'আমারও কথা ছিল হাতিয়ার হাতে তোমার পাশে দাঁড়াবার' by রবীন আহসান

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চে গুয়েভারাকে নিয়ে লেখা কবিতার একটি লাইন_ 'চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়। আমারও কথা ছিল হাতিয়ার হাতে তোমার পাশে দাঁড়াবার।' এই কবিতা শুনতে শুনতে, এই কবিতা পড়তে পড়তে আশির দশকের শেষ দিকে চে গুয়েভারার একটা চিত্র মনের ভেতর আঁকা হয়ে গিয়েছিল।


তখন তাকে নিয়ে বাংলায় কোনো বই পাওয়া যেত না। চের লেখা কোনো বইপত্র অনুবাদ হয়েছিল কি-না আমার জানা নেই। আমরা যে সময় চে গুয়েভারাকে নিয়ে অল্প কিছু পড়তে শুরু করি সেই নব্বই দশকের শুরুতেই তখন বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ধস নামতে শুরু করে। ইউরোপে একের পর এক দেশ সমাজতন্ত্রের দরজা বন্ধ করে পুঁজিবাদী রাস্তায় দৌড় দেয়। টিকে থাকে পৃথিবীর একটি দেশ, পৃথিবীর একটি দ্বীপ। কিউবা, লাতিন আমেরিকার এ দেশটিই আমাদের স্বপ্নভূমি। কিউবান বিপ্লবের মহানায়ক গেরিলা যোদ্ধা, চিকিৎসক, বিপ্লবী আর্নেস্টো চে গুয়েভারার আজ ৮৪তম জন্মদিন।
১৯২৮ সালে ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোসারিওতে আর্নেস্টো গুয়েভারা সেরনা জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন মুক্তমনের অধিকারী। ধর্মীয় অনুশাসন মানতেন না। আর মা ছিলেন শতভাগ মার্কসবাদী সংগঠক। মেহনতি, নির্যাতিত মানুষকে ভালোবাসতে শেখা পরিবারের মধ্য দিয়ে। চে নামটা মা-বাবার দেওয়া নাম নয়, আর্নেস্টো চে গুয়েভারা ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবী অভিযানে যোগ দেন ১৯৫৫ সালে। সহযোদ্ধারাই তাকে চে গুয়েভারা নাম দেন। আর্জেন্টিনায় আদর করে ডাকার শব্দ চে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী, লুটেরা, ধনিক শ্রেণীর আতঙ্কের নাম 'চে' আর মেহনতি, শ্রমজীবী, সংগ্রামী মানুষের বন্ধু চের ছিল বর্ণাঢ্য জীবন। তিনি তার সেই জীবনের কিছু অংশ 'মোটরসাইকেল ডায়েরি', 'বলিভিয়ার ডায়েরি' ও 'ডাক দিয়ে যাই' নামক তিনটি গ্রন্থে লিখেছেন। পেশায় ডাক্তার, শৌখিন ফটোগ্রাফার এই আর্নেস্টো চে গুয়েভারা। তার লেখা 'মোটরসাইকেল ডায়েরি'তে আমরা দেখতে পাই অস্থির, স্বপ্নময়ী, রোমান্টিক চে গুয়েভারাকে। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে খনি মালিকদের নির্যাতন, নিপীড়িত শ্রমিকদের প্রতি ধীরে ধীরে একাত্ম হয়ে ওঠেন তিনি। তার প্রধান স্বপ্ন লাতিন আমেরিকাকে স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলমুক্ত করা। এক পর্যায়ে মাত্র ১৭ বিপ্লবী, চে ও ফিদেল মিলে সংগঠিত হয়ে টানা তিন বছর গেরিলা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করেন। বিপ্লবী সরকার ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ কিউবার স্বাধীনতা যুদ্ধে চের অবদানের জন্য তাকে কিউবার নাগরিকত্ব দেয়। প্রথমে চে গুয়েভারাকে কিউবান ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করা হয়। চে তার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি দিয়ে কিউবান রিজার্ভ গোপনে সুইস ব্যাংকে পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিণত করেন। এর অল্প কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্র কিউবান রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করে। চের বুদ্ধির জোরে সে যাত্রায় কিউবা অর্থনৈতিকভাবে বেঁচে যায়। চে গুয়েভারাকে কিউবার শিল্পমন্ত্রী পদ দেওয়া হয়।
