জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-সবাই অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকবে না by সানজিদা মুবাশ্শারা

জাতির বিবেকের কাছে আমি প্রশ্ন রাখতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নামধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জানানোর ভাষা কি আপনাদের আছে? কেবল ঘৃণাই কি এই তাদের প্রত্যাখ্যান করার জন্য যথেষ্ট? চোখ বন্ধ করে থাকলে কিংবা অন্ধ হলেও তো প্রলয় বন্ধ থাকে না


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোঃ আলী আকন্দ গত ২৫ এপ্রিল একই বিভাগের কতিপয় শিক্ষকের হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। অধ্যাপক আকন্দ বর্তমানে সাভারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অধ্যাপক আকন্দ আমার স্বামী এবং আমি এই বিভাগেরই একজন শিক্ষক। আমার স্বামীর ওপর যে বর্বরোচিত হামলা করা হয়েছে তার বর্ণনা যে কোনো সভ্য মানুষকেই মর্মাহত করবে। যারা এই পাশবিক কাজে অংশ নিয়ে বনের পশুদেরও লজ্জা দিয়েছেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে তাদের প্রায় সবাই আমার শিক্ষক ও সহকর্মী। নির্যাতিত শিক্ষকের স্ত্রী হিসেবে আমি বিপন্ন ও বিপর্যস্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি বিস্মিত ও লজ্জিত। এ ঘটনা যখন ঘটে আমি নিজেই তখন বিভাগে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু আমার শিক্ষক ও সহকর্মীদের ওপর আস্থা রেখে তাকে উদ্ধারের জন্য উল্লেখযোগ্য তৎপরতা দেখাইনি। বিভাগের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো আমি নিজেও সে সময় বিভাগে বন্দি ছিলাম। ফলে শিক্ষক সমিতির সম্মানিত সভাপতিকে ফোন করে সভাপতির কক্ষে অবরুদ্ধ অধ্যাপক আকন্দকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করি। তিনি উপস্থিত হয়ে আমাকে এবং আমার স্বামীকে উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তিনি উপস্থিত হওয়া কিংবা মুক্তির ব্যবস্থা করার আগেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনাটি ঘটে যায়।
বিভাগের সভাপতিকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত কতিপয় শিক্ষক সভাপতির কক্ষে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন এবং অধ্যাপক আকন্দকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ দেন। তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকেন। আমি কী করব বুঝতে না পেরে আমার গবেষণাগারে অবস্থান নিই। একজন কর্মকর্তার কাছে খবর পেয়ে বিভাগের কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষকসহ আমি সভাপতির কক্ষে প্রবেশের চেষ্টা করি কিন্তু ভেতর থেকে দরজা না খোলায় আমরা প্রবেশ করতে ব্যর্থ হই। কক্ষের ভেতর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে সভাপতি নিজেই দরজা খুলে বাইরে চলে আসেন। সে সময় বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সাংবাদিকদের সামনেই তাকে লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেন এবং নির্বিচারে কিলঘুষি ও লাথি মারতে থাকেন। সে সময় বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষক ও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী অধ্যাপক আকন্দের গায়ে শুয়ে পড়ে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন এবং তারাও আঘাতপ্রাপ্ত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সাভারের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখনও তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে শিক্ষিত পশুদের ঘৃণ্য আচরণের বীভৎস স্মৃতি স্মরণ করে বারবার শিউরে উঠছেন।
ঘটনার দিন রাতেই পুলিশ দুই দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করলেও শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের হস্তক্ষেপে তারা মুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ষড়যন্ত্রকারী ও স্বার্থান্বেষী একটি মহল ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টায় বিবেকের আহ্বানকে অবলীলায় উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবমূর্তিকে আজ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেদের সম্মান ও মর্যাদা হারিয়েছেন, এমনকি স্বপ্রণোদিতভাবে বিভাগের শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত শিক্ষকের পক্ষে অবস্থান নিলে শিক্ষার্থীদেরও নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে নিপীড়ক শিক্ষকদের বিচার চেয়ে স্মারকলিপি দিলে তাতে অধ্যাপক আকন্দকে মারধরকারী শিক্ষকদের নাম উল্লেখ না করতে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ও বিবেকবান সাধারণ শিক্ষকরা এ ঘটনায় মর্মাহত হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং শিক্ষক নামধারী দুর্বৃত্তদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
আমি এই পাশবিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত শিক্ষকদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে অবদান রাখলেই দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ রকমের পাশবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। যারা আমার স্বামী অধ্যাপক আকন্দ, আমি ও আমার পরিবার-পরিজনের মানসম্মান ভূলুণ্ঠিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিধি মোতাবেক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমি প্রশাসনের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাই। জাতির বিবেকের কাছে আমি প্রশ্ন রাখতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নামধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জানানোর ভাষা কি আপনাদের আছে? কেবল ঘৃণাই কি এই তাদের প্রত্যাখ্যান করার জন্য যথেষ্ট? চোখ বন্ধ করে থাকলে কিংবা অন্ধ হলেও তো প্রলয় বন্ধ থাকে না। সেই প্রলয়ে আমার মতোই যে কারও সবকিছু তছনছ হয়ে যেতে পারে। এই দুর্দিনে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, সুশীল সমাজ, প্রচারমাধ্যমসহ এ দেশের সচেতন মহলকে আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি সবার প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই।

ড. সানজিদা মুবাশ্শারা : সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.