রাবিতে কালো বিড়াল by ড. সফিকুন্নবী সামাদী

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে পরিবর্তন আসে। প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষক সমাজের সদস্যদের। আমরা আশা করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটবে।


কিন্তু প্রশাসনের ভেতরে থাকা কালো বিড়াল জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের প্রশাসনের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গোপন করে।
বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১১ মে ২০০৯ সালের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ৪২৪তম সিন্ডিকেট সভায় রাবি প্রশাসন জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি কঠোর পরিশ্রম করে একটি রিপোর্ট তৈরি করে এবং তা যথাসময়ে সিন্ডিকেটে পেশ করা হয়। প্রথা অনুযায়ী রিপোর্টটি সিন্ডিকেটের সদস্যদের সামনে পড়ে শোনানোর কথা। কিন্তু উপাচার্য তা পড়ে শোনানো তো দূরের কথা, সদস্যদের রিপোর্টটি স্পর্শ পর্যন্ত করতে দেননি। সিন্ডিকেট সদস্যদের চাপের মুখে উপাচার্য রিপোর্টের কপি সদস্যদের দেখানোর জন্য সিন্ডিকেট সভায় অঙ্গীকার করলেও তা রক্ষা করেননি। এ অবস্থায় সিন্ডিকেট সদস্যরা বাধ্য হয়ে না দেখেই ভিসির কথার ভিত্তিতে রিপোর্টটি পাস করেন। বিধি অনুযায়ী এরপর তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল। তা না করে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি ফেরত পাঠায় এবং বলে, বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সেহেতু এই বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিতে হবে। এবার সুযোগ বুঝে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রিপোর্টটি হিমাগারে পাঠিয়ে দেয়। তদন্ত কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, রিপোর্টে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক সুপারিশ করা হয়েছিল। বর্তমান প্রশাসন জামায়াত-বিএনপি জোটের সময়ের দুর্নীতি শুধু গোপনই করেনি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্তদের পুরস্কৃতও করেছে। এই তদন্ত কমিটির একজন সদস্য দুঃখ করে বলেছেন, 'এত কষ্ট করে রিপোর্টটি তৈরি করলাম, কিন্তু কী হলো!' বিগত সরকারের সময়ের দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্টটি সম্পর্কে আমরা জানতে পারলে আর কিছু না হোক, অন্তত দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করতে পারতাম। ছাত্রশিবিরের হাতে নিহত ছাত্রলীগ নেতা শহীদ ফারুক হোসেনের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পেত।
সিন্ডিকেট হলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বডি। সিন্ডিকেট কর্তৃক কোনো সিদ্ধান্ত পাস হওয়ার পর তা পাবলিক হয়ে যায়। যেকোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা-শিক্ষার্থী সেই সিদ্ধান্ত দেখতে চাইলে সাধারণত তা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি প্রশাসনের কাছে দেখতে চেয়ে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করে চিঠি দিয়েছি। প্রথম পত্রের উত্তর না পাওয়ায় দ্বিতীয়বার চিঠি দিয়েছি। রেজিস্ট্রার মহোদয়কে মৌখিকভাবে বলেছি। তার পরও রিপোর্টটি দেখতে দেওয়া হয়নি। রিপোর্টে এমন কী আছে যে তা গোপন করা হচ্ছে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী তথ্য পাওয়ার অধিকার সবার আছে। সঠিক তথ্য প্রশাসনকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদপত্রকর্মীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছিলাম। তাঁরাও জানিয়েছেন, রিপোর্টটি তাঁরা দেখার সুযোগ পাননি। উপাচার্য মহোদয় কার স্বার্থে তদন্ত রিপোর্টটি গোপন করলেন? রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত করার অঙ্গীকার বর্তমান সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়। সরকারের ভেতরের দুর্নীতির অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যদিও রেলমন্ত্রীর সঙ্গে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা তদন্ত কমিটি পায়নি। সরকার শুধু দুর্নীতিমুক্ত থাকার চেষ্টা করলে হবে না, বিগত সরকারের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন শুধু জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি চাপা দেয়নি, বিভিন্ন সময় নানাভাবে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের পুরস্কৃত করেছে। 'একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়' গ্রন্থে যাদের নাম রয়েছে, তারাও পুরস্কারের তালিকায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে উপাচার্য বরাবর ২২ জুন ২০১০ সালে একটি চিঠিতে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় রাবিতে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। প্রশাসন থেকে চিঠিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করা হয়েছিল। পরে সিন্ডিকেট থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমি এই কমিটির সদস্য ছিলাম। আমরা যথাসময়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছি। এ সম্পর্কে জনসংযোগের প্রশাসক বলেন, এখন পর্যন্ত রিপোর্টটি আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার নিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু সরকার মনোনীত উপাচার্য মহোদয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাতক-দালালদের অপরাধ সংবলিত রিপোর্ট পাঠাতে যখন বিলম্ব করেন, তখন সরকারের উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিয়ে আমাদের মনে সংশয় জাগে, সত্যিই কি সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাপ্ত করে যেতে পারবে? বর্তমান সরকারের অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ রয়েছে। যার ওপর ভিত্তি করে মহাজোট আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারে। কিন্তু সরকারের ভেতরে থাকা কালো বিড়াল মহাজোটের অনেক শুভ উদ্যোগ সমূলে নষ্ট করে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Samadi1963@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.