অভাব, যৌতুক, পরকীয়া প্রেম, নেশায় আসক্তিই মূল কারণ-নগরে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ by একরামুল হক

এক. নগরের পাঁচলাইশ এলাকার শিক্ষিত তরুণী সামিনা হাসানের (ছদ্মনাম) সঙ্গে ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে আরিফুর রহমানের (ছদ্মনাম) বিয়ে হয় বছর তিনেক আগে। তাঁদের একটি ছেলে সন্তান আছে। সামান্য ভুল-বোঝাবুঝি থেকে বছর খানেক আগে দুজন আলাদা হয়ে যান। একপর্যায়ে সামিনা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। সম্প্রতি তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে।


দুই. ইপিজেড এলাকার বাসিন্দা জরিনা বেগম (ছদ্মনাম) একই এলাকার সাহাবউদ্দিনকে ভালোবেসে বিয়ে করেন বছর দেড়েক আগে। দুজনই ইপিজেডের পোশাক কারখানার শ্রমিক। পরে যৌতুকের দাবিতে সাহাবউদ্দিন জরিনার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালালে জরিনা বিবাহবিচ্ছেদের চিঠি পাঠান। তাঁদেরও বিচ্ছেদ ঘটেছে।
শিক্ষিত পরিবারের সামিনা কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের জরিনার মতো অনেকেই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে চিঠি পাঠাচ্ছেন। বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন ও হার দিন দিন বাড়ছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে পাওয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর দুই হাজার ৬১১টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে। এর আগের বছর (২০১০ সালে) জমা পড়ে দুই হাজার ১৬২টি আবেদন। ওই বছরের তুলনায় গত বছরের আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে ৪৩৮টি।
সূত্রমতে, ৭০ শতাংশের বেশি বিবাহবিচ্ছেদের চিঠি আসে স্ত্রীর পক্ষ থেকে। আর বিচ্ছেদের প্রায় ৭০ শতাংশই ঘটে নিম্নবিত্তদের মধ্যে। এর মধ্যে বিচ্ছেদের জন্য পাঠানো চিঠি প্রত্যাহারের সংখ্যা প্রায় ৩ শতাংশ।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, বিবাহবিচ্ছেদের চিঠি পাঠানোর তিন মাসের মধ্যে করপোরেশনের সালিসি পরিষদ উভয় পক্ষকে ডেকে মীমাংসার চেষ্টা চালায়। দুই পক্ষ সমঝোতায় সম্মত হলে বিচ্ছেদের চিঠি প্রত্যাহার করা হয়। তবে চিঠি প্রত্যাহারের হার তিন শতাংশের বেশি হবে না।
জানা যায়, নগরের ১২টি থানা এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ ঘটেছে বন্দর এলাকায়। গত বছর বন্দর এলাকায় ৩১৫টি এবং এর আগে ২০১০ সালে ৩২০টি বিচ্ছেদ ঘটে। এর পরে রয়েছে হালিশহর ও পাহাড়তলী এলাকার অবস্থান। হালিশহরে গত বছর ৩০৫ এবং আগের বছর ৩০০টি, পাহাড়তলীতে গত বছর ২৪৭টি এবং আগের বছর ২৫০টি বিচ্ছেদ ঘটেছে। এই দুটি এলাকায়ও শ্রমিকদের বসবাস বেশি বলে এমন হচ্ছে।
সবচেয়ে কম বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে কর্ণফুলী এলাকায়। গ্রাম বলে এই এলাকার মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন সবচেয়ে মজবুত। তাই বিচ্ছেদের সংখ্যাও সেখানে কম। গত বছর কর্ণফুলী এলাকায় ৪২টি বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২০টি। এর আগে ২০০৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য সর্বমোট এক হাজার ১৪৮টি চিঠি জমা পড়ে। এগুলোর মধ্যে ৮১টি প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৬ সালের তুলনায় ২০০৭ সালে বিচ্ছেদ বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, অভাব, যৌতুক, পরকীয়া প্রেম, নেশায় আসক্তি প্রভৃতি বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। এসব কারণে প্রথমদিকে ঝগড়া-বিবাদ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামী তাঁর স্ত্রীর ওপর অত্যাচার চালান। তবে স্ত্রীর অমানবিক আচরণেরও শিকার হচ্ছেন অনেক স্বামী। বিশেষ করে শিক্ষিত ও বিত্তশালী পরিবারে স্বামীরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ইদানীং মুঠোফোনে বাইরের লোকজনের সঙ্গে আলাপ এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকও সংসারে অশান্তি সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষিত ও ধনাঢ্য পরিবারে এই সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নারীনেত্রী রেহেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারী শিক্ষার অগ্রগতি, কর্মস্থানে সম্পৃক্ত হওয়া তথা ক্ষমতার কাঠামোয় নারীরা যুক্ত হওয়ায় কিছু সংখ্যক পুরুষ তা মেনে নিতে পারছেন না। এতে পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে।’
রেহেনা বেগম আরও বলেন, ‘আগের দিনে সমাজে নারীরা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হলেও সবকিছু তাঁরা চোখ বন্ধ করে সহ্য করতেন। এখন ধনাঢ্য এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরাও আত্মনির্ভরশীল হওয়ায় কিছু সংখ্যক পুরুষ এটাকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন। তবে বিচ্ছেদের হার বেড়ে যাওয়াকে আমি নেতিবাচক হিসেবে দেখছি না। স্বামীরা স্ত্রীর প্রতি সম্মান দেখালে বিচ্ছেদের হার কমে যাবে।’
বিচ্ছেদের চিঠি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চট্টগ্রামের পোশাকশিল্প কারখানার নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেন। তাঁদের বিয়েই টেকে কম। বিশেষ করে বিয়ের পর স্বামী যৌতুক দাবি করে স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালান।
এ কারণে কিছুদিনের মধ্যে সংসারে ভাঙনের সুর বেজে ওঠে। নগরের বন্দর থানাধীন ইপিজেড এলাকার বিভিন্ন কারখানায় লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। আর তাঁদের বিয়েই বেশি দিন টিকছে না।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান একজন হাকিম। চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতের একজন মনোনীত হাকিম ক্ষমতাবলে এই সালিসি পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি উভয় পক্ষকে ডেকে সমঝোতায় আনার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলে উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটান।

No comments

Powered by Blogger.