চে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ইউরোপ, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, চীন ও অন্যান্য দেশ ঘুরে কিউবায় শিল্প গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এবং সফল হন। কিন্তু যার চোখ, মন পড়ে আছে সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করার জন্য তার কিউবার শিল্পমন্ত্রী থাকাটা বেশিদিন স্থায়ী থাকে না। বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে কথা বলেই কিউবার কয়েক কমরেডকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে বলিভিয়ায় আসেন চে গুয়েভারা। বলিভিয়ায় মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে শ্রমজীবী, নিপীড়িত মানুষের সরকার গঠনের প্রস্তুতি নেন চে গুয়েভারা। বলিভিয়ার জঙ্গলে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে, মশার কামড়সহ অসংখ্য বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় সহ্য করে চে তার গেরিলা বাহিনীকে তৈরি করেন। কিন্তু বলিভিয়ান জনগণের অসহযোগিতা এবং বলিভিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতার কারণে চের বিপ্লব অসম্ভব হয়ে ওঠে।
৮ অক্টোবর ১৯৬৭ সালে চে গুয়েভারা ইউনিটের অবশিষ্ট ১৭ গেরিলা যোদ্ধা বলিভিয়ার সেনা দলের কাছে আটক হন। এ যুদ্ধে চে গুয়েভারা গুরুতর আহত হন। ৯ অক্টোবর ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ার বেরিয়েদোস সরকার ওয়াশিংটনের নির্দেশে চে গুয়েভারা এবং তার অন্য দুই সহযোদ্ধাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যম হত্যা করে। চের দু'হাতের কবজি কেটে ফেলে সিআইএর স্থানীয় এজেন্টরা তাকে গোপনে মাটিতে পুঁতে রাখে।
বিশ্ব পুঁজিবাদের আতঙ্কের নাম আর্নেস্টো চে গুয়েভারাকে নির্মমভাবে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল, তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে লাতিন আমেরিকায়। কিন্তু যুগে যুগে চের আদর্শের মৃত্যু হয়নি। লাতিন আমেরিকার দেয়ালে দেয়ালে চের ছবি। সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন চে গুয়েভারা। আমরা দেখি, এখন বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট হন সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতা ইভো মোরালেস, ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজ। নতুন স্বপ্নের দোলা লাগে। লাতিন আমেরিকাজুড়ে সংগ্রামী নেতা চে গুয়েভারা এ অঞ্চলের মিথে পরিণত হন। যেখানে শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষের সংগ্রাম সেখানে চের ছবি হয়ে ওঠে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। পূর্ব ইউরোপসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার পরও কিউবায় টিকে আছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের পড়তে হবে চে গুয়েভারের বই। ফিদেল এবং চের যৌথভাবে গড়ে তোলা কিউবান সমাজ দেখতে হবে। যারা বিশ্বাস করেছিলেন জনগণকে, তারা তিন বছর টানা গেরিলা সংগ্রাম করে বিপ্লবী সরকার গঠন করেছিলেন। জনগণের জন্য স্বপ্নের কিউবা গড়ে তোলেন। জনগণের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছেন। তারা পৃথিবীর মানুষকে ক্ষুধামুক্ত না করে, শিক্ষিত না করে, চিকিৎসা ও সুস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা না করে চাঁদে মানুষের বসতির স্বপ্ন পূরণে নেমে পড়েননি। কোটি কোটি ডলার খরচ করেননি। ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতাদের মতো দেশকে আমলাতান্ত্রিক কারাগারে পরিণত করেননি বলেই সৃজনশীল সমাজতান্ত্রিক কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের পেটের মধ্যে এখনও সমাজতান্ত্রিক পতাকা ঊধর্ে্ব তুলে ধরে আছে কিউবান জনগণ। তাদের স্বপ্ন আর সংগ্রামের প্রতীক আর্নেস্টো চে গুয়েভারা।
 

No comments

Powered by Blogger.