অর্থনীতি-দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্পের বাজেট by ফাহমিদা খাতুন

বাজেটকে ঘিরে জনজীবনে একদিকে যেমন থাকে আশা, তেমনি থাকে শঙ্কা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও শঙ্কার এই দোলাচলের পরিপ্রেক্ষিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি বাজেট প্রণয়ন করা দুরূহ কাজ। আর এই কাজটি করতে গিয়ে সরকারকে শুধু একটি বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব করতে হয় না, রাজনৈতিক অবস্থান থেকে শুরু করে সামগ্রিক উন্নয়ন-দর্শন এবং নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব ও উন্নয়ন পদক্ষেপ নিতে হয়।


বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার এবং দিনবদলের সনদে জনগণের জীবনে আর্থসামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে কতগুলো মাইলফলক ঘোষণা করেছে। এতে ২০১৩ সালে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ১০ শতাংশে উন্নীত করা, ২০১২ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন, ২০২১ সালে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদানের হার ৪০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, ২০১৩ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ, ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, ২০১৪ সাল নাগাদ প্রত্যেক পরিবার থেকে অন্তত একজনের কর্মসংস্থান, ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য আবাসন ইত্যাদি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মাইলফলকগুলো অর্জন করার একটি হাতিয়ার হচ্ছে বাৎসরিক বাজেট। চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে এ রকম কিছু লক্ষ্যমাত্রার প্রতিফলন ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটেও সেগুলো বিদ্যমান থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক।
তবে বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কতগুলো বিষয় আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিনিয়োগে গতিশীলতা আনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এই সবকিছু সামাল দিয়ে মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হলে আগামী অর্থবছরে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.৮৮ শতাংশ। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা ৬ শতাংশ প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হলে যে বর্ধিত সরকারি ব্যয় প্রয়োজন তা মেটাতে গিয়ে বরাবরের মতো সরকারকে একটি ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল মোট বাজেটের ৫ শতাংশ। তবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রকৃত ঘাটতি এর চেয়ে কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যেহেতু আমাদের দেশে কখনো সরকারি ব্যয় পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। অর্থনীতিতে প্রণোদনা সৃষ্টির মাধ্যমে আয় বাড়ানোর জন্য ঘাটতি বাজেট একটি কৌশল। আর বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখাটা সহনীয় বাজেট ঘাটতি বলে অনেক অর্থনীতিবিদের ধারণা। তবে যে বিষয়গুলো এর সঙ্গে যুক্ত সেগুলো হচ্ছে, প্রথমত, সরকারি ব্যয় কীভাবে বাড়ানো যায়। আমাদের দেশে বাজেটের আকার এখনো জিডিপির ১৬.৬ শতাংশ। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই এই হার ২০ শতাংশ বা তারও বেশি। উন্নয়ন বাজেট মোট জিডিপির মাত্র ৪.৪ শতাংশ। আমাদের জাতীয় সঞ্চয় হারের চেয়ে বিনিয়োগ হার অনেক কম। অন্যদিকে এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও আমরা ঐতিহাসিক শ্লথগতি অতিক্রম করতে পারছি না। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার হয়েছে ৪৪ শতাংশ। এই শ্লথগতির পাশাপাশি আরেকটি দুর্বলতা হলো অর্থবছরের শেষদিকে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে কাজের মানের সঙ্গে আপস করা।
সরকারি ব্যয় বাড়াতে গেলে যে অর্থের প্রয়োজন তার উৎস হবে বরাবরের মতোই দেশি ও বিদেশি। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত খাতগুলো থেকে ঋণ নেওয়া অন্যতম উপায়। তবে ব্যাংক থেকে অধিক পরিমাণে ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকট মোকাবিলা না করা গেলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক ঋণের চাহিদা সামনের দিনগুলোতে আশানুরূপভাবে নাও বাড়তে পারে। সরকারি ব্যয় মেটানোর অন্য উৎসটি হচ্ছে বিদেশি সাহায্য। তবে এই সাহায্য যদি অনুদান না হয় তাহলে তা ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে থাকে। সরকারি ব্যয় বাড়ানোর সঙ্গে আরেকটি আশঙ্কার বিষয় যুক্ত থাকে, সেটি হলো মূল্যস্ফীতি। আগামী অর্থবছরে একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে বর্ধিত সরকারি ব্যয়—এই দুইয়ের প্রভাব অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি মুদ্রানীতির সুচিন্তিত ব্যবহার প্রয়োজন পড়বে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এ লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর তারল্য-রিজার্ভের হার বা সিআরআর বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বতর্মান পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষণস্থায়ী পদক্ষেপ হিসেবে এটি সঠিক। আমাদের ঋণ সরবরাহের গতিধারা যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব সুদের হার কম থাকলেই যে ঋণ সরবরাহ খুব বেশি বাড়ছে তা নয়। কেননা এখানে শুধু সুদের হার