সাদাকালো-লাঠিপেটা নয়, বৈঠকে সহজ সমাধান সম্ভব by আহমদ রফিক

শিক্ষক-বিষয়ক একটি খবর সংবাদপত্রে পড়ে ও টিভি চ্যানেলে দেখে ভালো লেগেছিল। প্রধানমন্ত্রী সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদমান তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু ঘোষণা নয়, এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।


এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়, কারণ শিক্ষা খাত সম্ভবত সরকারি পর্যায়ে সবচেয়ে অবহেলার। অথচ বরাবর বলা হয়ে থাকে, শিক্ষাই সমাজ ও জাতির উন্নতি এবং মর্যাদা অর্জনের সোপান। শিক্ষকরা সেই মানুষ গড়ার কারিগর, যে আলোকিত মানুষ একটি জাতিকে বিশ্বপরিসরে সম্মানের আসনে পৌঁছে দিতে পারে।
কিন্তু সেই ভালোলাগার অনুভূতি স্থায়ী হতে পারেনি এই ঘটনা দেখে যে একই দিনে কর্তব্যরত (!) পুলিশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে। জলকামানের সাহায্যে তাঁদের ওপর গরম পানি নিক্ষেপ করেছে। একেবারেই দুটো বিপরীতধর্মী ছবি। কী অপরাধ গ্রাম থেকে আসা গরিব শিক্ষকদের? তাঁদের মূল দাবি ২৪ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের। সেই সঙ্গে অন্য কিছু অর্থনৈতিক দাবি, যা আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন। এ আন্দোলন কিন্তু হঠাৎ নয়, আজকের নয়, অনেক দিন আগের।
খবরে প্রকাশ, শিক্ষকরা শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘটের পর সেখান থেকে তাঁদের দাবিদাওয়া সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করার জন্য মিছিল করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। শাহবাগ মোড়ে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। তারপর যথারীতি বাধাদানকারী পুলিশের সঙ্গে তাঁদের তর্কাতর্কি, বচসা ইত্যাদি এবং শিক্ষকদের ওপর পুলিশের হামলা।
এর মধ্যে যে তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, আন্দোলনরত শিক্ষকরা তাঁদের কয়েকজন প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পাঠাতে রাজি হননি। তাঁরা সদলবলে সেখানে গিয়ে স্মারকলিপি দিতে চেয়েছিলেন- বাস্তবতাবিচারে যা সম্ভব নয়। এবং তা যেকোনো দেশে যেকোনো বিষয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। কয়েক হাজার লোক একসঙ্গে গিয়ে কারো কাছে স্মারকলিপি দিতে পারেন না। দু-চারজন প্রতিনিধিকেই এ কাজ সম্পন্ন করতে হয়, শিক্ষকদের বেলায়ও এটাই স্বাভাবিক ছিল। আর এ বাস্তবতা তাঁদের মেনে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাঁরা তা করেননি। কী বিবেচনায় করেননি, তা বোঝা মুশকিল। সে কথা তাঁরাই জানেন। হতে পারে হতাশা এর কারণ।
কিন্তু তাই বলে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা, জলকামানের গরম পানির ছেঁকা কোনোমতেই মানা যায় না, সঠিক মনে হয় না। কারণ তাঁরা আর পাঁচটা মারমুখী ধর্মঘটীদের মতো সন্ত্রাসী কাজে হাত লাগাননি? কারো গাড়ি ভাঙচুর করেননি, বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারতে যাননি, রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বা ককটেল ছুড়ে ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করেননি। তাহলে কেন লাঠিপেটা? কেন জলকামান? এমনই পেটানো যে তাতে একজন শিক্ষকের প্রাণ গেল এবং তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পুলিশের এ ধরনের বেয়াড়া তৎপরতার কৈফিয়ত কে দেবেন? পুলিশ-প্রধান না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?
