বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস ২০১০-প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি, উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকার প্রশ্ন by ফরিদা আখতার

এ বছর, অর্থাৎ ২০১০ সাল, যাঁরা পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তাঁদের জন্য বছরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে অনেকেই গেছেন এবং তাঁরা জানেন, সেখানে প্রাণবৈচিত্র্য সনদ বা Conventional on Biological Diversity (CBD) গৃহীত হয়েছে।


কিন্তু তার আগে এর প্রস্তুতির কাজ হয়েছে মে মাসে নাইরোবিতে। নাইরোবি ফাইনাল অ্যাক্ট অব দ্য কনফারেন্স ১৯৯২ সালের ২২ মে এই সনদের বক্তব্য অনুমোদন করে। সেই দিনকেই বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয় ৫ জুন, যেদিন রিও ডি জেনেরিওতে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে প্রাণবৈচিত্র্য সনদ স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু যতই পরিবেশসচেতনতা বেড়েছে মনে করা হোক না কেন, প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস কিন্তু বন্ধ হয়নি এবং ২২ মে তারিখটিও কারও মনে নেই। প্রাণবৈচিত্র্য সনদ নিয়ে প্রতিবছর স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০০২ সালের সভায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১০ সালের মধ্যে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ শনাক্ত করে দারিদ্র্য বিমোচন ও সব মানুষের কল্যাণের জন্য কর্মসূচি নেওয়া।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি এ বছরের প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রাণবৈচিত্র্য (Biodiversity for Development and Poverty Alleviation)। এর সঙ্গে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল ৭-এর সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, সেখানে বলা হয়েছে, পরিবেশের স্থায়িত্ব রক্ষা করতে হবে। এ বছর প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা, উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য—সব এক জায়গায় এসে মিলেছে।
এত বছর এই কাজ কেন হলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় অবশ্যই। আমার মতে, অনেক দেরিতেই বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া হচ্ছে, যখন প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) ও প্রাণবৈচিত্র্য সনদের পক্ষ থেকে এ বছরের প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন”(Biodiversity, Development and Poverty Alleviation: Recognising the Role of Biodiversity for Human Well-being) থেকে আমি কিছু তথ্য তুলে ধরছি; তাহলে বোঝা যাবে, কত ক্ষতি হয়ে গেছে এবং এখনো কিছু রক্ষা হতে পারে, যদি সময়মতো কাজ করা যায়। সমস্যা হচ্ছে, প্রাণবৈচিত্র্যকে কখনোই অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখা হয় না। কারণ, এর সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক পরিষ্কার নয়। অথচ মানুষের জীবন-জীবিকা, উৎপাদন—সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে জড়িত। গত ৫০ বছরে ৬০ শতাংশ প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়েছে এবং গত ১০ বছরে শুধু জমিতেই প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ক্ষতি হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৭০ শতাংশ গ্রামের মানুষ সরাসরি প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে জীবন-জীবিকা চালায়, শহরের মানুষও কোনো না কোনোভাবে প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে। গত শতকে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ প্যারাবন, ৪০ শতাংশ বন ও ৫০ শতাংশ জলাশয় হারিয়ে গেছে। এ কথাও প্রমাণিত হয়েছে, মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্য প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস প্রাকৃতিক কারণের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি হয়।
অর্থনৈতিকভাবে প্রাণবৈচিত্র্য কত গুরুত্বপূর্ণ, তার কিছু পরিসংখ্যান দিচ্ছি। ওষুধ কোম্পানিগুলো বছরে যে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে, তার ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কাঁচামাল আসে গাছগাছালি থেকে। ওষুধ কোম্পানির তৈরি করা ওষুধের ৫০ শতাংশ প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করে। বন থেকে ওষুধের গাছ অসংখ্য মানুষ সংগ্রহ করে চিকিৎসা করে, যার মূল্য হচ্ছে এক বিলিয়ন ডলার। জনগণের ছয় ভাগের এক ভাগ জীবন-জীবিকার জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলের ওপর নির্ভর করে। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গাছগাছালির ওষুধের ওপর নির্ভর করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসব গাছগাছালি হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রাণবৈচিত্র্য খাদ্যঘাটতি মেটানোর জন্য খুব জরুরি। এই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ফসলে পোকা দমন করতে হলে অবশ্যই ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। পৃথিবীর ১১০ কোটি গরিব মানুষ তাদের ৯০ শতাংশ চাহিদা, যেমন-খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ, বাড়িঘর ও যানবাহনের ব্যবস্থা তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকেই মেটায়।
