অভিমত ভিন্নমত

এফডিসিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিন গত ৬ মে প্রথম আলোয় মশিউল আলমের ‘ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির নিষেধাজ্ঞা’ শীর্ষক কলামে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করতে বলেছেন। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প বিকাশের পরিবর্তে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে প্রতিযোগিতার অভাবে।


তাই ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি করে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির পক্ষে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
আমার মতে, এ দেশের মূলধারার চলচ্চিত্রশিল্প বিকশিত না হওয়ার পেছনে কতগুলো কারণ রয়েছে: ১. মান্ধাতা আমলের সেন্সরশিপ আইন। এ সমাজে প্রতিদিন যেসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে সেগুলো সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারছে। কিন্তু চলচ্চিত্রে এসব দেখানো যায় না। পুলিশ ঘুষ খাচ্ছে কিংবা কোনো এমপি-মন্ত্রী দুর্নীতি করছেন এ রকম দেখালে সেন্সর বোর্ডে ছবি আটকে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে হলে অতিসত্বর সেন্সর আইন সংশোধন (আধুনিকায়ন) করতে হবে। আর চলচ্চিত্র অভিনেতা/অভিনেত্রী এবং নির্মাতাদের সমন্বয়ে সেন্সর বোর্ড গঠন করতে হবে।
২.চলচ্চিত্রশিল্পের অবকাঠামোগত ও কারিগরি উন্নয়ন হয়নি। এখনো আমাদের ভালো সিনেমাস্কোপ ক্যামেরা নেই। এমনকি একটা ভালো ক্রেনও নেই। এগুলো আমাদের ভারত থেকে চড়া দামে ভাড়া নিয়ে কাজ করতে হয়। কিছুদিন আগে এফডিসির ভিআইপি বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। এখন লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো এডিটিং করা যায় না। ডাবিং থিয়েটার অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে। এখনো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে সাবটাইটেল মেশিন, টেলিসিনে মেশিন, অপটিক্যাল মেশিন, ডাবিং করার ১ নম্বর থিয়েটারের ‘রক অ্যান্ড রোল’ এবং ‘লুপ’ মেশিন। মাসের পর মাস যন্ত্রগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকে।
ছবির রেন্টাল বাড়েনি অথচ নির্মাণব্যয় বেড়েছে চার গুণ। ছবি মুক্তির পরই ফোন আসে ভিডিও-চোরদের। এ ব্যাপারে কোনো কঠোর আইন নেই। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে দু-একজন চোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক দিন পর তারা আবার ছাড়া পেয়ে যায়। যে প্রযোজক একবার এভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন, তিনি আর নতুন করে ছবি নির্মাণের সাহস পান না। এভাবে চলচ্চিত্রাঙ্গন থেকে হারিয়ে যান অসংখ্য প্রযোজক। আর ভালো প্রযোজকের অভাবে ভালো পরিচালকেরাও সরে দাঁড়ান চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে। আগে যেখানে প্রতিবছর শতাধিক ছবি মুক্তি পেত, এখন সেখানে মুক্তি পায় ৫০-৬০টি। এ সংখ্যা দিন দিন আরও কমছে। আর ভালো ছবির অভাবে হলের সংখ্যা হু হু করে কমে যাচ্ছে।
এই চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে অনেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির কথা বলছেন। তাদের মতে, এতে করে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের সৃষ্টি হবে এবং টিকে থাকার স্বার্থেই নির্মাতারা ভালো ছবি বানাবেন। তাঁদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। হিন্দি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হলে দর্শক টানা অসম্ভব। ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত ছবির সঙ্গে এক কোটি টাকায় নির্মিত ছবির প্রতিযোগিতা হয় না।
হিন্দি ছবি আমদানি করলে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এ দেশের প্রযোজকেরা আর অর্থলগ্নি করবেন না। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যাবে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে।
চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে হলে হিন্দি ছবি আমদানি নয়, অতিসত্বর এফডিসিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিটিভির মতো এফডিসিও একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
এফডিসিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে সরকার অধিক পরিমাণে লাভবান হবে; তেমনি কারিগরি উন্নয়নের ফলে দেশীয় নির্মাতাদের উন্নত প্রযুক্তির জন্য ভারতে যেতে হবে না। এতে করে যেমন নির্মাণব্যয় অনেক কমে যাবে, তেমনি ভালো মানের ছবি নির্মাণ হলে হিন্দি ছবি আনার কথা চিন্তাও করতে হবে না।
মো. শওকত আলী
চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও সাহিত্যিক।
shawkat.togor@yahoo.com

প্রতিযোগিতার সাহস হারালে কি চলে?
