বাংলাদেশ-ভারত বিশেষজ্ঞ মতামত যৌথ নদী-অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা জরুরি by আইনুন নিশাত

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৫০টিরও বেশি নদী ভারত হয়ে এ দেশে এসেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সারা বছর বিপুল পরিমাণ জলরাশি প্রবাহিত হয়। তেমনি এই পানির সঙ্গে বিপুল পরিমাণ পলি প্রবাহিত হয়। নদীর পানির প্রবাহের সঙ্গে পলির পরিমাণের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকে।

নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই সামঞ্জস্যটির কথা মনে রাখতে হয়। বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনার কথা ভাবতে গেলে নদীর পানি ব্যবস্থাপনা এবং নদী ব্যবস্থাপনা দুটোকে একসঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। বিষয়টি আরও জটিল হয়, নদীগুলোর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সব নদ-নদীর মাধ্যমে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়, তা মোট প্রবাহের প্রায় ৯২ শতাংশ। কাজেই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। অধুনা অববাহিকাভিত্তিক পরিকল্পনার কথা জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছে। পাহাড়-পর্বতের ভেতর থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীটির সাগরে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটি অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার অধীনে আনার কথা বলা হচ্ছে। অববাহিকা ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করবে নদীর মাধ্যমে পলি প্রবাহের পরিমাণ। একই সঙ্গে অববাহিকা ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যেতে পারে। বাংলাদেশ যেহেতু নদীগুলোর ভাটিতে অবস্থিত এবং মূল প্রবাহ আসে ওপর থেকে, সেহেতু অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ভারত থেকে বাংলাদেশর প্রবেশ করা নদীগুলোতে বর্ষাকালে প্রচুর পানি থাকে, আর শীতকালে বলা যেতে পারে প্রায় শুকিয়ে যায়। অর্থাৎ একসময় পানির আধিক্য অন্য সময় স্বল্পতা। সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে পারলে এই প্রবাহের মধ্যে কিছুটা সামঞ্জস্য আনা সম্ভব। এটি অর্জন করতে গেলে, প্রথমেই প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নদী ব্যবস্থাপনায় যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা বদলানো। ছোট্ট এই লেখাটিতে এ বিষয়টিই ব্যাখ্যা করব করার চেষ্টা করছি।
কয়েকটি বিষয়ে আমি আমার আলোচনা কেন্দ্রীভূত রাখতে চাই। আলোচনায় থাকবে সুরমা-কুশিয়ারা-বরাক নদী প্রসঙ্গ। এছাড়াও থাকবে তিস্তার ব্যবস্থাপনা এবং গঙ্গার ক্ষেত্রে ১৯৯৬ সালে চুক্তি থাকার পর আর কী করতে হবে, তা নিয়ে আলোচনা। কিছু কথা বলতে চাইব, সীমান্ত এলাকার নদী ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ নদী ভাঙনরোধ ও নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ড্রেজিংয়ের বিষয়ে।
প্রথমেই ধরা যাক, গঙ্গার বিষয়টি। ১৯৭৭ সালের চুক্তি, ১৯৯২ এবং ১৯৯৪-এর স্বাক্ষরিত দুটি পৃথক সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়ন পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত হলো একটি ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি। আইনের মাপকাঠিতে ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৬-এর চুক্তিগুলোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে বলেই এগুলোকে যথাক্রমে চুক্তি, সমঝোতা স্মারক (দুটি) এবং ট্রিটি বলছি। ১৯৯৬-এর চুক্তির তিনটি অংশ যথা—পানিবণ্টন, পানি প্রবৃদ্ধির প্রস্তাব আনা এবং অন্যান্য নদীর পানি ব্যবস্থাপনা এই চুক্তিতে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে যে পরিমাণ পানি আসে সেটাকেই ভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ উজানে ব্যবহারের পর, যতটুকু তলানি থাকে সেটাই ভাগ করা হয়েছে। অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার কথা ভাবা হয়নি। অবশ্য শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করতে গেলে অববাহিকাভিত্তিক চিন্তাভাবনার কোনো বিকল্প নেই। এ কাজে এখন পর্যন্ত সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। একই সঙ্গে এসব চুক্তিতে