কিছু বাস্তবতা, কিছু অসহায়ত্ব, কিছু আগ্রাসন by ডা. ওয়াহিদ নবী

বেশ কিছুদিন থেকে বিএনপির নেতারা মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করে আসছিলেন। এ দাবি গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে পর্যবেক্ষকরা বারবার উল্লেখ করলেও বিএনপির নেতারা বিরামহীন তাঁদের দাবির পুনরাবৃত্তি করছিলেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় খালেদা জিয়া এ বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা জনগণকে বিস্মিত করবে।


তিনি বলেছেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য দল প্রস্তুত নয়। মানুষ আশ্চর্য হবে এই ভেবে যে দলের নেতারা কি তবে মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করছিলেন তাঁদের নেত্রীর অজান্তে? এ বিষয় সম্পর্কে বেশ কিছুদিন ধরে দলীয় নেতারা প্রচারমাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন। অনেক পর্যবেক্ষক এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। অনেকে ভাববেন, তবে কি দলীয় নেত্রী চলমান ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নন? মনে হচ্ছে, তিনি কেবল শুনেছেন ব্যাপারটা। আর শুনেই তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে দলের প্রস্তুতি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য বাস্তবসম্মত। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে গেলে দলকে পুরোপুরি প্রস্তুত হতে হয়। অনেক রকমের প্রস্তুতির প্রয়োজন একটা দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য।
ইশতেহার প্রস্তুত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। গত নির্বাচনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ইশতেহার মানুষের মন আকর্ষণ করেছিল বেশি। কজেই উপযুক্ত লোকদের নিয়ে ইশতেহার কমিটি গঠন করা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ ব্যাপারে বিএনপি একেবারেই প্রস্তুত বলে মনে হয় না। নির্বাচনী প্রচারের সময় নেতারা যা বলবেন সেসব যেন পরস্পরবিরোধী না হয় সে জন্য নেতাদের মধ্যে বোঝাপড়ার মনোভাব সৃষ্টি করা প্রয়োজন। প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থী একজনের বেশি যেন না হন এ জন্য শুধু নেতৃত্বের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ নয়, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরাই বোঝাবেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের যে দলে ঐক্য না থাকলে দলের ক্ষতি এবং সে ক্ষেত্রে কেউ তাঁদের কাজ আশা করতে পারেন না। দলের প্রভাব যতই থাক আর কেন্দ্রীয় নেতাদের 'ক্যারিশমা' যতই থাকুক আর প্রার্থী যতই ধনাঢ্য হোন স্থানীয় কর্মীদের ভূমিকা ফেলে দেওয়ার নয়। এসব করতে গেলে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে সংলাপ প্রয়োজন। আর এ জন্য প্রয়োজন সময় ও প্রস্তুতি। নির্বাচন করার মতো প্রস্তুতি যে বিএনপির নেই এটা বাস্তবসম্মতভাবেই খালেদা জিয়া অনুমান করেছেন। বেশ উষ্মার সঙ্গেই তিনি বলেছেন, 'ঘরে বসে আঙুল চুষলেই হবে না।'
খালেদা জিয়া ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, বিরোধী দলে থেকে টাকা সংগ্রহ করা খুব কঠিন। অনেক কষ্টে সংগৃহীত এই টাকা দিয়ে লিফলেট ছাপানো হলে দলের কর্মীরা তা ঠিকমতো বিলি করে না। মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি ক্ষমতায় থাকলে টাকা জোগাড় করা খুব সহজ? এমনকি লিফলেট ছাপানোর টাকা জোগাড় করা ক্ষমতায় থাকলেই সহজ। এ রকম ধারণা কর্মীরা অতীতে পেয়ে থাকলে লিফলেট ঠিকমতো বিলি করবে কেন? ক্ষমতায় থাকলে শুধু লিফলেটের টাকা কেন, সব কিছুর জন্য টাকা জোগাড় করা অতিসহজ_এটাই হয়তো কর্মীরা বুঝেছে।
কর্মীরা তাঁকে বলেছে, সরকারি দলের লোকরা লিফলেট ছিঁড়ে ফেলে। তারা আরো বলেছে, সরকারি দলের লোকরা তাদের মারধর করে। খালেদা জিয়া সহজ সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'আপনারা ছিঁড়তে পারেন না?' তিনি আরো বলেছেন, 'আপনারা মারতে পারেন না?' হায় রে কর্মীর দল! সেজেগুঁজে কেন্দ্রীয় অফিসে বসে থাকা নেতারা কি বুঝবেন কর্মীদের সমস্যা, বিশেষ করে বিরোধী দলে থাকা কর্মীদের অবস্থা? দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ইউনিফর্ম পরা লোকরাই প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেটাত। ওরা শুধু কাছে থাকত। এখন উল্টোটা হচ্ছে। নেতারা কেন্দ্রীয় অফিসে থাকেন। তাঁদের সন্তানরা বিদেশে থাকেন। কর্মীরা আর মার খেতে চাচ্ছে না। দলের নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা প্রস্তুত করতে বলেছেন খালেদা জিয়া। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় না হলেই হয়। তবু কোনো কোনো কর্মী বাস পোড়াতে যায়, ভাঙচুর করতে যায়। এদের ভবিষ্যৎ কী? দয়া করে এদের আর জেনেশুনে বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন না।
