অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

একটা কথা আছে, সব সম্ভবের দেশ নাকি বাংলাদেশ। এখানে তাসলিমার মতো গৃহকর্মীদের মেরে জন্ডিসে মারা গেছে বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে বাউলদের দাড়ি-গোঁফ কেটে দেওয়ার পরও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। লিমনের পা কেটে ফেলার পরও পুলিশ মামলা গ্রহণ করে না।
এ রকম অসংখ্য ঘটনা আমাদের প্রতিনিয়ত দেখতে হয়। সাধারণের কীই-বা করার আছে। আর রাজনীতিবিদদের কথা কী বলব। তাঁদের অনেকেই মুখে বড় বড় কথা বলেন। কিন্তু তাঁদের কাজের মধ্যে কথার প্রতিফলন পাওয়া যায় না। এমনকি অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো সহজ কর্মটিও তাঁরা কম করেন। হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। লাভ-ক্ষতি তাঁদের কাছে প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েদের ইজ্জতও টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সম্প্র্রতি উত্তরাঞ্চলে আদিবাসী এক মেয়েকে ধর্ষণ করার পর ২০ হাজার টাকা দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করা হয়। মীমাংসা পর্বটি স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
গরিব ঘরের মেয়ে ছিল তাসলিমা। মা-বাবা এক হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে প্রতিবেশী একজনের ঢাকার বাসার কাজের জন্য প্রেরণ করেন। মাত্র ছয় মাসের মাথায় তাকে লাশ হয়ে ময়মনসিংহে ফিরে যেতে হলো। মা-বাবা জানতে পারলেন না তাঁদের মেয়ের অপরাধ কী ছিল। কোনো রোগে মারা গেলে তার পিঠে আঘাতের দাগ থাকার কথা নয়। কোথা থেকে এল আঘাতের দাগ? তাসলিমার মৃত্যু থেকে লাশ প্রেরণ পর্যন্ত পুরো ঘটনাটি একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক। তাকে মারার পর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে চার-পাঁচজন অ্যাম্বুলেন্সে উঠে কয়েকজন পর পর নেমে যাওয়া এবং সবশেষে গৃহকর্তার অফিসের পিয়নের মাধ্যমে মধ্যরাতে তাসলিমার মা-বাবার কাছে লাশ হস্তান্তরের চেষ্টা_পুরোটাই একটি নাটক। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা নারীর প্রতি সহিংসতার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করেছি; কিন্তু কেন যেন মনে হয় কঠোর আইন প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতার পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়নের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বিদ্যমান। কোনোক্রমেই আমরা আইনের বাস্তবায়ন করতে পারছি না। অপরাধীদের সাজা দেওয়া দূরের কথা, আইনের কাঠামোর মধ্যে তাদের নিয়ে আসা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। তাসলিমার ক্ষেত্রে রমনা থানা হত্যা মামলা গ্রহণ করেছে। কোনো কোনো মানবাধিকার সংগঠন কিছুদিন তাসলিমার মৃত্যু নিয়ে মানববন্ধন কিংবা সভা করবে। এখানেই শেষ। আমরা আশঙ্কায় আছি আর একজন তাসলিমা হত্যাকাণ্ডের। হয়তো এ সপ্তাহ কিংবা আগামী সপ্তাহেই আর একজন গৃহকর্মী তাসলিমার মৃত্যু হবে। আবারও একই ধরনের প্রক্রিয়া। এভাবেই চলতে থাকবে। সব ক্ষেত্রে অর্থ, বিত্ত ও পেশিশক্তির দাপট। আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? কোথায়?
একটি অপরাধের বিচার না হওয়া আর একটি অপরাধের জন্ম দেয়। কর্তৃপক্ষের মুখে আমরা প্রায়ই শুনি হত্যাকারী যত বড় ক্ষমতাবানই হোক তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের কাঠামোতে আনা হবে। কর্তৃপক্ষ বলবে কি এ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ কতজনকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে? দেরিতে হলেও র‌্যাব অবশ্যই স্বীকার করেছে, লিমন পরিস্থিতির শিকার। এ ক্ষেত্রে মিডিয়া অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। এ জন্য মিডিয়াকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কিন্তু কোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও পুলিশ মামলা নিচ্ছে না কেন? তাহলে কি লিমনের অবস্থাও আর ১০টি কেসের মতোই হবে?
যারা মানুষের হত্যা প্রতিরোধ করবে তাদের দ্বারাই যখন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন পরিস্থিতি কী হতে পারে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কতজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে? কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে, যিনি জোট সরকাদের সময় প্রচণ্ড লাঠিপেটার মাধ্যমে বয়স্ক লোকদেরও আহত করেছিলেন। এ রকম দু-চারটি কেস পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু সার্বিক চিত্র খুব বিবর্ণ।
আমাদের সমাজে ফাতোয়া প্রদানকারীদের টার্গেট সব সময় মহিলারা। পুরুষরা যতই অনৈতিক করুক না কেন তাদের ক্ষেত্রে ফতোয়া দেওয়া হয় কি? এ সমাজে ধর্ষণের মতো অন্যায় আচরণকে টাকার মাপকাঠিতে বিবেচনায় এনে শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া হয়। কেন ধর্ষকদের ফতোয়া দিয়ে দোররা মারা হয় না কিংবা ওই পরিবাকে একঘরে করে রাখা হয় না? একি শুধু মেয়েদের জন্য, ছেলেদের জন্য নয়! ধর্ষক। ধর্ষক যখন ২০ হাজার টাকা দিয়ে রেহাই পায় কিংবা ধর্ষণ করেও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারে তখন অন্যরাও এ রকম কুকর্ম করার জন্য উৎসাহী হবে। আর এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যখন স্থানীয় ক্ষমতাসীনরা যুক্ত থাকে তখন তাদের সাহস আরো বেড়ে যায়। সর্বোপরি মেয়েটি যখন সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী হয় তখন তো কথাই নেই। এ চিত্র তো কোনো অগ্রগামী সমাজের চিত্র নয়।
সমাজে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী গোষ্ঠী নারীনীতি, শিক্ষানীতি নিয়ে নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত। মহিলাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে সমাজে জারজ সন্তান বেড়ে যাবে বলে হুঙ্কার দিচ্ছে, কিন্তু যখন একজন গৃহকর্মীকে হত্যা করা হয়, মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়, তখন তাদের মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করতে দেখা যায় না। ধর্ষণের জন্য মেয়েদেরকেই দোষারোপ করা হয়। তাদের একটিই লক্ষ্য_মেয়েরা যেন সামনের দিকে এগোতে না পারে। আসুন, আমরা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি ওই সব মানুষের বিরুদ্ধে, যারা মানুষ হত্যা করে। আন্দোলন গড়ে তুলি তাদের বিরুদ্ধে, যারা হত্যা, ধর্ষণে মদদ জোগায়। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করি যে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী গোষ্ঠী সমাজকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.