জাবি প্রসঙ্গ : বাস্তবতা মেনে স্থিতিশীল করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে by ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রায় চার মাস আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একাংশ একটি নৈতিক অবস্থান থেকে প্রশাসনের কাছে সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও তাঁর পরামর্শকরা যদি একরোখা দাম্ভিক আচরণ না করে মানবিকভাবে সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসতেন তবে আজ ভিসি অপসারণের এক দফা দাবিতে ক্যাম্পাস এতটা উন্মাতাল হতো না।


ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের হাতে মেধাবী ছাত্র জুবায়ের নিহত হলে শিক্ষকের দায়বোধ থেকে বিভিন্ন দল-মতের শিক্ষকদের একাংশ প্রশাসনের কাছে বিচার দাবি করেন। বিষয়টি আপাত সরল মনে হলেও ততটা সরল ছিল না। কারণ, প্রচারিত ছিল ক্যাম্পাসের এই প্রতাপশালী ছাত্রলীগ নামধারীরা ভিসির বিশেষ মদদপুষ্ট। চ্যান্সেলর কর্তৃক উপাচার্য নিযুক্ত হয়ে দূরদর্শী পরিকল্পনায় ভিসি ছাত্রলীগকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিলেন। ভিসির পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গ্রুপ অন্য পক্ষকে পিটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া করে। এ পর্বেই ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার মতো অমানবিক বীভৎস ঘটনাগুলো ঘটে। আর এসব প্রেক্ষাপট থাকার কারণেই শিক্ষকদের ধারণা ছিল জুবায়ের হত্যাকারীদের বিচার আন্দোলনের চাপ ছাড়া এই ভিসির কাছ থেকে আদায় করা যাবে না। ইতিমধ্যে সব ক্ষেত্রে ভিসির একনায়কতান্ত্রিক আচরণ ছাত্র-শিক্ষক উভয়কে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। দুই শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ইতিমধ্যে তিনি নিজেকে বেশ শক্তিশালী ভাবতে থাকেন। চাপের মুখে ভিসি জুবায়ের হত্যার আংশিক বিচার সম্পন্ন করলেন। কিন্তু সন্তুষ্ট না হয়ে শিক্ষক-ছাত্ররা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করলেন। এ পর্যায়েও আলোচনা করে সমাধানের উপায় ছিল। কিন্তু ভিসি আন্তরিকতা দেখালেন না। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা একসময় প্রশাসন ভবনের সামনে 'উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চ' তৈরি করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। আন্দোলন চলাকালীন ভিসি প্রশাসন ভবনে না এসে নিজ বাসভবনে অফিস করতে থাকেন। ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।
শিক্ষক আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ নামধারীদের মহড়া অনেক শিক্ষককেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিবৃতি দিয়ে জানায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোনো কমিটি নেই। ছাত্রলীগ নামধারীদের নিজ দলীয় কর্মী বলে অস্বীকার করে। এ কারণেই ভিসির প্রশ্রয় পাওয়া এই পেটোয়া বাহিনী ক্যাম্পাসে 'ভিসি লীগ' নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এই ছাত্রলীগের অপব্যবহার এবং শিক্ষক আন্দোলন দমনের অপকৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে ভিসি পরিস্থিতি জটিল করে তুললেন।
২৫ এপ্রিল একটি বিশেষ নাটক মঞ্চস্থ হলো উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে। এই বিভাগের সভাপতি এককালের বিএনপি নেতা এবং বিএনপি প্রশাসনের আমলের প্রক্টর অধুনা ভিসির সমর্থক নব্য আওয়ামী লীগার। বিভাগীয় নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে বেশ কয়েকজন শিক্ষক তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন। এই শিক্ষকদের অধিকাংশই ভিসিবিরোধী শিক্ষক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত। ২৫ এপ্রিল সভাপতির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের জমায়েত হওয়ার কথা ছিল। বিভাগীয় শিক্ষকদের অনেকেই মনে করেন এই অবস্থাটিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা ছিল ভিসির। তাই সভাপতি আগেভাগেই একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিককে খবর দিয়ে রেখেছিলেন। বিকেলে সভাপতিবিরোধী শিক্ষকদের কয়েকজন তাঁর কাছে এলে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের উভয় পক্ষ লাঞ্ছনাকারী হিসেবে পরস্পরকে দায়ী করেন। প্রচার করা হয় সহকর্মীদের হাতে সভাপতি আহত হয়েছেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আহত সভাপতি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে উল্লিখিত টিভি চ্যানেলের গাড়িতে করে সোজা উপাচার্য ভবনে চলে আসেন। সেখানে কিছু সময় কাটানোর পর তাঁকে ভর্তি করা হয় সাভারের একটি ক্লিনিকে। এদিকে সভাপতি কর্তৃক লাঞ্ছিত বলে সন্ধ্যায় বিভাগের দুজন শিক্ষক ভিসি বরাবর অভিযোগ করেন। এ পর্যায়ে অভিভাবক হিসেবে মিটিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল ভিসির। তিনি সে পথে গেলেন না। রেজিস্ট্রারকে পাঠানো হলো ক্লিনিকে। তাঁর সঙ্গে পরামর্শক্রমে সভাপতি দুই সহকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করলেন। অভিযুক্ত শিক্ষক নুহ আলমের বাসায় মাঝরাতে চড়াও হলো পুলিশ। বিনা ওয়ারেন্টে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। অন্য অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক তালিম হোসেনের দরজা খুলতে বিলম্ব হওয়ায় পুলিশ বুট ও রাইফেলের বাঁটের আঘাতে দরজার সিটকিনি ভেঙে অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে মাঝরাতেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক জড়ো হন ভিসি ভবনের বাইরে। শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে ভিসি জানান, গ্রেপ্তারের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। অথচ থানার পুলিশ জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমোদনেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই নির্জলা মিথ্যা শিক্ষকদের ক্ষুব্ধ করে। তাঁরা বাসভবনে অবরুদ্ধ করে ফেলেন ভিসিকে। সেই সঙ্গে ভিসি পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষিত হয়। ভিসি শিক্ষক আন্দোলন দুর্বল করতে এবং ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতে জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন ছুটি ২৫ দিন এগিয়ে আনেন। এতেও ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হন। সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ঘোষিত ১১ দফা দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন নতুন করে দানা বাঁধে।
২৭ এপ্রিল ভিসির বাড়ির সামনে অবস্থানরত শিক্ষকদের কাছে খবর আসে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও টিএসসির সামনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে। শিক্ষক ও সংবাদকর্মীরা ছুটে যান। উদ্ধার করেন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি কলি মাহমুদসহ ১০ জন সাংস্কৃতিককর্মী ছাত্রদের। তাঁদের কয়েকজনের অবস্থা ছিল বেশ আশঙ্কাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাত-পা ভাঙা ক্ষত-বিক্ষত শিক্ষার্থীদের দ্রুত মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়। এই ঘটনায় আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। সাংস্কৃতিক জোটের ছাত্রছাত্রীরা ফুঁসে ওঠেন। তাঁরা তাৎক্ষণিক মিছিল বের করেন। তাঁদের ১১ দফা দাবি ভিসি পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। সাংস্কৃতিককর্মীরা ভিসির বাসভবনের কাছে এসে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদী স্লোগান ও সংগীত পরিবেশন করতে থাকেন।
বিতর্কিত ও সাজানো ঘটনায় দ্রুত মামলা করে শিক্ষকদের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করানো হলেও হামলাকারী ছাত্রলীগ ক্যাডাররা পুলিশের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সামনে মিছিল করতে থাকে এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-শিক্ষকদের মুখোমুখি অবস্থান নেয়। সাংস্কৃতিক জোটের ছাত্রছাত্রীরা আবারও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। এ সময় ছাত্রলীগ নামধারীরা এগিয়ে আসতে থাকে এবং সেখানে থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা তখন দ্রুত ছুটে এসে শিক্ষার্থীদের আড়াল করে মানবঢাল রচনা করেন। এ অবস্থায় আক্রমণ করতে না পারায় ছাত্রলীগ নামধারীরা অন্ধকারে অকথ্য গালাগাল করতে থাকে এবং শিক্ষকদের ওপর চোরাগোপ্তা ঢিল ছুড়তে থাকে। এতে কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। ছবি তুলতে গেলে একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক প্রহারের শিকার হন। ১৫ মিনিট পর বিদ্যুৎ এলে আক্রমণ জমাতে না পেরে ছাত্রলীগের মিছিল স্থান ত্যাগ করে। পুলিশও আগের অবস্থানে ফিরে আসে।
এই ঘটনা ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে ক্ষুব্ধ করে। পরদিন ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। অভিন্ন দাবিতে ছাত্র-শিক্ষক একমঞ্চে চলে আসেন। ১ এপ্রিল ছাত্ররা ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। পরে এ অনশনে শিক্ষকরাও যোগ দেন।
আন্দোলনের এই অবস্থায় এখন ভিসির পদত্যাগ ছাড়া আন্দোলন থেকে সরে আসার আর কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ভিত্তিতে শিক্ষকরা আপাতত তাঁদের আন্দোলন বন্ধ রেখেছেন। যদি এর মধ্যে ভিসি পদত্যাগ না করেন তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিন থেকেই আবার আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটবে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিস্থিতি আবার অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হবে। তাই আমাদের নিবেদন বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে এখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীলতার অবসান ঘটাতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

লেখক : অধ্যাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.