গন্তব্য ঢাকা-যদি সব না ভেসে যেত by সিদরাতুল সিনড্রেলা

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থান পুরান ঢাকা। সেখানেই অবস্থিত বাংলাদেশের একটি বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। মূল ফটক ধরে এগোলে প্রথমেই চোখে পড়বে উন্নত ধরনের নতুন ভবন। এই ভবনের সামনেই ভাস্কর রাসার অনবদ্য সৃষ্টি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। তার পরেই আমাদের যাবতীয় শ্রেণীকক্ষ। এই প্রতিষ্ঠানেরই একজন শিক্ষার্থী আমি।


ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য বের হচ্ছি। হঠাত্ এক বন্ধু চিত্কার করে উঠল, ‘এই যা।’ ‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করলাম সমস্বরে। জবাব দিল, ‘কী আবার। দেখছিস না, স্যান্ডেলটার হাল।’ অগত্যা ছুটলাম পাদুকাজোড়ার বিশ্বকর্মের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নামক ভাস্কর্যের সামনে বসে রোজ সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চলে সবাইকে রক্ষার কাজ। আর যিনি এই হঠাত্ লজ্জা পাওয়ার হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করেন, তিনি হলেন ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাশ। পেশায় তিনি একজন মুচি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
আজ থেকে ৩৫ বছর আগে ভৈরব থেকে ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাশ ঢাকায় এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে। তখন তাঁর বয়স ছিল ২০। তখন থেকে দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই কাজ করে চলেছেন। যদিও তাঁর বাবা এই পেশায় ছিলেন না। তিনি বিভিন্ন কাজ করতেন, এমনকি গান-বাজনাও করতেন। ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাশও পারেন গান-বাজনা। এখন অবশ্য তা আর করা হয়ে ওঠে না।
রোজ সকালে বাসে নবাবগঞ্জ থেকে আসেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিকেল চারটা পর্যন্ত এখানেই করে চলেন আপন কর্ম। দুপুরে খাবারটা স্ত্রীই দিয়ে দেন রান্না করে। দুটি মেয়ে আর একটি ছেলের জনক তিনি। টাকা-পয়সার অভাবে তাদের তেমন পড়াশোনা করাতে পারেননি তিনি। মেয়ে দুটির বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটি পড়ছে পঞ্চম শ্রেণীতে।
যখন ছিল তখন কিছুরই অভাব ছিল না। চারপাশে সবাই ছিল। বাবা-মা ছিলেন। বাবা মারা গেছেন অনেক দিন হলো। মা মারা গেছেন ঢাকায় আসার পর। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৫ বছর। ‘সর্বনাশা মেঘনা আমাগো সব নিছে। বাড়ি-ঘর, জমি-জায়গা সব। কত্ত মানুষ যে মরসে। রাইতে সকলে ঘুমাইছে, সকালে উইঠ্যা দ্যাহে কেউ নাই, কিছু নাই। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আমাগো কেউ মরে নাই, তয় চেনাজানা অনেকে মরসে। সবাই শুধু কানতাছে। দ্যাখলে এত দুঃখ পাইতাম।’ সর্বনাশা মেঘনার তাণ্ডব রাতের কথা চিন্তা করে মুখ কুঁচকান ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাশ। আপনি কি পড়াশোনা করেছেন? ‘নাহ’, মুখ খোলেন ব্রজেন্দ্র দাশ। কষ্টের মধ্যেই তিনি বলেন, ‘সুযোগ পাইলাম কই। এখানে সকলে পড়তাছে দেইখ্যা অনেক আনন্দ লাগে। পড়ালেহা করলে ভালো হইত। পোলাডারে পড়ালেহা করাইবার ইচ্ছা আছে। কিন্তু আমার কষ্ট দেখে তো হেই কয়, পড়ালেহা ছাইড়া আমার লগে কাম করব। যদি পারি তয় অরে পড়াইতে চাই। পোলা পড়ালেহা কইরা অনেক বড় চাকরি করব, এইটা তো সব বাপ-মাই চায়।’ শত কষ্টের মধ্যে এতটুকু আশা মনে পুরে রাখেন ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাশ।
দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় হয় তাঁর। এর মধ্যে থেকেই বহন করতে হয় যাবতীয় খরচ। ছেলের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে বা স্ত্রীর ভরণপোষণ সব তো এ টাকাতেই চালাতে হয়। ‘গ্রামে থাকলে কত সুবিধা হতো। নিজেগো বাড়ি, খ্যাতের সবজি, নদীর মাছ দিয়া খুব সুন্দর জীবন যাইত। ঢাকায় তো সবই কিন্যা খাইতে হয়।’ গ্রামে আপনার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই? ‘নাই। সবাই ছোটবেলায় একলগে থাকছি। অহন তো এরা বড় বড় চাকরি করে। অনেক টাকা-পয়সা এদের। তয় ছোটবেলায় এগো লগে কত মজা করছি।’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন থেকেই আছেন ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাশ। তখন বসার জায়গা নিয়ে খুব কষ্ট হতো। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিনোদ স্যার তাঁকে স্থান ঠিক করে দেন এবং এখানেই রোজ বসতে বলেন। তখন থেকেই তিনি এ স্থানে বসে নিজের কাজ করে চলেন।
ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাশের দৃষ্টিতে আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি হতো আরও বেশি। এখন একটু কম হয়। তখন যারা মারামারি করত, তারা তাঁর লিহি, টাটনী ইত্যাদি নিয়ে চলে যেত। (লিহি, টাটনী হলো তাঁর ব্যবহূত যন্ত্রপাতি)। পরে বিনোদ স্যারই তাঁকে বলেন, মারামারির সময় এসব জিনিস সামলে নিয়ে দূরে সরে যেতে। যাতে এসব জিনিস দিয়ে একজন ছাত্র অন্য আরেকজন ছাত্রকে আঘাত করতে না পারে।
‘গ্রামে অহন করনের মতো কিছু নাই দেইখ্যা ঢাকায় আসি। যদি মেঘনায় সব না ভাইস্যা যাইত তয় হয়তো গ্রামেই থাকতাম। সকলরে নিয়া সুখেই রইতাম। যদি অহনও সুযোগ-সুবিধা করতে পারি তয় গ্রামে যামুগা। আমার বউ আর পোলা তো গ্রামের যাওনের লাইগ্যা পাগল হইয়া রইছে।’ ভবিষ্যতের আশায় আবার কাজ শুরু করেন তিনি। আমরা সরে আসি আমাদের ভবিষ্যতের পথে।

No comments

Powered by Blogger.