বিদ্যাভক্তির এই ‘পুরস্কার’?-টুকটুকির থেঁতলানো আঙুল

নয় বছরের টুকটুকি খাতুনের মন টানে পড়ালেখায়, অথচ পেটের টানে সে হয়েছে ফাই-ফরমাশ খাটা ‘চাকর’। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে স্কুলে যায়। কিন্তু কখনো কখনো পেটের টানের থেকেও মনের টান বেশি হয়। এ রকমই টানে সেদিন কাজে না গিয়ে বই-খাতা বগলে স্কুলের পথে রওনা হয় মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার যতারপুর গ্রামের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী দরিদ্র টুকটুকি।


কিন্তু স্কুলে পৌঁছানো হলো না তার। পথ থেকে তাকে তুলে আনল তিন ভাই। কাজে না আসার ‘অপরাধে’ তারা সাঁড়াশি দিয়ে আটকে হাতুড়ি দিয়ে ওইটুকু শিশুর হাত ও পায়ের আঙুল থেঁতলে দিল। এভাবেই বিদ্যার প্রতি ভক্তির ‘পুরস্কার’ পেল ছোট্ট মেয়েটি। গত বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোয় প্রকাশিত টুকটুকির ঘটনা করুণ ও অসহনীয়।
টুকটুকি এখন হাসপাতালে শুয়ে ভয়ে ও ব্যথায় বিহ্বল। টুকটুকির ঘটনা সর্বজনীন শিক্ষার অধিকারের কথাকে, বালিকাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রচারাভিযানকে, শিক্ষাই আলো এমন মহৎ বাণীকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কেন সেই সর্বজনীন অধিকার টুকটুকিরা পাবে না? শিক্ষার পথে এগিয়ে যাওয়া দরিদ্র শিশুদের কেন একাই সংগ্রাম করতে হবে? কেন শিক্ষার সেই আলো টুকটুকিদের জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছায় না? তার জন্য বরাদ্দ শিশুশ্রমিকের কঠিন জীবন, আর সাঁড়াশি-হাতুড়ির অমানুষিক নির্যাতন।
কী দুঃখজনক, পড়ার খরচ চালানোর জন্যই ছোট্ট মেয়েটিকে গার্হস্থ্য শ্রমিকের কাজ নিতে হয়েছিল। টুকটুকিরা যে গ্রামের বাসিন্দা, সেই গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষ ছিল, ছিল স্থানীয় সরকার; আর সবার ওপরে ছিল সরকার। কেন কেউই টুকটুকির ভার নেয়নি, কেন তার নির্যাতন ঠেকানো যায়নি? টুকটুকির ঘটনা এমন অনেক প্রশ্ন তোলে, যার উত্তর আমাদের খোঁজা উচিত। জঘন্য কাজটির দায় কেবল ওই পাষণ্ড তিন ভাইয়ের একার নয়। পরোক্ষ দায় সবার। আমাদের ‘সভ্য সমাজ’ যে যথেষ্ট মানবিক হয়ে ওঠেনি, এ ঘটনা তারই সংকেত হয়ে বাজছে।
টুকটুকির চিকিৎসা ও পড়ালেখার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন নিক, ওই তিন ভাইয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। কিন্তু সমাজভুক্ত অনেক মানুষের মধ্যে যে নির্যাতকসুলভ দানবিক মানসিকতা রয়েছে, তারও নিরাময় প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.