ধরে নেওয়া হয়েছে পানি ব্যবস্থাপনা করতে হবে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে সময়ের জন্য। অর্থাৎ বছরের প্রথম পাঁচ মাস পেরিয়ে পরবর্তী সাত মাস প্রবাহের ব্যাপারে কোনো কিছু ভাবা হয়নি। এই চিন্তাভাবনারই প্রভাব পড়েছে তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদ-নদীর ক্ষেত্রেও। তিস্তার ক্ষেত্রে আমরা পানি বণ্টনের কথা বলছি, ব্যবস্থাপনার কথা নয়। অবশ্যই শুকনো মৌসুমে পানিবণ্টন একটি বিষয় হতে পারে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, শুকনো মৌসুম কোনটি? কোথাকার পানি বণ্টন হবে? কীভাবে হবে? কোন ভিত্তিতে হবে? গঙ্গা চুক্তির ধারা ধরে আমরা কি জানুয়ারি থেকে শুকনো মৌসুম হিসাব করব? উত্তর হলো, এটা করা হলে মারাত্মক ভুল হবে। তিস্তার পানি বণ্টন করতে হবে। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে তিস্তা অববাহিকায় পানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে তিস্তার প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে দুই দেশের চাহিদা মেটাতে খুব একটা ঘাটতি থাকার কথা নয়। কিন্তু অক্টোবর মাসে আমন ধানের জন্য সেচ দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি এবং কিছুটা ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আর ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল মাসে বোরো চাষের জন্য দুই দেশের চাহিদার তুলনায় স্বাভাবিক প্রবাহ অত্যন্ত অপ্রতুল। যে জন্য অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার অধীনে বর্ষাকালের কিছুটা পানি ধরে রাখা যায় কি না, তা ভাবতে হবে। আর পানি বণ্টনের প্রক্রিয়া তিস্তার ক্ষেত্রে জটিল হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, যে অবকাঠামোর মাধ্যমে পানিবণ্টন করা যেতে পারে সেটির অবস্থান। ভারতের গজলডোবার ব্যারাজটি বাংলাদেশের সীমানা থেকে অনেক উজানে, কাজেই বণ্টনের জন্য পানির পরিমাণ নির্ধারণ এবং বণ্টন ব্যবস্থায় ভালো রকম জটিলতা আছে। আমরা যদি তাত্ক্ষণিক প্রবাহবণ্টনের পরিবর্তে সাংবাত্সরিক পানির হিসাব করে সেটি বণ্টনের কথা ভাবী, তাহলে বাংলাদেশ বেশি উপকৃত হবে। এর জন্য অবশ্যই জলধারাসহ কিছু অবকাঠামো প্রয়োজন হবে। তিস্তা নদীর পানি ব্যবহার নিয়ে মূল প্রকল্প বোধকরি অবিভক্ত ভারতে ১৯৪৫ সালে করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে ভারত এবং বাংলাদেশ দুটি আলাদা প্রকল্প প্রণয়ন করে। ১৯৫২ সাল থেকে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে এবং ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত আলোচনার ধারায় কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে ধারণা পাইনি। বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। আমন মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি এবং শুকেনো মৌসুমে কতটা পানি প্রয়োজন তাও জানা দরকার। অর্থাৎ আলোচনার জন্য তিস্তা নদীকে বাংলাদেশ সরকার যে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, এটি সঠিক বলে মনে করি। তবে আলোচনার ধারা বদলানোর জন্য চিন্তাভাবনার পরিবর্তন না হলে গ্রহণযোগ্য সমাধানের রাস্তা দেখছি না।
এবার আসি বরাক তথা সুরমা-কুশিয়ারার কথায়। এই নদীগুলো নিয়ে প্রথম কখন আলোচনা শুরু হয়েছে জানা নেই। তবে ১৯৭২ সালের প্রথম দিক থেকেই যৌথ ব্যবস্থাপনার কথা ভাবা হচ্ছিল। আমার জানা মতে, আলোচনার এই ধারাটি দুই বছরের মতো চলেছিল। এরপর ভারত বরাকের বিষয়টিকে গঙ্গা আলোচনায় ঢুকিয়ে দিলে, বাংলাদেশের দিক থেকে বরাক বিষয়ে আলোচনায় ভাটা পড়ে। কাজেই ১৯৭৬-এ গঙ্গাচুক্তির ভিত্তিতে ১৯৮২ তে যে পর্যালোচনা সভা হয়, সেখানে বাংলাদেশ বরাক বিষয়ে আলোচনা করতে সঙ্গত কারণে রাজি হয়নি। এরপর ১৯৮৯ সালে বন্যা ব্যবস্থাপনার নামে বরাক বিষয়ে আলোচনা করতে চাইলেও বাংলাদেশ সম্মত হয়নি। ’৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফ্লাড অ্যাকশন প্লানের ছয় নম্বর প্রকল্পটি পর্যালোচনার সময় বরাক নদীর উজানে টিপাইমুখ ড্যামের বিষয় বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের নজরে আসে। তখন যতটুকু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গিয়েছিল, তার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন, টিপাইমুখের কারণে বন্যার ক্ষেত্রে সমস্যার মাত্রা কিছুটা লাঘব হতে পারে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেবে, সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলো থেকে পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে। ওই সময়ে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি টিপাইমুখে ড্যামের কারনে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি প্রবাহে কী পরিবর্তন আসবে।
