কূটনীতি-কী বারতা মিলিবে আজ! by হুমায়ুন কবির

যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিকে আমরা বিশেষভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু শক্তির দিক রয়েছে। যেমন, একটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা। আরেকটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষার প্রসার। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার প্রসারে অগ্রগতিও বিশ্বসমাজে স্বীকৃত।


একটি জনবহুল দেশে চরম দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে_ এটাও বিশ্বসমাজ লক্ষ্য করছে। আমাদের এসব অর্জন ধরে রাখা ও বিকশিত করার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের তরফেও এ বার্তা বারবার দেওয়া হচ্ছে



২০১২ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা (যিনি ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জাপানের মহাসচিব এবং দেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ৪ ও ৫ মে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী (এক সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী) প্রণব মুখার্জি আসছেন আজ ৫ মে। তাদের দু'জনের দেখা হচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-বাংলাদেশ 'ত্রিকোণ সম্পর্ক' নিয়ে যাদের আগ্রহ, তারা এ নিয়ে নতুন জল্পনায় বসে যেতে পারেন। বাংলাদেশের জন্য দু'জনের সফরই ভিন্ন ভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সফরটিও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যদিও গণমাধ্যমে বিষয়টি তেমন বড় স্থান লাভ করেনি। এশিয়ার এ দেশটি অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের প্রধান সাহায্যদাতা। তারা স্বল্প হার সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয়। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে তাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়_ জাপানই একমাত্র ধনবান দেশ, যার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক চরম প্রতিকূলে। সেখান থেকে আমাদের আমদানি অনেক বেশি এবং রফতানি নামমাত্র। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সে বাংলাদেশের রফতানির তুলনায় আমদানি অনেক কম। এশিয়ার দুটি দেশ চীন ও ভারত। তাদের সঙ্গে বাণিজ্যচিত্রও সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা বাংলাদেশের প্রধান আমদানি উৎস, কিন্তু রফতানি সে তুলনায় নগণ্য।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জমানায় যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখা ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি তারা নতুন বন্ধু সন্ধানে মনোযোগী হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সখ্যকে আমরা এ প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে পারি। এ দেশটি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। তারপরও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক চুলি্ল স্থাপনে জ্বালানি সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গেও তারা সুসম্পর্ক বজায় রাখছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়ে থাকা দেশও হিসাবের বাইরে নেই। পররাষ্ট্রনীতির এ নীতিগত অবস্থান থেকেই হিলারি ক্লিনটন চীন ও ভারতের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে সফরের সময় বাংলাদেশকে সফরসূচিতে রেখেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে চায়। মিয়ানমারের প্রতি অধিক মনোযোগের এটা অন্যতম কারণ। বহু বছর ধরে রাজনৈতিক নিপীড়নের জন্য কুখ্যাত এ দেশটিতে হিলারি ক্লিনটন গিয়েছিলেন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। মিয়ানমারকে চীনের মোকাবেলায় নতুন স্ট্র্যাটেজিক মিত্র হিসেবে গণ্য করার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একই সঙ্গে সেখানে অং সান সু চিকে কেন্দ্র করে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণকেও যে ওয়াশিংটন গুরুত্ব দিচ্ছে_ তাতে সন্দেহ নেই। আরব বিশ্বে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশাকেও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনকে তারা স্বাগত জানায়। তাদের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিলে এখানকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে। পাকিস্তানেও যে গণতন্ত্রের ধারা জোরদার হচ্ছে, সেটাও তাদের মনোযোগে রয়েছে। পিপলস পার্টির বেসামরিক সরকার সেখানে চার বছরের বেশি টিকে রয়েছে এবং গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এমনটি 'বে-নজির'। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, কোনো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি সন্ত্রাসবাদের উত্থানের শঙ্কাও কমে আসবে। বাংলাদেশ তাদের কাছে আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী। চীন ও ভারতকে এ ক্ষেত্রে তারা গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার মনে করে। হিলারি ক্লিনটন চীন সফর করেই বাংলাদেশে আসছেন এবং এখান থেকে যাবেন ভারতে। ওবামা প্রশাসনের কাছে এই অর্থনৈতিক বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আগামী ৫ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি দ্বিগুণ করতে চাইছেন। আর এটা করা সম্ভব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করা গেলে। তারা ভালো করেই লক্ষ্য করছে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে যে অর্থনৈতিক মন্দা, তা থেকে ভারত ও চীনসহ আরও অনেক উন্নয়নশীল দেশ শুধু নিজেদের রক্ষা করতেই সক্ষম হচ্ছে না; প্রবৃদ্ধির ধারাও বজায় রাখতে পারছে। এশিয়ার অর্থনীতির কয়েকটি কেন্দ্র হচ্ছে চীন, ভারত, জাপান এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো। এসব দেশকে কেন্দ্র করেই আগামীতে নতুন এশিয়া জেগে উঠবে। আর ভৌগোলিকভাবে এসব দেশের মাঝখানে অবস্থান বাংলাদেশের, যেখানে একটি সম্ভাবনাময় গণতান্ত্রিক কাঠামো রয়েছে এবং অর্থনীতির চেহারাও মোটামুটি ভালো। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের সক্রিয় অংশীদার হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বার্থও রয়েছে। আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বৃহত্তর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সংযুক্ত হওয়ার তাগিদ প্রবল। যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকুক এবং বিদ্যমান বিরোধীয় ইস্যুগুলোর সন্তোষজনক নিষ্পত্তি ঘটুক_ সেটা তারা দেখতে চায়। হিলারি ক্লিনটন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে ৭ মে বৈঠক করবেন। এ সময়ে তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে তিনি বাংলাদেশের অনুকূলে কথা বলতে পারেন_ এমন খবর ভারতের পত্রিকাতেই দেখেছি। বাংলাদেশ ও চীন এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্রমে জোরদার হতে থাকবে_ এটাও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার মধ্যে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিকে আমরা বিশেষভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু শক্তির দিক রয়েছে। যেমন, একটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা। আরেকটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষার প্রসার। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার প্রসারে অগ্রগতিও বিশ্বসমাজে স্বীকৃত। একটি জনবহুল দেশে চরম দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে_ এটাও বিশ্বসমাজ লক্ষ্য করছে। আমাদের এসব অর্জন ধরে রাখা ও বিকশিত করার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের তরফেও এ বার্তা বারবার দেওয়া হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে উৎসাহী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রত্যাশা রফতানি বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে, তাতে এ ইস্যু গুরুত্ব পাচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও তাদের শীর্ষ এজেন্ডায় রাখছেন এ বিষয়টি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তাদের রফতানি বাড়াতে চাইছে। বিনিয়োগ বাড়াতেও তাদের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব। এটা নিশ্চিত হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি জোরদার হবে_ তাতে সন্দেহ নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা চাই। একই সঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোর প্রতি। আবার এই অবকাঠামো খাতেও রয়েছে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সম্ভাবনা।
নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়েও দুটি দেশ আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারে। বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং তা বিশ্বসমাজের দৃষ্টি এড়ায়নি। জেএমবি-হুজি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য যেভাবে হুমকি হয়ে উঠছিল, তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের অবদানও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে। এ ইস্যুতেও দুই দেশের সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাও সহযোগিতার একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। ঘন ঘন ঝড়-বন্যা আসায় পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের নিজস্ব একটি কাঠামো গড়ে উঠেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বর্ধিত অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেলে পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক ধরনের বিশেষ তহবিলের সহায়তা পাওয়ার জন্যও বাংলাদেশ চেষ্টা চালাতে পারে। যেমন, ফিড দি ফিউচার, গ্গ্নোবাল ফুড সিকিউরিটি, আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি। মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অর্জনের হিসাব (এমসিএ) থেকেও বাংলাদেশ সহায়তা চাইতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে সুশাসন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের জন্য সরকারের বিনিয়োগ। ২০০৪ সালে চালু এ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত ২৫টি দেশ সহায়তা পেয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, দুর্নীতি রোধ, পরিবেশ, স্যানিটেশন প্রভৃতি খাতে এ তহবিলের সহায়তা মেলে। বাংলাদেশ এ জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত কি পূরণ করায় মনোযোগী হবে_ এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
