সমকালীন প্রসঙ্গ-নির্বাচন কমিশনের কিছু সিদ্ধান্ত by এম সাখাওয়াত হোসেন

আগামী নির্বাচনের আর বেশি সময় নেই। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সময় ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের কাজ সহজ করে দিয়েছেন। তবে কোন ধরনের সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হবে সে বিষয়ের রাজনৈতিক মীমাংসা হতে সময় লাগবে।


অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানের ধারা ১২৩ যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ও নির্বাচন করতে হলে RPO-1972-তে আরও কিছু ধারার সংযোজন অবশ্যই করতে হবে



আমরা বিগত নির্বাচন কমিশন (২০০৭-২০১২) আমাদের মেয়াদকালে প্রথম দুই বছর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক সংস্কার করেছি, যা দেশবাসী মাত্রই জানেন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার নানা সংস্কারের মধ্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল নির্বাচন সংক্রান্ত আইনগুলোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং সংযোজন। আমরা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (RPO-1972)-এর অধিকতর সংস্কার করেছি। RPO-তে প্রায় ৮৫টি সংশোধনী, সংযোজন ও পরিবর্ধন করা হয়েছিল। ধারা ১২(১) এবং অধ্যায় ৬এ (Chapter VIA) সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল। যেহেতু RPO-ই জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিকল্পনা ও পরিচালনার মূল আইন, সে কারণে নির্বাচনে যাদের আমরা মূল শরিক মনে করেছি সেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ সংস্কার প্রস্তাব একাধিকবার চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তাদের সম্মতি এবং মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, সুশীল সমাজ, জাতীয় দৈনিক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তথা সম্পাদকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করা হয়েছিল। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন এ কাজের জন্য এত ব্যাপক আলোচনা এবং মতামত গ্রহণ করেনি।
আমরা ওই সময়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রণয়নের সুপারিশ করেছি। বাতিল করেছিলাম পূর্বতন আইন 'ভোটার তালিকা আইন-১৯৮২'। ওই আইনটি সম্পূর্ণ নতুন করে প্রণয়ন করার প্রয়োজন হয়েছিল, কারণ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পদ্ধতিগত ও কারিগরি পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে। আমাদের সুপারিশকৃত আইনটি প্রথমে অধ্যাদেশ আকারে এবং পরে ২০০৯ সালে সংসদে অনুমোদনের পর 'ভোটার তালিকা আইন-২০০৯' নামে জারি করা হয়। যেহেতু ভোটার তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য সংগঠন জড়িত নয়, সে কারণে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যেই এ পরিবর্তিত আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। ওই ভোটার তালিকা আইনে প্রবাসীদের ভোটার করার ধারা সংযোজন করে ২০১০ সালে সামান্য পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
ভোটার তালিকা প্রণয়নের সময় আমরা হালনাগাদের বিবেচনাও মাথায় রেখেছিলাম। পূর্বতন তালিকায় তেমন কিছু ছিল না বলেই আমরা প্রতি বছর হালনাগাদের বিধান রেখে ধারা ১১(১)-এ সময় নির্ধারণ করেছিলাম। সময়টি ছিল প্রতি বছর ২ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সময় বেঁধে দেওয়ার কারণে নির্বাচন কমিশন ওই সময়ের মধ্যেই হালনাগাদ করা আইনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়েছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা আরেকটি বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছিলাম, যেটি ছিল ২৪ বছর পর সংসদের ৩০০ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ। বিষয়টির সিংহভাগ রাজনীতিবিদরা সমর্থন করেননি এবং আদালত পর্যন্ত গড়ায়। যেহেতু এ কাজ নির্বাচন কমিশনকে প্রদত্ত সাংবিধানিক দায়িত্বের অন্যতম, তাই আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আদালতের রায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে পাওয়ায় সময়মতো নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পেরেছিল।
ওপরে বর্ণিত মোটাদাগের সংস্কার করে আমরা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করি। পরে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সব স্তরের স্থানীয় নির্বাচন ১৮ বছর পর উপজেলা নির্বাচনসহ সম্পন্ন করে বিশাল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। হয়তো অতীতে আর কোনো কমিশনের এত বিশাল অভিজ্ঞতা অর্জনের নজির নেই। এসব নির্বাচন করাতে গিয়ে আইনের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। ওইসব সমস্যার সহজ বিষয়গুলো তাৎক্ষণিকভাবে পরিপত্র দ্বারা সমাধান করলেও বেশ বড় আকারের সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে আইনগুলোর অধিকতর সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।
