সময়ের প্রতিবিম্ব-মইন উ আহমেদের ‘ন্যায়-অন্যায়’ by এবিএম মূসা

সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে, ‘আমি জেনেশুনে কোনো অন্যায় করিনি।’ সূত্র হচ্ছে, ‘সাংবাদিকদের মইন উ আহমেদ’। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে, জেনারেল (অব.) মইন যদি মনে করে থাকেন ২০০৭ সালের এক-এগারো, মানে জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে তিনি তত্কালীন সামগ্রিক পরিস্থিতিতে যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা ন্যায় বা অন্যায় ছিল এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকতে পারে।


যদি অতীতের অনেকের অনুসরণে তিনি বলেন, ‘জাতির এক সংকটময় মুহূর্তে’ তাঁকে একটি পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল, তবে তা ভিন্ন নিরিখে আলোচনা করতে হবে। আমি নিজে মনে করি, এক-এগারো সংঘটিত হওয়ার কারণগুলো তথা সেই তারিখের পূর্ববর্তী দিনগুলোর ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে জেনারেল মইনের তত্কালীন ভূমিকার ন্যায্যতার নয় প্রয়োজনীয়তার পক্ষে যুক্তি রয়েছে। একথা স্বীকার করতেই হবে তিনি এককভাবে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগে এক-এগারো আনেননি। ঘটনাপ্রবাহে জড়িত ছিলেন দেশি-বিদেশি অনেক নায়ক। পরোক্ষ সমর্থন ছিল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাপক সংখ্যক জনগণের, তাই রাজনীতিকদের সংশ্লিষ্টতা ছিল, একথাও বলা যায়। তারিখটির এক মাস আগে থেকে সারা দেশে সংগঠিত নৈরাজ্য, গণবিক্ষোভ ও ব্যাপক সহিংসতার কারণে দেশের মানুষ বুঝেছিলেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। সেই ‘কিছু একটা’ পরস্ফুিট হলো জানুয়ারির ১১ তারিখে। সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধানের তথা সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বিদেশি কূটনীতিকদের পরোক্ষ সমর্থনে বা চাহিদায় বঙ্গভবনে অবশ্যম্ভাবী পটপরিবর্তন ঘটল।
যদি জানুয়ারির ২২ তারিখে আসন্ন নির্বাচন বিদায়ী সরকারের পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী হতো, অথবা রাষ্ট্রপতি, অসাংবিধানিক পন্থায় প্রধান উপদেষ্টার পদ দখলকারী ইয়াজউদ্দিন যেনতেনভাবে করে ফেলতে পারতেন তবে দেশে গৃহযুদ্ধ হতো। একটি ‘মাগুরা’ নির্বাচন দেশে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। যদি ১/১১ না হতো, তবে অবশ্যই ১/২২-এ ৩০০টি মাগুরা হতো। সারা দেশে বিক্ষোভ ও সহিংস পরিস্থিতির কারণে বিএনপি মনোনীত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের পরিকল্পিত ছক-বাঁধা নির্বাচন হতে পারেনি। বিদায়ী সরকারের সাজানো বাগান ছারখার হয়ে গেল এক-এগারোর কারণে। এ হচ্ছে, আমার এক-এগারো সংঘটিত পটপরিবর্তনের ন্যায্যতার নিজস্ব ব্যাখ্যা। এই পরিপ্রেক্ষিতে এক-এগারো সংঘটনের জন্য ন্যায়-অন্যায় দায়ভার আমি কোনো ব্যক্তির কাঁধে এককভাবে চাপাতে চাই না। যাঁরা ক্ষমতা চিরন্তন করতে পঙ্কিল পথ তৈরি করেছিলেন সেই ক্ষমতা ত্যাগে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক মহলকেই অভিযুক্ত করব।
সেনাপ্রধানের প্রাথমিক পদক্ষেপের মূল্যায়নে ক্ষমতা পরিবর্তনের সূচনালগ্নের ভূমিকা ‘অন্যায়ের’ তালিকায় থাকবে না। তবে এক-এগারো-পরবর্তী প্রায় দুই বছর সময়ে তিনি অথবা তিনি যাঁদের সংশ্লিষ্ট করেছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে নেয়া বিতর্কিত, স্বৈরাচারী ও স্বেচ্ছাচারী ‘অন্যায়’ অবশ্যই আলোচিত হতে হবে। সেই আলোচনায় প্রথমে উল্লেখ করতে হচ্ছে, গত শনিবার তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পরবর্তী বাক্যগুলো। তিনি বলেছেন, ‘যদি আমরা গণতন্ত্র চাই, তবে আরও বেশি গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। চর্চা করে এর মান উন্নত করতে হবে।’ তিনি কি এখনো বুঝতে পারেননি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাজনীতির কিম্ভূতকিমাকার ‘উন্নয়ন’ করতে গিয়েই তিনি ও তাঁর সহযোগীরা বিতর্কিত ও নিন্দিত হয়েছেন। তাঁদের বিরাজনৈতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ‘দেশি গণতন্ত্র’ কায়েম করার প্রচেষ্টা অবশ্যই ‘অন্যায়’ ছিল।