আমি মনে করি, এখন গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে প্রস্তাবিত অবকাঠামোর বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা চালানো যেতে পারে। আমি গোড়াতেই বলেছি, অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। আমার এ বক্তব্য সুরমা-কুশিয়ারা-বরাকের জন্য প্রযোজ্য বলে মনে করি। দেশের ভেতর টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে এক দল বলছে, টিপাইমুখ বন্ধ কর, এতে আমাদের ক্ষতি হবে, এ দেশ শুকিয়ে যাবে। এ ধারণার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আমি খুঁজে পাইনি। তবে টিপাইমুখ বাঁধের সঙ্গে ফুলেরতলে ব্যারেজ হলে এ ঘটনাটি ঘটতে পারে। আর অন্য দলের কথা হচ্ছে, ভারত ফুলেরতলে ব্যারেজ নির্মাণ করবে না। এবং বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু নির্মিত হবে না। তাদের কথার ভিত্তি খুঁজে পাওয়া গেলেও এ ভিত্তি কতটুকু নির্ভরযোগ্য, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। এ ক্ষেত্রেও অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় যেতে না পারলে নদীটির ভাগ্যে কী ঘটবে বলা মুশকিল। টিপাইমুখ নির্মিত হলে সর্বপ্রথম বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে মণিপুরের ওপর। এর বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যাবে। কাজেই ভারতের যারা টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা করেছে, তাদের উদ্বেগের কারণ আর বাংলাদেশের উদ্বেগের কারণের মধ্যে কোনো মিল নেই। বিশ্বজুড়ে ড্যামের বিরুদ্ধে নানা আন্দোলন হচ্ছে। বিরোধিতা মূলত আসে ড্যামের উজানের অঞ্চল থেকে। বাংলাদেশের জন্য এখন প্রয়োজন বরাক নদীর অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার কথা চিন্তা করা এবং এই ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নির্ধারণ করা।
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত নদী কুশিয়ারার ভাঙনের বিষয়টি অবিলম্বে নজর দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী নদীর ভাঙনের কারণে নদীর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। এক দেশের জমি অন্য দেশসংলগ্ন হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে কোন জায়গায় নদী ভাঙন ঠেকানো অতি জরুরি, সেটি নির্ধারিত করা দরকার এবং যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নদীশাসনের কাজটি হাতে নেওয়া উচিত। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যেসব স্থানে নদী ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে কুশিয়ারার নাম না দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। ওই তালিকায় নাগর, আত্রাই, করতোয়া কিংবা কুলিকের নাম রয়েছে। আরও কিছু নাম সংযোজিত হওয়া উচিত এবং নদী ভাঙনরোধে কর্মকাণ্ডটি যৌথ ব্যবস্থাপনায় হওয়া উচিত।
আমি এ লেখাটি শেষ করছি আন্তর্জাতিক নদ-নদী ব্যবস্থাপনার ধারা অবলোকনের আহ্বান জানিয়ে। দুই বা ততোধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীকে আন্তর্জাতিক নদী বলা হয়। অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সব আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে ভাবা হচ্ছে। একটি ফেডারেল ধরনের রাষ্ট্রের দুই বা ততোধিক প্রদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলোর ব্যবস্থাপনাও একই পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে। ভারতের যেসব আন্তপ্রদেশীয় নদ-নদী রয়েছে সেগুলোর ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিও আমাদের পর্যালোচনা করা উচিত। যেখান থেকে বেশ কিছু শিক্ষণীয় বিষয় বাংলাদেশ-ভারত পানিবিষয়ক আলোচনার কাজে লাগানো যেতে পারে।
আইনুন নিশাত: পানি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ।

No comments

Powered by Blogger.