যুক্তরাজ্য-আদর্শেরনয়,ক্ষমতার কোয়ালিশন by ওয়াহিদ নবী

অবশেষে ব্রিটেনে কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করল। ৬ মে নির্বাচনে কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করায় এমনটা হতে হলো। সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল রক্ষণশীল দল (টোরি দল)। কাজেই তাদের সঙ্গে প্রথম কথা বলতে চেয়েছিল তৃতীয় স্থান অধিকারী উদারনৈতিক দল (লিবারেল-ডেমোক্রেটিক দল)।


দ্বিতীয় স্থান অধিকারী শ্রমিক দল (লেবার দল) নীতিগত দিক দিয়ে এটা মেনে নিয়েছিল। লেবার দলের নেতা গর্ডন ব্রাউন বলেছিলেন, টোরি ও লিব-ডেম দলের আলোচনায় কোনো আপসরফা না হলে লেবার দল লিব-ডেমের সঙ্গে কথা বলবে। একসময় লিব-ডেম কথা বলেছিল টোরি ও লেবার দুই দলের সঙ্গেই। পরবর্তীকালে তারা টোরিদের সঙ্গে আপসরফা করে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে। আদর্শ ও নীতিগত দিক দিয়ে লিব-ডেম দলের সঙ্গে লেবার দলের মিল বেশি ছিল। কিন্তু লিব-ডেম নেতারা পরে বলেছিলেন, লেবার দল তাঁদের দাবিদাওয়ায় খুব একটা পাত্তা দেয়নি। লিব-ডেম দলের সঙ্গে লেবার দলের আপস কেন হয়নি এ ব্যাপারে লেবার দল কিছুই বলেনি । তবে দু-একজন সাংসদ আলোচনা চলার সময় ব্যক্তিগতভাবে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। একজন বলেছিলেন, আপস আলোচনার সময় লেবার দলের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে যেন কোনো আপস করা না হয়। লেবার দলের সঙ্গে লিব-ডেমের আলোচনার সময় বাণিজ্যমন্ত্রী লর্ড মেন্ডেলসন ও টনি ব্লেয়ারের প্রেসসচিব এলেস্টায়ার ক্যাম্বেল সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা দুজন নির্বাচিত ছিলেন না। লেবার দলের কয়েকজন সাংসদ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সক্রিয়তা পছন্দ করেননি এবং টেলিভিশনে এ কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ দলের নীতি বিসর্জন দিয়ে শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আপস করা লেবার দলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এটাই স্বাভাবিক। ডানপন্থী দলগুলো ক্ষমতা দখল করাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, যে জন্য নীতির সঙ্গে আপস করাটা তাদের জন্য সহজ। টোরি দলের নেতা যদি অন্য কোনো দলের সঙ্গে কোনো আপস করেন তবে নিজের দলের সাংসদদের জানিয়ে দিলেই হলো। সাংসদদের অনুমোদন নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। দল তিনটির পটভূমি সম্বন্ধে দুটি কথা মনে করিয়ে দিলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে। টোরি দল ব্যবসায়ী মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করে। ভোট পাওয়ার জন্য তাদের জনকল্যাণমূলক কিছু করতেও বলতে হয়।
লেবার দল গঠিত হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। মেথোডিষ্ট গির্জা এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। লেবার দল গঠিত হলে লিবারেল দলের প্রভাব কমে যায়। গত শতাব্দীর অষ্টম দশকে লেবার দলের একটি ডানপন্থী অংশ দাবি করে, লেবার দল অত্যন্ত বেশি বামপন্থী হয়ে গেছে। এরা লেবার দল ছেড়ে লিবারেল দল মিলে লিব-ডেম দল গঠন করে। এ রকম সময় লেবার দল ‘মিলিট্যান্ট টেন্ডেন্সি’র বলে একদল অতিবামপন্থীর অনুপ্রবেশ ঘটে। এদের প্রভাব থেকে উদ্ধার পেতে দলকে বেশ বেগ পেতে হয়। এসব কারণে টোরি দল দীর্ঘ ১৮ বছর ক্ষমতায় থাকে। লেবার দল জন স্মিথের নেতৃত্বে যখন গুছিয়ে নিয়েছে, তখনি তিনি অকস্মাৎ মারা গেলেন। এরপর টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে গঠিত হয় নিউ লেবার। নিউ লেবার বেশি ডান দিকে সরে গেছে বলে অনেকে মনে করেন। গর্ডন ব্রাউন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সবাই দলকে লেবার দল বলতে থাকে। নিউ লেবারের উৎসাহী সমর্থকেরা এটাকে কীভাবে নিয়েছে সে সম্বন্ধে কোনো আলোচনা হয়নি। স্কটিশ গর্ডন ব্রাউনকে সখ্যাগরিষ্ঠ ইংরেজরা কীভাবে নিয়েছে সে সম্বন্ধেও কেউ কিছু প্রকাশ্যে বলেনি।
সমঝোতার কারণ হিসেবে দল দুটি বলেছে, একটি ‘স্থায়ী ও শক্তিশালী’ সরকার গঠনের উদ্দেশ্যেই তারা এই আপসরফায় রাজি হয়েছে। অর্থাৎ দলীয় আদর্শ বা নির্বাচনী ইশতেহার থেকে যেটুকু তারা সরে এসেছে তা জাতিকে ‘স্থায়ী ও শক্তিশালী’ সরকার উপহার দেওয়ার জন্য।
এবার সমঝোতার বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক।