তাঁর ‘গণতন্ত্র শুদ্ধিকরণের’ বক্তব্যের বিরুদ্ধে আমি প্রথম আলোর কলামে মৃদু সমালোচনার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। জেনারেল মইন আমার প্রতিবাদ তথা সমালোচনাটি যে সহজভাবে ও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন পরবর্তী ঘটনাবলি বিশ্লেষণে বহুদিন পর তা অনুধাবন করেছি। সঠিক তারিখটি মনে নেই, একদিন সকালবেলা একটি টেলিফোন পেলাম। টেলিফোনকারী বললেন, ‘আমি কর্নেল ফিরোজ, সেনাপ্রধানের ব্যক্তিগত সচিব। চিফ আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’ প্রথমে একটু অবাক হলাম, বিদ্যমান জরুরি অবস্থার কথা ভেবে ঘাবড়েও যাইনি, তা নয়। মনে পড়ল, সেদিন প্রথম আলোতে আমার প্রতিবেদনে সেনাপ্রধানের সমালোচনা করেছি, তাঁর একটি বক্তব্যের অন্তর্নিহিত মানে জানতে চেয়েছি। ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম, এক-এগারো-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের কতিপয় তাত্ক্ষণিক অবাঞ্ছিত কার্যকলাপ ও তাঁর ‘নিজস্ব গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী হতে পারে ভেবে দুশ্চিন্তা হয়েছিল।
জেনারেল মইন ফোনে প্রথমেই বললেন, ‘মূসা সাহেব, আপনার লেখা পড়ি, ভালো লাগে। তবে আপনি আজকে যে ইঙ্গিতটি করেছেন সে সম্পর্কে সরাসরি জানাচ্ছি, আমার বা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের কোনো ইচ্ছা নেই।’ পরবর্তী কথোপকথন ব্যক্ত করার আগে জেনারেল মইনের প্রথম সমালোচিত বক্তব্যটি উদ্ধৃত করছি। ক্ষমতা বদলের পর জেনারেল প্রথম প্রকাশ্যে এলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সম্মেলনে। সেখানে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি রাজনীতিবিদদের নসিহত করে বললেন, ‘আমাদের নিজস্ব গণতন্ত্র প্রচলন করতে হবে, বিদ্যমান রাজনীতির সংস্কার প্রয়োজন।’ জেনারেল মইনের এই বক্তব্যের পরোক্ষ সমালোচনায় যা লিখেছিলাম তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, ‘আমাদের নতুন করে গণতন্ত্র শিখতে হবে না। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রেরণা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সেই সংগ্রামের সুফল না পাওয়ার ব্যর্থতা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নয়, গণতন্ত্র পিপাসু জনগণের তো নয়ই। স্বেচ্ছাচারী সামরিক নায়কেরাই গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে বারবার ব্যাহত করেছে।’ বক্তব্যটিতে প্রদত্ত ইঙ্গিতটি বোধহয় জেনারেল মইন অনুধাবন করে ক্ষমতা গ্রহণের প্রশ্নটি আলোচনায় এনেছিলেন। কারণ আমি অতীতের উদাহরণ দিয়ে লিখেছিলাম, ‘আইয়ুব খান আমাদের গণতন্ত্র শেখাতে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। রাজনীতিবিদদের বহু যুগের রাজনীতিচর্চার খুঁত ধরে জিয়া আর এরশাদ নিজেরাই অপরাজনীতির হোতা হয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন করেছিলেন।’ সেসবই জনগণ বারবার প্রত্যাখ্যান করে তাদের নিজস্ব গণতন্ত্র কায়েম করেছে। নয়া ধরনের গণতন্ত্রের সবকদাতাদের অবশেষে ‘এক্সিট রুট’ বা প্রস্থানের পথ নয় ‘এসকেপ রুট’ তথা নিরাপদ পলায়নের পথ খুঁজতে হয়েছে।
