গাড়ি পোড়ানো মামলা-এজাহারের সঙ্গে ঘটনার অমিল by গোলাম মর্তুজা ও কাজী আনিছ

বাস পুড়েছে সত্য। তবে বাস পোড়ানো মামলার এজাহারের বিবরণ ঠিক নেই। বাসের চালক ও যাত্রীদের বক্তব্য অনুযায়ী, ঘটনার স্থান ও সময় ছাড়া বাকি সবই সাজানো এজাহারে বলা হয়েছে, ৩৬ জন আসামি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ঘটনাস্থলে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আসামিদের মধ্যে শুধু বাসের কন্ডাক্টর ও চালকের সহকারী (হেলপার) উপস্থিত ছিলেন।


গত ২৯ ও ৩০ এপ্রিল হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। ২৯ এপ্রিল রাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অদূরে ফ্যালকন টাওয়ারের সামনে গুলিস্তান-উত্তরা পথে চলাচলকারী একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বাসের কন্ডাক্টর ও হেলপার ছাড়াও বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের ৪২ জন প্রথমসারির নেতাকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে সরাসরি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং আটজনের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা ও অর্থায়নের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ ঘটনায় ১১ দিনেই তদন্ত শেষ করে ‘সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়ে’ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এ মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৪২ নেতা এখন কারাগারে। ২২ দিনের মাথায় অভিযোগপত্র গ্রহণও করেন আদালত।
মামলার এজাহারে বাদী তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইসমাইল মজুমদার তাঁর ‘চোখে দেখা’ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। এতে বলা হয়, রোববার রাত নয়টা পাঁচ মিনিটে ফ্যালকন টাওয়ারের সামনে এসে তিনি দেখতে পান, ছয়-সাতটি মাইক্রোবাসে এক থেকে ৩৬ নম্বর আসামিরা বাসটির গতি রোধ করছেন। বাসটি থামাতে না চাইলে বাসে থাকা ১ ও ২ নম্বর আসামি (কন্ডাক্টর ও হেলপার) চালককে জিম্মি করে জোর করে বাসটি দাঁড় করান। এ সময় তিন থেকে ৩৬ নম্বর আসামি বাসে ভাঙচুর চালান। এসআই ভাঙচুরকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। ভাঙচুরের ভয়ে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে গেলে একজন আসামি বাসে অগ্নিসংযোগ করেন।
তদন্ত শেষে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, হরতাল সফল করার জন্য আসামিরা মুঠোফোনের মাধ্যমে যে কথাবার্তা বলেন, তা ধারণ করা সিডি সংগ্রহ করা হয়েছে। এক থেকে ৩৬ নম্বর আসামি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সবাই ছয়-সাতটি মাইক্রোবাসে করে ঘটনাস্থলে এসে বাসটির গতি রোধ করেন। এরপর ১ ও ২ নম্বর আসামি সোহেল মিয়া ও জসিম বাস ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন।
তবে বাসটির চালক ও যাত্রীরা প্রথম আলোকে বলেন, বাসটির চাকা ফেটে যাওয়ায় তা মেরামতের সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত বাসে আগুন দেয়। মাইক্রোবাস দিয়ে বাস থামানোর কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ঘটনাস্থলে বাসচালক আবু বকর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, উত্তরা থেকে আসার পথে বাসের সামনের একটি চাকা ফেটে যাওয়ায় তিনি বাসটি থামান। হেলপার জসিম ও কন্ডাক্টর সোহেলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেই বাসের চাকা খুলছিলেন। এমন সময় বাসের পেছন দিকে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় কয়েকজন দুর্বৃত্ত। তাঁরা তাদের দেখেননি। ঘটনার একই বর্ণনা দেন কয়েকজন যাত্রীও।
এজাহারে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া হেলপার ও কন্ডাক্টরসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, ঘটনার পরিকল্পনা ও অর্থায়নকারীর নাম। তাঁরা হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির সাত ও জামায়াতের একজন নেতা।
বাসটির মালিক তৌহিদুল ইসলাম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পর চালক আবু বকরের ফোন পেয়ে তিনি গিয়ে দেখেন, বাসটি পুড়ে গেছে। বাসে কে আগুন দিল, তা চালক বা যাত্রীরা কেউ তাঁকে বলতে পারেননি। তিনি পুলিশকেও এ কথা বলেছেন বলে জানান। তবে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বাসের দুই কর্মীকে ধরে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় পুলিশ বলছে, চার-পাঁচ দিন পর কর্মীদের বিষয়ে জানাবে। কিন্তু এখনো কিছু বলেনি।
ত্যক্তবিরক্ত তৌহিদুল বলেন, তিনি কোনো দোষ করেননি, অথচ ভোগান্তির শিকার। তাঁর উপার্জনের অবলম্বন বাসটি বিনা কারণে ২৫ দিন ধরে আটকে রেখেছে পুলিশ। কবে ছাড়বে বা আদৌ ছাড়বে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কারাবন্দী হেলপার জসিমের বাসা তেজগাঁও রেল কলোনিতে। তাঁর স্ত্রী শাহিনা প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে সাক্ষাতের সময় জসিম তাঁকে বলেছেন, কারা যেন বাসে আগুন দিয়েছে। এ জন্য পুলিশ তাঁকে ধরেছে। তাঁরা ভেবেছিলেন পুলিশ জিজ্ঞাসা করে ছেড়ে দেবে। জসিমকে বাসমালিক বলেছিলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে যা, সকালে ছাড়ায়া আনুমনে’। জসিমের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ শুনে শাহিনা বলেন, ‘হায় আল্লাহ, হ্যাতে গাড়িত আগুন দিব ক্যা, হেয় তো গাড়ির ইস্টাপ।’
দুই কর্মী সম্পর্কে বাসমালিক তৌহিদুল বলেন, ‘মামলার বিষয়গুলান দ্যাখতাছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। আমি এহন কিছু কইবার পারুম না। আপনারা অবস্থা বোঝেন না।’
এদিকে বাসচালক আবু বকরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। বাসমালিক জানিয়েছেন, ঘটনার পর পুলিশ চালকের মুঠোফোনটি জব্দ করেছে। চালক নিজে থেকে আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করছেন না। তাঁর সঙ্গে চালকের কোনো যোগাযোগই হচ্ছে না।
এজাহারের সঙ্গে চালক ও যাত্রীদের বক্তব্য না মেলার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী এসআই ইসমাইল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন এ ব্যাপারে বলার কিছু নাই।’
অভিযোগপত্রের ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক নূরুল আমিন বলেন, তদন্তে পাওয়া সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। সুনিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো প্রমাণ মিলেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না।’
তবে যেকোনো মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শুধু ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে এজাহারের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে অভিযোগপত্র দেওয়া যায়। অন্য মামলার ক্ষেত্রে বাদী, আসামি, প্রত্যক্ষদর্শীসহ সবার সঙ্গে কথা বলে এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার পর মামলার অভিযোগপত্র দিতে হয়। অভিযোগপত্র হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যাকে সন্দেহ করবে, তাকেই আসামি করতে পারে। তবে পুলিশের তদন্তে যদি আরও নাম আসে তাহলে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত হবে। আবার অভিযোগ প্রমাণিত না হলে নাম বাদ দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.