স্বনামধন্য তিন চলচ্চিত্র-নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও অমিতাভ রেজার ‘প্রতিযোগিতা নয়, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা’ শীর্ষক লেখাটির সার কথা, তাঁরা ভারতীয় চলচ্চিত্র আমাদানির পক্ষে নন।
একটি সুবিদিত বিষয় হলো, আমি যা দেখতে চাই, খেতে চাই, পড়তে চাই তা বিবেচনায় রেখেই পণ্য বানানো হয় আমার জন্য, হাজির করা হয় আমার দুয়ারে—হোক তা স্বদেশি বা বিদেশি। কারণ, যাঁরা পণ্য বানান ও বিপণন করেন, তাঁদের ওটা ব্যবসা, জীবিকা, অর্থাৎ এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্ক টাকা-পয়সার। টাকা-পয়সার সঙ্গে নৈতিকতার, দেশপ্রেম বা স্বজাতি চেতনার সম্পর্ক এই দেশে কম দেখা যায়। এই সাধারণ বাস্তবতা মনে রেখে উচ্চমার্গীয় সিনেমা-বুঝমান দর্শকদের কথা বাদ দিলে এই দেশের আমদর্শক শাহরুখ-ক্যাটরিনা-কারিনাদের অভিনয়, ফাইট, নর্তনকলা যেমন টিভি-ডিভিডিতে দেখেন, তেমনি সিনেমা হলের বড় পর্দায়ও দেখতে চাইবেন। তাহলে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি করা না-করার এই বিতর্কে এ দেশের চলচ্চিত্র-দর্শকদের বিবেচনা বাদ দিলে কি চলবে? শুধু হল-মালিক আর চলচ্চিত্রশিল্পের নিমার্তা-কলাকুশলীদের পারস্পরিক স্বার্থ-প্রতিস্বার্থগত দ্বন্দ্ব নয়, বিষয়টিতে চলচ্চিত্রের দর্শকদেরও তো কিছু বক্তব্য থাকতে পারে। তারাও তো একটি পক্ষ। কিন্তু তিন চলচ্চিত্র-নির্মাতার উপরিউক্ত লেখায় দর্শকদের বিষয়টি বিবেচনায়ই আনা হয়নি। এর মধ্যে দর্শক যেন কেউই নয়।
সিনেমা হল মরে যাচ্ছে, সিনেমা হল বাঁচাতে হবে—এই পরিপ্রেক্ষিতে তিন চলচ্চিত্র-নির্মাতার প্রশ্ন, হল বাঁচাতে হবে কেন? উত্তর তাঁরাই দিয়েছেন—সিনেমার জন্য। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর অন্য রকমও তো হতে পারে, যা তাঁদের পছন্দ হবে না। যেমন, এ দেশের সিনেমা হলগুলোর মালিকেরা চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচানোর চিন্তা হয়তো করছেন না, তাঁদের উদ্দেশ্য প্রথমত পেট বাঁচানো। হল ব্যবসায় এখন আর আগের মতো লাভ হচ্ছে না, এর প্রধান কারণ মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের স্বল্পতা। এই স্বল্পতার দায়ভার তো কিছু মাত্রায় হলেও চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের নিতেই হবে। সিনেমার প্রদর্শনগৃহ যদি না বাঁচে, তাহলে কথিত আর্টফিল্ম বা শিল্পমান-উত্তীর্ণ চলচ্চিত্রের কথা বলি আর বাণিজ্যিক সিনেমার কথাই বলি—কিছুই বাঁচবে না। সুতরাং ‘সিনেমা হল ভেঙে শপিংমল করাই ভালো’—এ ধরনের মন্তব্য কি অবিমৃশ্যকারিতা হয়ে গেল না?