মালিকদের ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স বাড়ানোর যে পরিকল্পনা ছিল আগামী বছর থেকে তা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নিম্ন ও মধ্যম উপার্জনের মানুষদের আয়কর কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আগামী বছর থেকে। আয়করের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে, বার্ষিক ১০ হাজার পাউন্ডের চেয়ে কম উপার্জনকারীদের আয়কর থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি দেওয়া। প্রস্তাবিত উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ওপর আয়কর বা দম্পতিদের হস্তান্তরযোগ্য আয়কর আপাতত অপরিবর্তিত থাকবে।
এ বছর ছয় বিলিয়ন পাউন্ড খরচ কমানো হবে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে, বছরে ৩০ বিলিয়ন করে খরচ কমানো। মালিকদের ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স বাড়ানো হবে না এবং অন্য কয়েক প্রকার কর অপরিবর্তিত থাকবে। ফলে দরিদ্র মানুষের কাজে অর্থ ব্যয় ভীষণভাবে কমানো হবে। বিশেষ করে যাতায়াত ও বাসস্থানের ব্যাপারে দরিদ্রদের ভোগান্তি বাড়বে।
স্বাস্থ্য ও বৈদেশিক কল্যাণ খাতে খরচ বাড়ানো দরকার হলে করা হবে বলে সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু ট্রাইডেন্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প স্থাপনে যে বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন, তা কোথা থেকে আসবে এ বিষয়ে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। এই বিশাল ব্যয় যে জাতি বহন করতে পারবে না তা বুঝতে টোরি দল ইচ্ছুক নয়।
উচ্চশিক্ষানীতি প্রণয়নে সরকার একটি কমিশন নিয়োগ করেছে। এই কমিশনের রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত দুই দল অপেক্ষা করতে রাজি হয়েছে। লিব-ডেম দল এই রিপোর্ট মেনে নিতে না রাজি হলে এবং এ বিষয়ে সংসদে ভোট নেওয়া হলে তারা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারবে। স্কুলগুলো জাতীয় পাঠ্যসূচি নাও মেনে নিতে পারে। ‘পিউপিল প্রিমিয়াম’ মেনে নেওয়া হয়েছে যাতে করে স্কুলগুলো দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করতে পারে।
ইউরোপের ব্যাপারে দুই দল রাজি হয়েছে, ইউরোপকে আর বেশি ক্ষমতা না দিতে। কিন্তু যা কিছু সম্বন্ধে একমত এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংসদের সময়সীমা পাঁচ বছর স্থির করে দেওয়া হয়। শতকরা ৫৫ ভাগ ভোট পেলে সংসদ নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারে। আইডি কার্ড পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। সিসিটিভি আরও নিয়ন্ত্রিত করা হবে।
ইউরোপের বাইরে থেকে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা সীমিত করা হবে। হিথরো বিমানবন্দরে তৃতীয় রানওয়ে নির্মিত হবে না। অবসর গ্রহণের সময়সীমা পুরুষদের বেলায় ২০১৬ থেকে ৬৬ বছর হবে আর মহিলাদের ব্যাপারে হবে ২০২০ সাল থেকে।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আগামী ৫০ দিনের মধ্যে একটি জরুরি বাজেট প্রণয়ন করা হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতীয় অর্থের ঘাটতি দূর করা। দুই দল একমত হয়েছে, নতুন কর ধার্য করে নয়, ব্যয় সংকোচোন করে ঘাটতি দূর করার চেষ্টা করতে হবে। এ ব্যাপারে অবশ্যই সমস্যা রয়েছে। তাই দল দুটি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও অর্থনীতি বিভাগীয় সিভিল সার্ভিসের উপদেশ নেবে।
দলের সমঝোতায় অনেক দুর্বলতা রয়েছে অবশ্যই। দুটি দলের অনেকেই তাদের নেতাদের আপসে সন্তুষ্ট নয়। অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এ জাতীয় আপসরফায়। আনেকেই মনে করেন, এই কোয়ালিশন বেশি দিন চলবে না।
আদর্শ ও নীতির দিক দিয়ে দুটি দলের ব্যবধান অনেক। কিছুদিন আগে ক্যামেরন ‘তামাসা’ বলে নিক ক্লেগকে বর্ণনা করেছিলেন। কিছুদিন আগে লিব-ডেম দলের ভিন্স কেবল ছয় বিলিয়ন ডলার খরচ কমানোর চিন্তাকে ‘পাগলামি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। পাঁচ দিনের আলোচনা শেষে তাঁরা সমঝোতায় পৌঁছে জোট সরকার করেছেন। এটাকে একাধিকভাবে দেখা যেতে পারে। কেউ কেউ ভাবেন, ক্ষমতার জন্য তাঁরা আদর্শকে বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু এটা ঠিক যে জাতি এখনই আর একটা নির্বাচন চায় না। জনগণ আশা করে, জাতির প্রয়োজনে রাজনীতিবিদেরা একসঙ্গে কাজ করুন। একটা কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে রাজনীতিবিদদের সংকীর্ণমনা ও স্বার্থপর বলত জনগণ।
ইতিহাস বলবে এই কোয়ালিশন সরকার গঠন ঠিক হয়েছিল কি না। দেখা যাক কত দিন এই সরকার টিকে থাকে। ভবিষ্যতে কী হবে কে বলতে পারে। ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমিলান বলেছিলেন ‘ঘটনা’র (Event) কথা। অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা স্থায়ী সরকারের পতন ডেকে এনেছিল এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল নয়। আর এটা তো কোয়ালিশন সরকার!
ওয়াহিদ নবী: লন্ডন-প্রবাসীগবেষক ও চিকিৎসক।

No comments

Powered by Blogger.