এ ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই ইতিবাচক কিছু অর্জন রয়েছে এবং তা তুলে ধরতে হবে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সক্রিয় সুশীল সমাজ_ এসব তারা স্বীকার করে। তবে তাদের প্রত্যাশার সীমা নিশ্চিতভাবেই আরও প্রসারিত এবং আমাদের তা উপেক্ষা করলে চলবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের কাছে তাদের নিজস্ব সিভিল সোসাইটির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এখানেও এ সমাজ যেন যথাযথ গুরুত্ব পায়_ তা তাদের মনোযোগে রয়েছে। এটাও মনে রাখা দরকার যে, ভাবাবেগ নয়; নিরেট অর্থনৈতিক বিবেচনা নিয়েই তারা চলতে অভ্যস্ত।
এটা ঠিক যে, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত মুুখ্য ভূমিকায় রয়েছে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো। একই সঙ্গে সুশীল সমাজের অংশগ্রহণও প্রত্যাশিত। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি নীতিনির্ধারণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে এবং অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও তাদের রয়েছে অভিন্ন প্রত্যাশা। বাংলাদেশেও এ ধরনের শক্তির উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই এ বিষয়টির প্রতি অধিক মনোযোগ প্রদান করতে হবে।
হিলারি ক্লিনটনের সফরসূচির প্রতি দৃষ্টি দিলেও তারা এ বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দেয়, সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যতটা সময় কথা বলবেন, তার চেয়ে বেশি সময় দেবেন অন্যদের। প্রথম থেকেই তিনি বিভিন্ন দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ কৌশল অনুসরণ করছেন। আমাদেরও তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদার সফরের কথা শুরুতে বলেছি। এবারের সফরে পদ্মা সেতু এবং মেট্রো রেল বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি হয়নি। পদ্মা সেতুতে সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার কথা বলেছেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে সহায়তার কথা বলেছেন। এসব বিষয়ে তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন এবং সরকারকে তা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। স্পষ্টতই আমরা যেভাবে পদ্মা সেতুর বিষয়টি দেখছি, বিশ্ব সেভাবে দেখছে না। এটাও মনে রাখতে হবে যে, জাপান একটি উন্নত দেশ এবং এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান তারা অনেক বছর টিকিয়ে রেখেছিল। ওই দেশে রফতানি বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে এবং আমাদের অবশ্যই তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। এ ধরনের সম্পদশালী একটি দেশে আমাদের রফতানি এখনও সীমিত রয়ে গেছে। কূটনৈতিক সম্পর্কও যে খুব মনোযোগ পেয়েছে_ তা বলা যাবে না। সে দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশ সফর করে গেলেন, তখন টোকিওতে আমাদের রাষ্ট্রদূতের পদটি রয়েছে শূন্য।
হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসার দিনেই আসছেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। তিনি ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। একই সঙ্গে দিলি্লর প্রধান দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তি মনমোহন সিং ও সোনিয়া গান্ধীর ঘনিষ্ঠ। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তার পেছনে প্রণব মুখার্জিরও অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি তিনি উদাসীন নন, বরং যথেষ্ট সহানুভূতিশীল_ এমন ধারণা রয়েছে ওয়াকিবহাল মহলে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের মধ্য দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র তাকে স্বাগত জানায়। তারা এ সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি চায়। তবে আমরা চাইব, এ সম্পর্ক যেন স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই বিকশিত হয়। এখানে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি যেন কোনোভাবেই না থাকে।
প্রণব মুখার্জির এ সফর প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিংয়ের সফরের পর থেকে তিস্তার পানি বণ্টন এবং আরও কিছু ইস্যুতে যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবারে ঘটবে_ এমন আশা কেউ পোষণ করে না। দিলি্ল বা কলকাতা থেকে এ ধরনের কোনো বার্তা এখন পর্যন্ত মিলছে না। যদি 'ঝুলে পড়ার' অবস্থা থেকে সম্পর্কে কিছুটা গতি আসে, সে চেষ্টাই হয়তো তিনি করবেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও অনুভূতি তিনি উপলব্ধি করতে পারলে শুধু দুই দেশের সম্পর্কই ভালো হবে না, বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিও দেওয়া যাবে ইতিবাচক বার্তা। তিনি নিশ্চয়ই সম্পর্ক উন্নয়নের পথের বাধাগুলো উপলদ্ধি করেন। এখন দেখা যাক, তা দূর করায় কী বার্তা রয়েছে তার কাছে।

হুমায়ুন কবির :যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
 

No comments

Powered by Blogger.