লেখকত্রয় ভারতীয় সিনেমা আমদানি করার বিপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন, আমদানির ফলে যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, তা হবে বিপজ্জনক রকমের অসম প্রতিযোগিতা। আরও বলেছেন বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি হুমকির কথা। কিছু দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের প্রটেকশন বা সুরক্ষার দৃষ্টান্ত দিয়ে তাঁরা বলেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাজারকেও সুরক্ষিত রাখতে হবে।
কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে না? তৈরি পোশাকশিল্প, বিদেশি শ্রমবাজার, টিভি-বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে, তাহলে শুধু চলচ্চিত্র কেন খোলা মাঠে একলা খেলতে চাইবে চিরটা কাল? সিনেমা হলগুলোর মালিকের বাংলা ছবির বদলে হিন্দি ছবি চালাবেন—এই ভয়ে? আসলে আমাদের চলচ্চিত্র-নির্মাতারা প্রতিযোগিতা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছেন কয়েক যুগের ফাঁকা মাঠে একলা বিচরণ করতে গিয়ে। আমরা মনে করি, ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হলে হল-মালিকেরা প্রথমে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রই বেছে নেবেন। হিন্দি চলচ্চিত্রের দাপটে কি কলকাতার বাংলা ছবি প্রেক্ষাগৃহ পাচ্ছে না? অথবা তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম ছবি? হিন্দি ভাষার বাইরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ভাষায় যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো কি ভারতের মধ্যেই হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও টিকে নেই, বা বিকশিত হচ্ছে না?
আর সংস্কৃতির প্রসঙ্গে বলতে গেলে বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে সিনেমা হলে হিন্দি চলচ্চিত্র দেখা না গেলেও সারা দেশে ঘরে ঘরে হিন্দি চলচ্চিত্র ও ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের দর্শক-সমঝদারের অভাব নেই। সুতরাং আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষতি যদি কিছু হয়ে থাকে তা তো চলচ্চিত্র আমদানি ছাড়াই হয়ে চলেছে। সিনেমা হলে হিন্দি ছবি দেখানোর ফলে নতুন করে আর কী ক্ষতি হবে?
মাহমুদুল হাসান রনি, ঢাকা।

আমাদের চলচ্চিত্রের মুক্তি
‘ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির নিষেধাজ্ঞা’ শিরোনামে মশিউল আলমের লেখা এবং তারপর তিনজন চলচ্চিত্র-নির্মাতার ‘প্রতিযোগিতা নয়, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা’ শিরোনামের যৌথ প্রতিক্রিয়া পড়ে সুদূর মফস্বল থেকে লিখছি।