দীর্ঘ এক ঘণ্টা টেলিফোনে তত্কালীন সেনাপ্রধান আরও অনেক কথা বলেছিলেন সেসব পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তবে জেনারেল মইন সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দিয়েছিলেন তা ছিল, ‘এক-এগারো পদক্ষেপের এক সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রপতি তত্কালীন পরিস্থিতিতে নিজেই সেনাবাহিনী তলব করেছিলেন। আবার ফেরত পাঠিয়েছিলেন।’ শীতকালীন মহড়া থেকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের সেনাবাহিনী তলবের ঘটনাটি কি এক-এগারো সংঘটনের পথটি প্রশস্ত করেছিল! এ কথা কি বলা যায় না, ইয়াজউদ্দিনের নিয়ন্ত্রণকারীরা সেদিনই সেনাবাহিনীকে এক-এগারো পদক্ষেপ গ্রহণে দ্বিধাহীন করেছিল। সবশেষে সেনাপ্রধান বললেন, ‘বিশ্বাস করুন আমরা দেশের শাসন চালাচ্ছি না। আমরা যা চাই তা হয় না, আবার যা চাই না তা-ই হচ্ছে।’ তাত্ক্ষণিকভাবে তাঁর বক্তব্যের মর্মার্থ বোধগম্য হয়নি, তাই জিজ্ঞেস করা হয়নি দেশে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেসামরিক লেবাসের আড়ালে সামরিক শাসন চলছে, তা কি অবোধ্য? সব সামরিক শাসনামলের সূচনায় অতীতে যেমনটি হয়েছে তেমনিভাবে জেলা, এমনকি থানা পর্যায়ে সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক নামধারী সরকারের একমাত্র করণীয় ছিল নির্বাচন অনুষ্ঠান। সেই কর্তব্য সম্পাদনের জন্য কি সারা দেশে সর্বত্র সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সূচনালগ্নে অযাচিত, অবাঞ্ছিত ও ত্রাস সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ কিসের আলামত মনে হয়েছিল? বেসামরিক প্রশাসনের নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায়ে কেন সামরিক কর্তাদের খবরদারি চলছে। পরে আরো অনেক প্রশ্ন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কেন সেনা ঘাঁটি বসানো হয়েছিল যে কারণে একটি সেনাদল জনরোষের শিকার হয়েছিল? ছাত্র-শিক্ষকদের নিষ্ঠুর নিপীড়ন করা হয়েছিল কেন? যাই হোক, সেদিনের আলাপচারিতা শেষে তিনি আমাকে দুটি ব্যক্তিগত টেলিফোন নম্বর দিয়ে তাঁর যেকোনো বক্তব্য বা কর্মের সমালোচনার আগে ‘একটুখানি কথা’ বলতে অনুরোধ করলেন। মজার ব্যাপার হলো উপরোল্লিখিত প্রশ্নগুলো করার জন্য পরে কোনদিন টেলিফোনে তাঁকে যোগাযোগ করতে পারিনি। কিংবা অপ্রীতিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে বলে তিনিই আমাকে এড়িয়ে গেছেন।
অতঃপর দেশব্যাপী যখন কতিপয় সেনাসদস্যের বাড়াবাড়ি অসহনীয় হয়ে পড়ল, তখন ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানোর বা সামান্যতম প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না। রাজনৈতিক দলের বীরপুঙ্গবেরা অনেকে দেশ ছেড়ে পালালেন। যাঁরা নতুন সরকারের ক্ষমতায় অতি বা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলতে জনগণকে সংগঠিত করতে পারতেন তাঁদের বেঁধে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হলো। রাজনীতিবিদদের মেরুদণ্ড আর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য তৈরি হলো জিজ্ঞাসা সেল। অমানবিক নির্যাতনের শিকার হলেন অনেকেই। দুই প্রধান নেত্রীকে প্রথমে গৃহবন্দী ও পরে নির্বাসনে পাঠানোর অনৈতিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলো। এসবই ব্যক্তি মইন উ আহমেদ এবং তাঁর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রিত সরকারের কার্যাবলির ‘ন্যায়-অন্যায়’ নির্ধারণে বিবেচনায় আসবে।
এবার একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা। কালক্রমে দেশে যে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল সে সময়ে জনগণের পক্ষে তাদের পাশে অকুতোভয় ভূমিকা নিয়েছিল গণমাধ্যম। আজকে সবাইকে সেই স্বীকৃতি দিয়ে বলতে হবে, ‘এক-এগারো এনেছিলেন রাজনীতিবিদেরা বিতাড়িত করেছে গণমাধ্যম।’ তাই গণমাধ্যমকে আঘাত করল নতুন ক্ষমতাধর চক্র। যেমনটি করেছেন অতীতের সামরিক শাসকেরা। যাঁরা ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে চেয়েছিলেন। তাদের গ্রেপ্তার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা যখন বেড়ে যাচ্ছে তখন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক অনুজপ্রতিম মাহফুজ আনাম আমাকে বললেন, ‘মূসা ভাই, শুনেছি সেনাপ্রধানের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে। আমরা সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টি তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আপনি একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করুন।’ আমাকে দেওয়া জেনারেল মইনের ব্যক্তিগত টেলিফোনে যোগাযোগ করে সেই বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলাম। গণমাধ্যমে বৈঠকটির খবর ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু ছাপা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কখনো প্রকাশিত হয়নি। সেনাপ্রধান সাংবাদিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলেন।
বোধহয় সেনাপ্রধানের আশ্বাসবাণী পরবর্তী সময়ে তাঁর অধীন সেনা কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছেনি অথবা পৌঁছানো হয়নি। এমনটি মনে হওয়ার কারণ রাজধানী ও মফস্বলে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার, হয়রানি ও নির্যাতন অব্যাহত ছিল। এমনকি আমি ও অন্যান্য তিনজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক হয়রানির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছিলাম। এরপর আমাদের পুনরায় আশ্বস্ত করার জন্য সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার সঙ্গে দেখা করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। তার পরও সংবাদমাধ্যমের ওপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল। কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নে গণমাধ্যমই তখন একমাত্র প্রতিবন্ধক। তাই পত্রিকার সম্পাদক-মালিকদের ‘সাবধান’ করা হতো। বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যাবলির সমালোচনায় তাঁদের বিব্রত ও ক্ষুব্ধ করেছিল। এ জন্য নিউ এজের নুরুল কবির, আসাফউদ্দৌলা ও আমাকে সব চ্যানেলে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এতদসত্ত্বেও বহুল আলোচিত মাইনাস-টু, নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা নিয়ে মুখর হয়ে উঠেছিল গণমাধ্যম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মাইনাস-টু ভণ্ডুল করার জন্য লেখালেখি করেছি। এমনকি এ সময়ে দুই নেত্রীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগও হয়েছিল। তাঁদের ‘উদ্দেশ্যমূলক মাইনাস পদক্ষেপটি’ সম্পর্কে তাঁদের অবহিত করেছিলাম। বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিত্সক ডা. সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে যোগাযোগ হওয়ার পর বলেছি, ‘দেশে থাকুন, কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’ বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেত্রীর সঙ্গে তাঁর প্রাক্তন প্রোটোকল অফিসার আলাউদ্দিন নাসিরের উদ্যোগে টেলিফোনে বলেছি, ‘শিগগির দেশে ফিরে আসুন।’
উপরিউক্ত ঘটনাবলি বিবৃত করার উদ্দেশ্য সেনা-সমর্থিত, আমার মতে সেনা-নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক নামধারী সরকারের আমলনামা পর্যালোচনায় দুই বছরের অনেক ঘটনা-অঘটনের বিস্তারিত পূর্ণ ব্যাখ্যা অবশ্যই জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদকে দিতে হবে। তাই দুই বছরে সাধিত ন্যায়ের কৃতিত্ব অথবা অন্যায়ের দায়, সব মহল থেকে মইন উ আহমেদের কাঁধেই চাপানো হচ্ছে। এই কারণে তাঁকে খোলাসা করে বলতে হবে তিন উদ্দিনের মিলিত শাসনকালে কেন কী ঘটেছিল। তিনি জানিয়েছেন, আবার একটি বই লিখবেন। সেই বইতে এক-এগারো-সম্পর্কীয় ন্যায়-অন্যায়ের সব তথ্য জানাবেন এমনটি আশা করতে পারি কী?
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.