এ বিষয়ে পুলিশের তাৎক্ষণিক বক্তব্য যেমন এ কালে, তেমনি অতীতে কেউ কখনো আস্থায় নেননি। আমাদের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে কী পঞ্চাশের দশকে, কী ষাটের দশকে যে সময়টা আমরা পার করে এসেছি পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর আগে। পুলিশ বাহিনীকে যেমন তখন, তেমনি এখনো সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে বড় একটা দেখা যায়নি, দেখা যায় না। যেমন দেখা যায় না যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁদের বেলায়। বিগত সরকারের আমলেও আন্দোলনরত রাজনৈতিক নেতাদের পুলিশের হাতে লাঠিপেটা হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কারো মাথা ফেটেছে, কারো পা ভেঙেছে। স্বরাষ্ট্র দপ্তর নির্বিকার।
সাধারণ নীতি হিসেবে আবারও বলি, পুলিশ সদস্যদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে আরো খানিক সংযত হলে, সহিষ্ণু হলে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে না। অন্তত এই বিশেষ ক্ষেত্রে ভেঙে পড়ত না। অন্য যেকোনো উপায়ে তাঁদের যাত্রা প্রতিহত করা যেত। আর রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হওয়ার যুক্তিও ধোপে টেকে না। কারণ বিরোধী দলের হরতালে-বিক্ষোভে রাস্তায় এর চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়। হয় যখন সরকারি দলের তরুণ সমাজ দলেবলে রাস্তায় নামে।
আরো একটি কথা বলি, নিরস্ত্র শিক্ষকদের ওপর হামলায় ওই যে একজন শিক্ষকের প্রাণ গেল, তা কি ওই মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকের প্রাপ্য ছিল? এ মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ কি সম্ভব? কোনো মৃত্যুর বেলায়ই তা সম্ভব হয় না। এই যে হরতালকালে মাস্তানরা দেদার গাড়ি ভাঙছে, বাস পোড়াচ্ছে, মানুষ মারছে- কই, শিক্ষক পোটানোয় তৎপর পুলিশ বাহিনী সেসব অনাচার বন্ধ করতে পারছে না কেন? হরতালের পর হরতালে গাড়ি ভাঙচুর-সংস্কৃতি তো পাকাপোক্ত হতে চলেছে। সে ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা ব্যর্থ কেন?
পুলিশি অনাচারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় কি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে? কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দুদিন ধরে অবস্থানরত শিক্ষকদের সঙ্গে বা তাঁদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা যেত বা দপ্তরে ডেকে নিয়ে কথা বলা যেত, কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তারা করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষা-বিষয়ক সমস্যায় প্রায়শ যে বিচক্ষণতার পরিচয় রেখেছেন, এ ক্ষেত্রে তেমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা করেনি। তাই অঘটনের দায় তাদেরও।
অবশ্য আমরা একই সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করি যে ২৪ হাজার প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণের সঙ্গে যে আর্থিক ব্যয়ের সম্পর্ক রয়েছে, তা সরকারের জন্য সমস্যা ও বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। কিন্তু তাই বলে আলোচনায় বসতে বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা-বৈঠকের ব্যবস্থা করতে অসুবিধা ছিল কোথায়? পাঁচটা দাবির মধ্যে অন্তত দু-একটা দাবি প্রায়শ মেনে নিতে পারা যায়। আর প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এমন কথা বলেননি যে তিনি আলোচনায় বসবেন না। ইতিমধ্যে তিনি তো নিজ উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের আন্দোলন এবং সমস্যা সমাধানে এগিয়ে গেছেন এবং সমস্যা অনেকটাই মিটেছে বলা চলে।
আসলে কোনো সরকারই সদিচ্ছা থাকলেও তার কর্মতৎপরতায় সফল হতে পারে না, যদি বিভিন্ন ধাপের কর্মকর্তারা তাঁদের দায়িত্বে ও কাজে আন্তরিক না হন। এটা দলবিশেষের জন্য নয়, সব দলের সরকারের ক্ষেত্রেই সত্য। এখানেই বাংলাদেশে সরকার পরিচালনায় সর্ষের মধ্যে ভূত! আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সমস্যা ও সদিচ্ছার অভাব থেকে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ৪০ বছর পার করেও মুক্ত হতে পারেনি। অনেক ভূতের মধ্যে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসঙ্গত সুশীল সমাজের অভিভাবকীয় দায়-দায়িত্ব নিয়ে প্রায়ই যে বড় বড় কথা বলা হয়ে থাকে, দরিদ্র প্রাথমিক শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে তাদের দায়-দায়িত্বের কোনো প্রকাশ দেখা যায়নি। এ সম্বন্ধে দু-তিন দিন আগে একজন কলামিস্ট সঠিকভাবেই এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁর লেখায়।