বিশ্বে ৩০০ কোটি মানুষ সমুদ্র ও উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে। ১০০ কোটি মানুষ সরাসরি মাছ ধরার কাজে জড়িত, অর্থাৎ এটাই তাদের জীবন-জীবিকা, বেঁচে থাকার উপায়। সামুদ্রিক মাছ থেকে ১৬ শতাংশ প্রোটিন সরবরাহ করা হয়। মাছ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তেমনি নদী ও জলাশয় থেকে পাওয়া মিঠা পানির মাছের অর্থনৈতিক মূল্য বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার।
আমরা দেখেছি, প্রাণবৈচিত্র্য যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনই মানুষের জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে পড়েছে। উন্নয়নের কথা বলে প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট করা হয়েছে। খাদ্যের জোগানের কথা বলে ফসলের বৈচিত্র্য নষ্ট এবং শুধু ধানের মতো একক ফসল উৎপাদন করে অন্য ফসলের ক্ষতি করা হয়েছে। উন্নয়নের যারা দাতা, তারাই এ ক্ষতি করার জন্য দায়ী। এখনো আন্তর্জাতিক দাতার ওপরই গরিব দেশগুলো নির্ভর করে, কিন্তু তাদের দিক থেকে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার কাজে সাড়া খুব কম। এখনো প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য নির্দিষ্টভাবে অর্থ বরাদ্দ মোট বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র তিন শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, দাতা সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, বিশেষ করে, আগ্রাসী জাতের গাছ লাগিয়ে প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি করা হয়েছে। কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ করে ফসলের বৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে ধনী দেশেরই কোম্পানির মাধ্যমে। ১৯৯২ সালের পর এমন কাজ মেনে নেওয়া যায় না।
আমাদের দেশে কৃষিজমি রক্ষার কোনো নীতি নেই। বছরে এক শতাংশ জমি কমে অন্য খাতে চলে যাচ্ছে। খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ করে যেমন খাদ্যঘাটতি হচ্ছে, তেমনই প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। চিংড়ি চাষ মাটিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দিয়েছে, এখন সেখানে জিএম ধান করার জন্য কোম্পানিগুলো সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে। এর ফলে প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে জেনেও সরকার সেদিকে ঝুঁকছে। কোম্পানি বলেছে বেশি ফলন হবে, তো আর কথা নেই। ১৫ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর দোহাই দিয়ে প্রযুক্তির নির্বিচার ব্যবহার আমাদের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে খুব সফল হওয়া যায়নি। অথচ বাংলাদেশের কৃষক এখনো প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করে কৃষি উৎপাদন করছে এবং তাঁদের কারণেই এখন হাজার জাতের ধান ও অন্য ফসলের বৈচিত্র্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জাতিসংঘ সনদের অংশীদার হিসেবে অন্যান্য দেশের মতো ২০১০ প্রাণবৈচিত্র্য লক্ষ্যমাত্রা সমীক্ষাপূর্বক সিবিডি বাস্তবায়নের ওপর চতুর্থ প্রতিবেদন দাখিল করার কাজ করেছে। এই প্রতিবেদনে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের সীমিত কিছু কারণ দেখানো হয়েছে। কিন্তু মূল কারণগুলো খুব বলা হয়নি। তবুও যা বলা হয়েছে, তাতে জানা যায়, উজানের পানির সরবরাহ কমে যাওয়া প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের একটি অন্যতম কারণ। তা ছাড়া জমির ব্যবহারের পরিবর্তন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের নামে নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ পানির গতিতে পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে মাছসহ অনেক জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে। আগ্রাসী গাছ (যেমন ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া), আগ্রাসী ফল, পশু ও মাছের চাষ স্থানীয় জাতের ক্ষতি করেছে। কৃষিতে উচ্চফলনশীল জাতের ব্যবহার ও এর সঙ্গে সার, বিষসহ নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার কৃষকের নিজ হাতে রাখা বীজ ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করছে। আগে যেখানে ১০ হাজার জাতের ধান ছিল, এখন মাত্র ২২টি উচ্চফলনশীল জাতের চাষ হচ্ছে।
চলনবিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রাণবৈচিত্র্য-সমৃদ্ধ অঞ্চল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চলনবিল শীতকালে শুকিয়ে যায় বলে অনেক জলচর পাখি এখন আর পাওয়া যায় না। যদিও প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই, তবুও বলছি, চলনবিলে তামাক চাষ বর্ষাকালে মাছ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হবে। কারণ, ব্যাপক পরিমাণ কীটনাশকের ব্যবহার মাছ মেরে ফেলবে, যা এখন মাতামুহুরী নদীতে ঘটছে। তাই এখনি সতর্ক হওয়া দরকার।
বোঝাই যাচ্ছে, উন্নয়নের নামে, খাদ্য উৎপাদনের নামে এ দেশে অনেক ভুল পদক্ষেপ আগে নেওয়া হয়েছে, যা আজ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ হিসেবেও চিহ্নিত হচ্ছে। এখন সময় হয়েছে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.