকে খুন করেছে, পিতা সন্দেহের বশে আপন শিশুসন্তানকে হত্যা করেছে_কাগজে এমন রকমারি খবরের সমাহার। মানবচৈতন্যের চরম নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে এমন সব মানুষ, যাদের অন্য আর একটা পরিচয় রয়েছে।
আমি পেশাদার খুনি বা সন্ত্রাসীর কথা বলছি না। বলছি সেই মানুষটির কথা, যে কারো স্নেহপরায়ণ বাবা কিংবা মা, মমতাপরায়ণ ভাই বা বোন_বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যাদের মানবিক হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়নি। সেই মানবিক চেতনা কিভাবে সায় দেয় হৃদয়হীন অমানবিক নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটাতে? তাদের মানবিক হৃদয়বৃত্তি কি মুহূর্তের জন্যও ওই সব নিষ্ঠুরতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় না?
আমার এক সমাজসেবা, হিতবাদী বোনের দৃঢ়বিশ্বাস, দেশের শাসনব্যবস্থা যুক্তিসংগত পর্যায়ে কঠোর হাতে আইনি শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে এ ধরনের নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতার ঘটনা অনেক কমে যেত। কিন্তু দেশের বিচারব্যবস্থা মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো শাস্তির ঘটনা নেহাত কম নয়, তবু তো নিষ্ঠুরতার প্রকাশ কমছে না।
মানুষ বোধ হয় তার মানবিক চরিত্রের বিপরীত দিকে হাঁটতে চাইছে। এখানে একটি তাত্তি্বক প্রশ্ন : আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হনন, প্রতিহিংসা, নিষ্ঠুরতার প্রকাশ কি একালে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে? এ কথা প্রমাণের মতো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। যা আছে নিছক অনুমান বা ধারণা।
তবে আমার মনে হয়, অপরাধের শাস্তির পাশাপাশি আরেকটা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে সামাজিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা, মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা; যা রবীন্দ্রনাথ থেকে একাধিক দেশি-বিদেশি মনীষী বারবার বলে গেছেন। যে সমাজ যত বেশি সহিষ্ণু, যত বেশি মানবিকতাবোধে সচেতন, হৃদয়বৃত্তির প্রকাশে উষ্ণ, মানবীয়_সে সমাজে নৃশংস অপরাধের ঘটনা সম্ভবত অপেক্ষাকৃত কম।
এ ক্ষেত্রে সমাজের পাশাপাশি রাষ্ট্রনৈতিক তৎপরতার মানদণ্ড এবং পদক্ষেপও বিবেচনার যোগ্য। কারো কারো ধারণা শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধের প্রবর্তনা, দেশ বা সমাজবিশেষে শুদ্ধ ও সুস্থ ঐতিহ্যের অনুসরণ ব্যক্তি ও সমাজকে মানবীয় চেতনার মানদণ্ডে উন্নীত করতে পারে। কমিয়ে আনতে পারে হীনতম অপরাধের সংখ্যা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নৃশংস ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকে অর্থনৈতিক স্বার্থ, তা সংগত বা অসংগত যেমনই হোক। সে ক্ষেত্রে কি এমন বিবেচনা যুক্তিসংগত যে সামাজিক সচ্ছলতা এ ধরনের প্রবণতা কমিয়ে আনতে পারে? কিন্তু ওই বিষয়টি তো রাষ্ট্র পরিচালক ও রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের কার্যক্রম, তাদের মত ও পথের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তা ছাড়া সমাজের শুদ্ধ চেতনা যথেষ্ট শক্তিমান না হলে সুশাসনের সম্ভাবনাও আশা করা যায় না।
ঘুরেফিরে কি তাহলে উলি্লখিত নৃশংসতা কমাতে আমাদের ফিরে যেতে হবে সমাজের শুভ চেতনার দিকে, রাষ্ট্রিক সুশাসনের দিকে_যেখানে রাজনীতি বড় একটি কারণ বা উপাদান। দুর্নীতি, স্বার্থবোধ, মাদকাসক্তির মতো প্রবণতার উচ্ছেদ ঘটাতে না পারলে, সমাজে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করতে না পারলে শুধু শুকনো উপদেশে বা সদর্থক কথকতায় কোনো কাজ হবে না। নৃশংসতা বা অমানবিক নিষ্ঠুরতা থেকে বাংলাদেশের কথিত আধুনিক সমাজের মুক্তি ঘটবে না। এ জন্য আরো দরকার রাজনীতির সংস্কার, সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকাশ। প্রসঙ্গত, বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে একটি প্রশ্নের সঠিক জবাব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারিনি। আমাদের সমাজে স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত কুটিলতা ও নিষ্ঠুরতার প্রবণতা কি নিরক্ষর শ্রেণীর তুলনায় শিক্ষিত বা বিত্তবান শ্রেণীতে অপেক্ষাকৃত বেশি? কারণ ধর্মের সঙ্গে লোভের প্রবণতার রয়েছে খুব নিকট-সম্পর্ক। আর লোভ অন্তহীন, এর শেষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমার বিশ্বাস, প্রশ্নের জবাব একটি ব্যাপক সামাজিক জরিপে মিলতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে সঠিক জবাব পাওয়া গেলে সমাজ পরিবর্তনের কাজ শুরুর একটা দিকনির্দেশনা মিলতে পারে।
আর এ সূত্রেই সবার উদ্দেশে আরেকটি প্রশ্ন : প্রচারমাধ্যমের তথ্যের কল্যাণে মনে হয় যে এ নিষ্ঠুরতার পাপ বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি, কিন্তু কেন? বাঙালি সত্যই কি এতটা নিষ্ঠুর? কিন্তু যত দূর জানি, এ সমাজে এত নিষ্ঠুরতার তো এমন ঐতিহ্য নেই। অতীতে অপরাধ ছিল না, এমন নয়। কিন্তু কথায় কথায় হত্যা, সামান্য কয়টা টাকার জন্য হত্যা, সর্বোপরি পারিবারিক ও সামাজিক সন্ত্রাস, সামান্য মতবিরোধের জন্য স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন_হত্যার এ মহামারি রূপ আগে কি দেখা গেছে? আর একাত্তরে দেখেছি, মানুষে মানুষে কী সৌহার্দ্য, পরস্পরকে সহায়তার কী উদাহরণ, অচেনা তরুণের পাশে নির্ভয়ে হেঁটেছে অসহায় তরুণী? কেউ হয়তো বলবেন_ওটা তো ক্রান্তিকাল; তাই। কিন্তু তার আগেও কি এ ধরনের সামাজিক বর্বরতার ভয়াবহতা ব্যাপক আকারে বিদ্যমান ছিল? প্রশ্নটার উত্তর জানতে ইচ্ছে করে।
লেখক : ভাষা সংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.