ধরুন, আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট র‌্যাংকিংয়ে ‘নয়’ নম্বর বলে ‘এক’ নম্বর দল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলতে রাজি হলো না। বিসিবি-প্রধান বললেন, ‘এটা তো অসম প্রতিযোগিতা, নামলেই হারব’, তখন ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? আইসিসি তো বলেই বসবে, ‘যা ব্যাটা, আইসিসি ট্রফি খেল গিয়ে...।’ প্রকৃতপক্ষে এটাই হচ্ছে ভয়ের কথা। আমরা নিজেদের চলচ্চিত্র নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতেই ভয় পাচ্ছি। নিজেদের কীর্তিতে ভরসা নেই। আর যেহেতু আমরা শিখতে চাই না, তাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিরও মুখোমুখি হতে চাই না।
দেশের সিংহভাগ শিল্পী-সংগঠক তিন ‘ব’-এর অনুসারী। অর্থাৎ বানালাম, বিলালাম, বাহবা পেলাম। অথচ শিল্পচর্চায় প্রত্যেক কুশলী স্রষ্টা-কর্মীর সমান্তরাল দায়িত্ব হচ্ছে ভোক্তার রুচিটাকে গড়ে দেওয়া। রুচিবৈকল্য হচ্ছে শিল্পী-সংগঠকের ধারাবাাহিক ব্যর্থতার ফল। কিন্তু আমাদের শিল্পী-সংগঠকেরা তা মানলে তো! যত প্রোডাকশন, তত মুনাফা।
‘৩৮ বছরের সুরক্ষা’ এ দেশের চলচ্চিত্র-দর্শকের রুচিকে রীতিমতো ভাগাড়ের রূপ দিয়েছে। অপরদিকে যাঁদের চলচ্চিত্র বানানোর (মূলধারার) পয়সা নেই, তাঁরা বিকল্প ধারার অদেখা-অচেনা চলচ্চিত্রজগতে মশগুল থেকে ‘৩৮ বছরের সুরক্ষা’-এর আবরণে কুড়িয়েছেন পুরস্কার, প্রশংসা। তা ছাড়া বর্তমানে যাঁদের আমরা একটু ‘সৃজনশীল’ বলে জানছি, তাঁদের ভেতরও দায়বদ্ধতার বড় অভাব। তাঁরা তরুণ প্রজন্মের রুচিকে ইচ্ছেমতো দলাই-মলাই করছেন। দু-তিনটি বিজ্ঞাপনচিত্র বানিয়ে অথবা গান লিখে তাঁরা সিনেমা-নির্মাতা হিসেবে অভিষেক নিচ্ছেন। ঝোঁকটা কোন দিকে, পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের সিনেমাজগতের পুরোধা হয়ে যাঁরা ‘বসলেন’, প্রকৃত অর্থে তাঁদের মেধার ঘাটতি ছিল। তাঁরা একটা শূন্যতার সুযোগে সিনেমা-অঙ্গন জাঁকিয়ে বসলেন। প্রকৃত মেধাবী নির্মাতারা ব্যর্থ হতে হতে এফডিসিকে ‘ওয়ালাইকুম’ বলতে বাধ্য হলেন। এর ফলে যে মহলটি খুশি হয়েছিল, তারাই আজ ‘বিদেশি চলচ্চিত্রের আগ্রাসন’ গন্ধে আন্দোলনে নেমেছে। কয়েক দিন আগেই সদ্যনির্মিত জাগো সিনেমার পরিচালক বললেন বুকিদের দৌরাত্ম্যের কথা। এঁরাই নাকি এখনকার বাংলা-সিনেমার প্রযোজনায় টাকা খাটান। অন্যদের সিনেমাকে হল পর্যন্ত গড়াতে দেন না। জাগোর পরিচালক তাঁর টিভি সাক্ষাৎকারে সরকারের প্রতি সেদিন আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বুকিদের সিন্ডিকেট ভাঙার।
আমরা কি এই জিম্মাবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারি না, নাকি চাই না? অদক্ষতার কারণে কাউকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিলে তার পেটে কি লাথি দেওয়া হয়?
