থামুক গুম ও গুপ্তহত্যা by আলমগীর শাহরিয়ার

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অজানা শঙ্কায় খুব উৎকণ্ঠিত। কেননা, আমরা খুব অস্থিতিশীল এবং আতঙ্কজনক পরিস্থিতির দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছি। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট সরকার যে 'দিনবদল'-এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল; সরকারের শেষ মুহূর্তে এসে মনে হয়, দিনবদল হয়েছে ঠিকই, তবে সাধারণ মানুষের নয়।


দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হু.মু. এরশাদের ভাষায়, 'মানুষ ঘরে থাকলে খুন হয়, বাইরে গেলে গুম হয়' (বিবিসি বাংলা, ২৯ এপ্রিল, ২০১২)। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে তৈরি সরকারের বিশেষ বাহিনী র‌্যাবের ক্রসফায়ারে এ যাবৎ হাজার দেড়েক মানুষের নির্মম মৃত্যু হয়েছে। এই নির্মম, নিষ্ঠুর, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সভ্য সমাজে মানুষের মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়া সম্প্র্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত ২৭ মাসে বাংলাদেশে ১০০ মানুষ গুম হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে বড় অংশ বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, শ্রমিক সংগঠনের নেতা, ব্যবসায়ীও রয়েছেন। অনেকেরই ক্ষত-বিক্ষত লাশ পথে-ঘাঠে, ঢাকার আশপাশের নদী শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের অন্যান্য নদীতে পাওয়া গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক ও অসহনীয়ভাবে। কোথাও শান্তি নেই। নিত্য দুর্ঘটনাকবলিত রাস্তা, ফুটপাত, জলপথ। নিরাপত্তা নেই মায়ের কোল, সুরক্ষিত এলাকা গুলশান-বনানী, জাতীয় সংসদ এলাকায়; কোথায়ও না। সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ মারা হচ্ছে। তারপরও কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই, বিক্ষোভ নেই। তারপরও অ্যান্তনিও গ্রামসির সংজ্ঞায়নে পড়া বাংলাদেশের সুবিধা আদায়ে ব্যতিব্যস্ত বুদ্ধিজীবীরা স্তুতি ও প্রশস্তি গাইছেন নিজ নিজ রক্ষণভাগে নিরাপদ অবস্থানে থেকে। দেশের সর্বত্র, অন্যান্য প্রান্তে একই অবস্থা বিরাজমান। সাধারণ মানুষের এত সব দুর্বিপাকে তারা সব আশ্চর্য রকম নীরব। কেবলি সরব হয়ে ওঠেন কীভাবে জনগণকে 'ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলো'য় নিক্ষেপ করা যায় সে লক্ষ্যে। গত এক মাসের ঢাকা শহরের দৃশ্য যদি দেখি_ হযরত আলী সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হন, মহাজোট সরকারের সদ্য সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএসের টাকা কেলেঙ্কারি ফাঁসের নায়ক ড্রাইভার আজম নিখোঁজ (দুর্বৃত্ত আমলাদের কথা উহ্যই রইল), ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার ড্রাইভার আনসার আলীও গুমের শিকার, হরতালের আগের দিন মধ্যাহ্নের আহার শেষে ক্লান্ত ঘুমন্ত চালক বদর আলী অগি্নদগ্ধ হয়ে ছাই, পিকেটারদের হামলায় নিহত রংপুরের গাড়িচালক আবদুুর রশীদ, ইলিয়াস আলী গুমের প্রতিবাদে সংঘর্ষে তার নির্বাচনী এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথে পুলিশ ও সরকারি দল সমর্থকদের হামলায় নিহত মনোয়ার হোসেন, জাকির হোসেন ও আরও একজনের লাশ বলে দেয়_ এই দেশ এখন মৃত্যু উপত্যকা।
তারপরও শাসকশ্রেণী বলছে, দেশ ভালো আছে। বিরোধী দল লাগাতার সংসদ বর্জন করলেও আমাদের গণতন্ত্র সুসংহত; এগোচ্ছে। শেয়ার মার্কেট ও এমএলএম, ডেসটিনিসহ আরও নানা ছদ্মখাতের মাধ্যমে সরকারের প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে লোপাট হয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সাংসদ, মন্ত্রী মহোদয়, এপিএস ও তাদের নানা বন্ধনে আবদ্ধ স্বজনদের বায়বীয় দুর্নীতির কথা না হয় না-ই বললাম। নিজের জীবনের সবটুকু সঞ্চয় বিনিয়োগে খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসে গেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। দেশে এত সব ঘনঘটার পরও যখন রাষ্ট্রের বিবেক বলে পরিচিত বিদ্বৎশ্রেণী, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী শাসকদের মনতুষ্টিতে নির্লজ্জ তোষামোদে মেতে ওঠেন, তাহলে প্রান্তিক মানুষদের আরও বিড়ম্বনা-গঞ্জনা-বঞ্চনা; আরও ধ্বংস, বিনাশ সইতে হবে বৈকি। চারপাশে এমন সব দেখে তাই কবি জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয়_ 'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তাঁরা; যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী আজ অচল তাদের সুপরামর্শ ছাড়া/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ এখন যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।'
ৎ শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.