ছাড়াও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাব, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি অনুষঙ্গ কাজ করেছে। অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বিশ্বব্যাপী সুদের হার কমিয়ে অর্থনীতিতে প্রণোদনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। এখন আবার অর্থনীতি কিছুটা ইতিবাচক দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের অনেক দেশেই সুদের হার বাড়ানোর প্রবণতা চলছে। ভারতেও সম্প্রতি তারল্য রিজার্ভ হার বাড়ানো হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে ভালো ফসলের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমে এলে সুদের হার পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ রকম একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে আগামী বছরের বাজেটের লক্ষ্য হতে হবে বরাবরের মতোই রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ সঞ্চালন এবং তার সর্বোচ্চ ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে কর-জিডিপি হার বাড়ানোর বিকল্প নেই। রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি বিনিয়োগ হার শতকরা ২৪ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে, যাতে সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত পিপিপির মাধ্যমে অর্থায়নের জন্য উপযোগী নীতিমালা, প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনি কাঠামো তৈরি করে বিনিয়োগ প্রচেষ্টায় গতিময়তা আনা প্রয়োজন।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন প্রয়াসের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব আদায় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অন্যান্য বছরের তুলনায় মোটামুটি ভালো। আয়করের আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ শতাংশের ওপর এবং মোট রাজস্বে প্রত্যক্ষ করের অংশ ২৪ শতাংশের ওপরে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক গত বছরের একই সময়কালের চেয়ে মাত্র ৪.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির হার গত দুই বছর থেকে কমে যাওয়ার একটি কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য এবং জ্বালানি মূল্য কমে যাওয়া। চলতি অর্থবছরে আমদানি শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০.৮ শতাংশ। অর্থবছরের বাকি তিন মাসে এই ফারাক পূরণ বেশ কঠিন হবে। তবে মূল্য সংযোজন কর বা মূসক চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭.১ শতাংশ, যা কি না পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে আরও সুযোগ রয়েছে। যেমন, ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে মূসক ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করা যায়। আয়করের ক্ষেত্রে করযোগ্য আয় আছে যেমন মুদির দোকানি, কৃষক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা সম্ভব। তা ছাড়া বিভিন্ন উৎস যেমন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফা, জমি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আয়ের পরিমাণ অনুযায়ী কর আরোপ শুরু করা উচিত। রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য কর প্রশাসনের জটিলতা দূর করে এর সংস্কার, জনবল বাড়ানো, জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি, কর ব্যবস্থাপনাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা করার কথা বহুল উচ্চারিত।
সম্পদ সঞ্চালনের প্রয়াস বাড়ানো না গেলে শুধু অবকাঠামো নয়, সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়। কেননা সীমিত সম্পদের মধ্যে ব্যয় ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে যে প্রাধিকার তালিকা তৈরি করতে হয় সেখানে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে সামাজিক ব্যয় খাত সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অথচ মানব সম্পদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটাতে হলে প্রয়োজন একটি স্বাস্থ্যবান, শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮২টি দেশের মধ্যে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬তম। এর উন্নয়ন ঘটাতে হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বর্তমানে জিডিপির ৩.১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে অন্তত ৫ থেকে ৬ শতাংশ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে এই ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা। শুধু স্কুলের খাতায় নামের তালিকা বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখছে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
আধুনিক সমাজে জাতীয় বাজেট হচ্ছে সমাজের উন্নয়নের দলিল। আর গণতান্ত্রিক দেশে বাজেটের মাধ্যমে দেশের রাজস্ব-ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সরকার একটি আইনগত অধিকার পায়। যার ফলে সরকার জনগণের কাছ থেকে কর আদায় এবং জনগণের জন্য নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এটি করতে গিয়ে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয় তা সরাসরি মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের মতো সীমিত সম্পদশালী দেশে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ন্যায়বিচার করা যায়, একটি সুচিন্তিত বাজেটের লক্ষ্য হবে সেটিই।
ড. ফাহমিদা খাতুন: অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

No comments

Powered by Blogger.