অনিরুদ্ধ কর
হাসপাতালপাড়া, কুড়িগ্রাম।

সংস্কৃতির কোনো সীমারেখা নেই
আমাদের দেশে কিছু লোক আছেন, যাঁরা তাঁদের বংশের ইতিকথা বলতে গিয়ে বলেন মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, ইরান, আরব, তুরস্ক দেশের কথা। বলেন যে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা সেসব দেশ থেকে এসেছেন। তাঁদের ধারণা, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা ভারতবর্ষ জয় করে বাদশাহী কায়েম করেছিলেন। ব্রিটিশরা তাঁদের কাছ থেকে দেশটিকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তাই তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতিতে আদি পরিচয় মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির পরিচয়ে গর্ববোধ করেন।
এখানেই তাঁদের সংস্কৃতি-বিভ্রাট ঘটে। তাঁরা মনে করেন, এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের একটু হলেও বিভাজন থাকা দরকার। বস্তুত এ কারণেই ভারতবর্ষ আজও বিভক্ত। ব্রিটিশরা ধুরন্ধর বলে ভারতবর্ষের এই আসল জায়গাটাতে হাত দেয় এবং এটাকেই কাজে লাগিয়ে ভারতবর্ষ শাসন করে।
এই আদি ধারণার অনুসারীরা চান, এ দেশের সংস্কৃতিতে সামান্য হলেও একটু বিভক্তি থাকুক, যেরকমটি ছিল পাকিস্তান আমলে। এই দর্শনের কারণে পাকিস্তান নামের শিশুটি পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশেও যাঁরা এ নিয়ম চালু করতে চান, তাঁরাও পাকিস্তানের ভ্রান্ত পথে পা বাড়াচ্ছেন। সংস্কৃতির কোনো বাঁধন নেই। নেই কোনো সীমারেখা। ভালোটাই টিকে থাকবে, খারাপটা পথ হারাবে। ভারতীয় সংস্কৃতি মুক্ত বলেই কত জাতির আক্রমণ সত্ত্বেও টিকে আছে তার আপন মহিমায়। আর পাকিস্তানের ভ্রান্ত দর্শনের কারণে সারা বিশ্ব আজ আল-কায়েদার আক্রমণের শিকার।
গত ১০ মে প্রথম আলোয় তিন চলচ্চিত্রকার লেখক যৌথভাবে ‘প্রতিযোগিতা নয়, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা’ শিরোনামে একটি প্রতিক্রিয়া লিখেছেন। তার আগে মশিউল আলমের লেখা ‘ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির নিষেধাজ্ঞা’ শিরোনামে একটি কলাম ছাপা হয়েছিল। তিন চলচ্চিত্রকারের যৌথ লেখাটির এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘যদি ভারতীয় ছবির পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্যই সিনেমা হলকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে তো সিনেমা হল ভেঙে ফেলে শপিং কমপ্লেক্স করাই ভালো।’ পড়ে মনে হলো, কী মারাত্মক কথা! এ যে দেখছি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো ব্যাপার। সারা জনম পাকিস্তান এ কাজটিই করেছে। লাভ হয়েছে কী? বাংলাদেশকে বিকলাঙ্গ করতে চেয়েছিল। পেরেছিল কি? পাকিস্তান বাংলাদেশকে বিকলাঙ্গ করতে গিয়েই তো তার অঙ্গচ্ছেদ ঘটেছে।
তিন চলচ্চিত্রকার লেখক সমস্বরে প্রথমে বলেছেন ভারতীয় ছবি আমদানির বিরুদ্ধে। মনের আসল কথাটা প্রথমেই বেরিয়ে পড়লে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে পরে বলেছেন হিন্দির কথা। ওমা, এই সেদিন না একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস পালন করেছি। সেখানে বলা আছে, ‘আমার ভাষা আমার গরব, তোমার ভাষাও আমার গরব।’ তাহলে তো আর কোনো ভাষাই ম্লেচ্ছ রইল না। হিন্দি সিনেমাও পরিমিত মাত্রায় আমদানি হলে আমি বিশ্বাস করি, যাঁরা খাঁটি বাঙালি, তাঁরা বাংলা ছবির প্রতিই আকৃষ্ট হবেন। তবে হ্যাঁ, সেটা হতে হবে সম্পূর্ণ বাঙালি সংস্কৃতির চাদরে মোড়া; অবয়ব, আর মনটা বাঙালি রসে থাকবে পরিপূর্ণ।
তিন লেখকের শেষমেশ আপসনামা: হিন্দির সঙ্গে লাতিন, স্প্যানিশ, জার্মান, কোরিয়ান, ইরানি ছবি আনুপাতিক হারে দেখাতে হবে। আমাকে খুবই ব্যথিত করেছে তাঁদের এই তালিকায় পাকিস্তান নামটি না থাকায়। তারাও আমাদের শত্রু নয়; শুধু আল-কায়েদা ভাবনাটাই শত্রু।
রাধাকান্ত রায়, ইস্কাটন, ঢাকা।

সিনেমা হল ভেঙে শপিং কমপ্লেক্স!