খালেদা জিয়া দলের নেতাদের উদ্দেশ করে বলেছেন, 'যতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারেন ততটকু বলবেন। আমাকে বিভ্রান্ত করে কর্মসূচি দেবেন না। এতে দলের ক্ষতি হয়।' দেরিতে হলেও তিনি বুঝতে পেরেছেন, দলের নেতারা তাঁকে ভুল তথ্য দিয়ে জনবিরোধী কর্মসূচি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এতে দলের ক্ষতি হয়। এটা সত্য কথা। দলের সভা, তাই তিনি দলের ক্ষতির কথা বলেছেন। কিন্তু এতে আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশ ও জাতি। প্রতিদিনের হরতালে দেশের ক্ষতি হয় তিন থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়। ভোগান্তির শেষ থাকে না সাধারণ মানুষের। মানুষ বোঝে, আপনারা পেছনে থেকে আমিনী সাহেবকে লাগিয়েছিলেন এই কাজে, যিনি মুয়াবিয়ার স্টাইলে পবিত্র কোরআন মাদ্রাসার ছাত্রদের গলায় ঝুলিয়ে মিছিলে পাঠিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার কাছে আবেদন, তিনি যদি সত্যিই বুঝে থাকেন যে তাঁকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল, তবে তিনি যেন জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করে এই প্রতিশ্রুতি দেন যে এ ধরনের জনবিরোধী কার্যসূচি আর দেওয়া হবে না।
তিনি আরো বলেছেন, 'আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। দেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের।' যদি আপনার দল মুক্তিযুদ্ধ করেছে বলে দাবি করেন এবং যদি আপনি দাবি করেন যে 'দেশ রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের', তবে অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সংস্রব ত্যাগ করুন।
আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে ৩৬ বছর আগে তৈরি একটি দল এতই অসংগঠিত! এর অবশ্য কারণ আছে। এই কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দল সংগঠনে মনোনিবেশ করা আশু প্রয়োজন নেতাদের। এ দলটি কোনো রাজনীতিবিদ প্রতিষ্ঠা করেননি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা বরং রাজনীতিবিদদের জীবন সমস্যাসংকুল করে তুলতে চেয়েছিলেন। এই দলে যাঁরা এসে জুটেছিলেন তাঁরা কোনো ইতিবাচক কারণে তা করেননি। এই দলে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের কেউ ছিলেন ন্যাপ থেকে আসা, যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলতেন। অনেকে মুসলিম লীগ থেকে এসেছিলেন, যাঁরা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী দক্ষিণপন্থী। আর এসেছিলেন সামরিক ও অসামরিক অবসরপ্রাপ্তরা। কিছু লোক এসে জুটেছিলেন রাজনীতির মাধ্যমে বিখ্যাত হওয়ার জন্য, যাঁদের রাজনৈতিক কোনো পটভূমি ছিল না। এদের একসঙ্গে অগণতান্ত্রিক স্টাইলের দাপট। তাঁর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগবিরোধিতা আর ভারতবিরোধিতা সাহায্য করেছিল বিভিন্ন ঘাটের এসব মানুষকে একসঙ্গে রাখতে। কিন্তু এ পন্থা আর কত দিন চলবে?
দলের প্রতিষ্ঠাতা 'স্বাধীনতার ঘোষক' ছিলেন। এ কথা ঠিক নয়। জাতির স্বীকৃত নেতা ছাড়া স্বাধীনতার ঘোষণা কেউ দিতে পারেন না। তাঁর সাধুতার কথা দলের একটি প্রধান মূলধন। কিন্তু কিছুদিন ধরে কিছু কথা আলোচিত হয়েছে, যার উত্তর বিএনপি নেতাদের দিতে হবে জনগণকে। কলামিস্ট মাহবুবুর রশীদ লিখেছিলেন, তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রসচিব সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে ডিসিদের কাছে টাকা পাঠানো হয়েছিল নির্বাচনের ফলাফল সপক্ষে আনার জন্য। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, জিয়াউর রহমানের নির্দেশ ছিল প্রতিটি মন্ত্রীর প্রতি তাঁকে মাসে তিন লাখ টাকা দিতে। অভিযোগগুলো গুরুতর। কোনো উত্তর না পেলে লোকে এগুলোকে সত্য বলে মনে করবে। এ ছাড়া মুজিব হত্যা ও তাহের হত্যার ব্যাপারে তাঁর হাত ছিল বলে আদালতে আলোচিত হয়েছে।
আসলে নেতিবাচক বক্তব্য ও কাজ বাদ দিয়ে ইতিবাচক কর্মসূচি দিন। কর্মীদের উৎসাহ বাড়বে। জনগণ উপকৃত হবে। এমনটিই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.