তাঁর ভাষায়- 'আমাদের দেশের সুশীল সমাজ রাজনৈতিক কারণে যতটা উত্তেজিত হয়ে পড়ে, ক্ষমতার রদবদল নিয়ে তারা যেমন অন্যদেরও উস্কানি দিতে কসুর করে না, সেই সুশীল সমাজের মানুষজন কি এগিয়ে এসেছে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুঃখের কথা শোনার জন্য? এসব শিক্ষক শহীদ মিনারে অবস্থান করে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছিলেন, কেউ হয়তো তাঁদের দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করতে যাবে। কিন্তু কোনো সহানুভূতি তাঁরা পাননি। বাধ্য হয়ে তাঁরা আবারও ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী জুনে একযোগে ২৪ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেবেন।'
খুব একটা বেঠিক কথা বলেননি এ কলামিস্ট। বাস্তবিকই কয়েক বছর ধরে নিয়মিত দেখছি, বিভিন্ন সমস্যায় বা আন্দোলনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সুশীল সমাজের ব্যক্তিবিশেষকে একাত্মতা প্রকাশ করতে। কখনো বা মানববন্ধনে যোগ দিতে। বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের মূল দাবি বা তাঁদের সমস্যা ওইসব ঘটনার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? বরং কিছুটা বেশিই বলা যেতে পারে। তবু আশ্চর্য যে এ সমস্যা তাঁদের চৈতন্য স্পর্শ করেনি। করলে তাঁদের কেউ না কেউ শহীদ মিনারে আসতেন, কিন্তু তাঁরা আসেননি।
শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষকতা নিয়ে আমরা অনেক গালভরা কথা বলে থাকি। বিশেষ করে বলে থাকেন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্তাব্যক্তিরা! কথাগুলো মিথ্যাও নয়। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যক্তিমানস ও জাতীয় মানস-গঠনের ভিত্তিস্বরূপ। আমাদের দেশে ওই ভিত তৈরির দিকটা সত্যই অবহেলিত। তাই প্রাথমিক শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান নিয়ে, সুশিক্ষার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বরং না ওঠাই অস্বাভাবিক।
এই মানের প্রশ্নটি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় বাস্তবিকই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এবং তা যেমন বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষা-শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে সত্য। সেদিকে নজর দেওয়া যেমন দরকার, তেমনি দরকার এর অর্থনৈতিক দিকে দৃষ্টিপাত। বর্তমান সময়ের মুদ্রাস্ফীতি ও বাজারদর বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি দাবি মোটেই অযৌক্তিক নয়। অর্থনীতিবিদদের এ সমস্যা বোঝার কথা। কিন্তু তাঁরা এর চেয়ে বড় বড় খাত নিয়ে মাথা ঘামান।
অবশ্য তাঁরা সাধ ও সাধ্যের ব্যবধান নিয়ে কথা বলে থাকেন, তবু যাঁদের মানুষ গড়ার প্রাথমিক কারিগর মনে করা হয়, তাঁদের কাজের গুরুত্ব বিচারে অন্য খাত থেকে অর্থ সংকুলান করে হলেও সরকারি-বেসরকারি উভয় দিককার প্রাথমিক শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। দরকার ২৪ হাজার বেসরকারি বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ, দরকার সরকারি-বেসরকারি উভয় দিককার প্রাথমিক শিক্ষকদের যথার্থ প্রশিক্ষণ, তাঁদের জীবনযাত্রার প্রতি সামান্য হলেও সহানুভূতিশীল দৃষ্টি। প্রাথমিক শিক্ষা খাতের সুষ্ঠু সম্প্রসারণ না ঘটানো গেলে নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। আপাতত তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানে ২৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকও আমরা জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় অপরিহার্য মনে করি।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক

No comments

Powered by Blogger.