প্রথম আলোকে ধন্যবাদ ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির বিষয়ে নানা রকমের মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ৬ মে ‘ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির নিষেধাজ্ঞা’ শিরোনামে মশিউল আলমের একটি লেখা ছাপা হওয়ার পর ১০ মে চলচ্চিত্র-নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও অমিতাভ রেজার যৌথ প্রতিক্রিয়া ‘প্রতিযোগিতা নয়, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা’, ১২ মে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি শওকত জামিলের একটি ভিন্নমত এবং ১৭ মে ছাপা হয়েছে চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াতের লেখা প্রতিক্রিয়া—‘চলচ্চিত্রের দুর্দশার জন্য আসলে দায় কার?’ এই খোলামেলা তর্ক-বির্তক বেশ উৎসাহব্যঞ্জক একটি ব্যাপার।
মশিউল আলম তাঁর লেখাটিতে প্রস্তাব রেখেছিলেন, এখন সীমিত মাত্রায় ভারতীয় ছবি আমদানি করা যায় কি না, তা বিবেচনা করার সময় এসেছে। এই বক্তব্যকে সমর্থন করি। অবশ্যই এখন বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে, এই ৩৮ বছর পর এখন যদি বছরে সীমিতসংখ্যক ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি করা হয় এবং সিনেমা হলগুলোতে প্রদর্শনসীমা নির্ধারণ করে মুক্তি দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প কি ধ্বংস হয়ে যাবে? নাকি ভালো, দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ও চেষ্টা দেখা দিতে পারে? কোনো প্রটেকশানই তো অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না।
এ বিষয়ে চলচ্চিত্র নিমার্তাদের দিক থেকে প্রবল প্রতিবাদ লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু চলচ্চিত্রশিল্পে চলচ্চিত্র-নির্মাতারা একটি পক্ষ মাত্র। আরও দুটি পক্ষ কিন্তু আছে—সিনেমা হলগুলোর মালিকেরা ও সাধারণ দর্শকসমাজ। তাঁদের মতামতও অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। সব পক্ষের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া বা কোনো একটি পক্ষের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।
সীমিত পরিমাণে উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র আমদানি করা যায় কি না—এটা সবাই ভেবে দেখুন। এ ছাড়া সিনেমা হলগুলো কীভাবে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে, সে বিষয়ে হল-মালিকদের বক্তব্যও শোনা উচিত। সিনেমা হল ভেঙে শপিং কমপ্লেক্স বানাব, তবু ভারতীয় চলচ্চিত্র আসতে দেব না—এ রকম মনোভঙ্গি থেকে শেষ বিচারে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের কোনো উপকার হবে না, ভারতীয় চলচ্চিত্রেরও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।
শফিক আহমেদ
পুরানা পল্টন, ঢাকা।

চলচ্চিত্রশিল্পের সংকট কাটবে কিসে
প্রথমে সাংবাদিক-সাহিত্যিক মশিউল আলম, পরে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র-নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামসহ তিন চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা এবং সর্বশেষ চলচ্চিত্র-নির্মাতা কাজী হায়াত। ভারতীয় ছবি আমদানির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক বেশ জমেছে বলে মনে হচ্ছে।
ভারতীয় ছবি আমদানির বিপক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে তিন চলচ্চিত্র-নির্মাতার বক্তব্যে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস বুঝি এবার বদলে যেতে শুরু করেছে। কারণ তাঁদের ভাষায়, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি প্রজন্মের আবির্ভাব হতে চলেছে, যাঁরা সিনেমা বোঝেন এবং হাতে-কলমে টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করে সে প্রস্তুতিও নিচ্ছেন; তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন, আশির দশকে আরও সম্ভাবনা জাগিয়ে এ দেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তখন অনেকেই ছবি নির্মাণ শুরু করেছিলেন। এখন সেই চলচ্চিত্র আন্দোলনের ফসল আঙুলে গোনা যায়। সত্তরের দশকেও চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অনেক কর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণে অংশ নেন। মসিহউদ্দিন শাকের, শেখ নিয়ামত আলী, বাদল রহমান প্রমুখ নির্মাতার তৈরি ছবি দেশে-বিদেশে পুরস্কৃত ও প্রশংসিতও হয় সে সময়। এসব সত্য স্মরণে না রাখার অর্থ নিজেকে ইতিহাস-ভূগোলহীন করে ফেলা। সচেতন চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের কাছে তা কেউ আশা করে না।
প্রথম তিন নির্মাতা যে ধরনের ছবি নির্মাণ করেন, তাঁদের ছবি প্রদর্শনীর জন্য টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সসহ মধুমিতা-বলাকার মতো সিনেমা হল রয়েছে। কাজেই দেশের গড়পড়তা সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে তাঁদের কিছু যায় আসে না। আর চলচ্চিত্র-নির্মাতা কাজী হায়াতের বক্তব্য পড়ে মনে হলো, যত দায় কেবল সিনেমা হল-মালিকদের, প্রযোজক-পরিচালকেরা যেন ধোয়া তুলসীপাতা।
চলচ্চিত্রশিল্পের সংকট কাটাতে হলে চলচ্চিত্রশিল্পের খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এফডিসির একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে এখন বছরে গড়ে ৭০ থেকে ৭২টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় (সূত্র: এফডিসি ওয়েবসাইট)। অধিকাংশই নির্মিত হয় সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির কারিগরি-সুবিধা কাজে লাগিয়ে। চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতির ভাষ্যে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এর অন্তত এক-তৃতীয়াংশ খরচ হওয়ার কথা কারিগরি খাতে, যা ৩০ লাখ টাকার কম নয়। এই টাকা এফডিসির খাতেই যাওয়ার কথা। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে এফডিসি থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ছয় কোটি ৩৮ লাখ টাকা (সূত্র: এফডিসি ওয়েবসাইট)। বাকি সিংহভাগ টাকাই প্রযোজকদের কাছে বকেয়া পাওনা আছে। এফডিসি কর্তৃপক্ষ কখনোই পুরো বকেয়া আদায় করতে পারে না বা করে না। আর প্রযোজক-পরিচালকেরাও ভিডিও পাইরেসি, ছবি ফ্লপ ইত্যদি অজুহাতে বছরের পর বছর বকেয়া পরিশোধ করেন না। এভাবে এফডিসিকে জিম্মি করে চলচ্চিত্রশিল্পকে রুগ্ণ শিল্প হিসেবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
কাজেই শুধু ভারতীয় ছবি আমদানিই আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পকে সংকটমুক্ত করবে না; চলচ্চিত্র নির্মাণ-ব্যবস্থাটিকেও প্রতিযোগিতামূলক করতে এফডিসিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। এফডিসির পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও চলচ্চিত্র নির্মাণের কারিগরি অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ জন্য উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। আর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ভারতীয়সহ অন্যান্য দেশের ছবি আমদানির সুযোগ দিতে হবে। প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করা এবং আমদানি করা ছবির মধ্যে বছরে নির্দিষ্টসংখ্যক শিল্পসম্মত ছবি থাকতে হবে—এমন শর্ত রাখা যেতে পারে। সর্বোপরি চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এই নীতিমালায় চলচ্চিত্র নির্মাণ, আমদানি-রপ্তানি, প্রদর্শন—এসব ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ভূমিকা, চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, চলচ্চিত্র উৎসব ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
আমাদের চলচ্চিত্র টিকে থাকবে, না বিলুপ্ত শিল্পের মর্যাদা নিয়ে জাদুঘরে ঠাঁই করে নেবে, সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও একে অন্যকে দোষারোপ করে এই দায় এড়াতে পারেন না।
তারেক আহমেদ
চলচ্চিত্রকর্মী, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.