প্রথমে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ জটিলতার মধ্যে পড়েছিলাম। আমরা ভোটার তালিকা আইন ২০০৯-এর ধারা ১১(১) অনুযায়ী জানুয়ারির মধ্যে হালনাগাদ করতে পারিনি। কারণ ২০০৯-এর জানুয়ারিতে উপজেলা নির্বাচন এবং আরও পরে ২০১০, ২০১১, ২০১২-তে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং প্রায় চার হাজার ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচন নিয়ে অধিকতর ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের সময়ে মাত্র ২০০৯ সালের শেষদিকে ২০১০ সালসহ হালনাগাদ করতে পেরেছিলাম এবং মেয়াদের শেষ সময়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে হালনাগাদকরণের যে পরিকল্পনা করেছিলাম, যা এখন চলমান_ তাও সময়মতো শুরু করা যায়নি, কারণ তখনও নির্বাচনে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। সে সময়ে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ এবং আমাদের মেয়াদের প্রায় শেষ সময়ে কুমিল্লার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
যা হোক, জাতীয় সংসদ নির্বাচনী আইনের কিছু অসঙ্গতি আমাদের পর্যবেক্ষণে এবং নির্বাচনের পর লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা RPO-1972 আরও কিছু সংস্করণ, সংযোজন ও বিয়োজন সুপারিশ করে আবার শরিকদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করে মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে সুপারিশমালা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছিলাম। শুধু RPO-এর সংশোধনীই নয়, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে ভোটার তালিকার ধারা ১১(১)কে আরও কার্যকর ও বাস্তবমুখী করার জন্য আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের পরিবর্তে প্রতি বছর নির্বাচন কমিশনের সুবিধামতো সময় নির্ধারণের জন্য কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত রাখার সুপারিশ করেছিলাম।
আমরা সীমানা নির্ধারণের আইনেও পরিবর্তন আনতে সুপারিশ করেছিলাম। প্রায় ২৪ বছর পর ২০০৮ সালে সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে জনসংখ্যার পরিসংখ্যানের প্রেক্ষাপটে প্রত্যন্ত অঞ্চলের আসন কমিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে আসন বৃদ্ধি করতে হয়েছিল। ঢাকার ৭ আসনের পরিবর্তে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ১৩টি আসন দিতে হয়েছিল। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা ওই অভিজ্ঞতার আলোকে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম যথাক্রমে দেশের রাজধানী ও অর্থনৈতিক রাজধানী হওয়ার সুবাদে এখানে আসন সংখ্যা সবসময়ের জন্য যথাক্রমে ১০ এবং ২-এ নির্ধারিত রাখতে সর্বসম্মতভাবে সুপারিশ করেছিলাম।
উপরোলি্লখিত তিনটি আইন ছাড়া কমিশনের নিয়োগ পদ্ধতির ওপর আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছিলাম। যেমনটা আগেও বলেছি_ এসব আইনই বিভিন্ন শরিকের আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। মাত্র কয়েকদিন আগের খবরে প্রকাশ, আইন মন্ত্রণালয় ওইসব খসড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মতামত অথবা পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠিয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও পুনর্বিবেচনার কাজে হাত দিয়ে সুপারিশকৃত দু'একটি ধারার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পূর্বের অবস্থা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীনসত্তা, কাজেই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। বিগত কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। তবে তাদের এ বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত কোন প্রেক্ষাপট অথবা কোন বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তার বিশদ ব্যাখ্যা, যা পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে_ আমার বিবেচনায় যৌক্তিক মনে হয়নি। আমি এ বিষয়ের ওপর পাঁচ বছর এবং চার হাজারের ওপর নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে মতামত তুলে ধরতে চাই। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের কর্মকাণ্ড জনগণের জানার অধিকার রয়েছে, অন্যথায় নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার ঘাটতি হবে।
প্রথমে আলোচনা করতে চাই ভোটার তালিকার ১১(১) ধারাকে পূর্ববৎ বহাল রাখার নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে। আগেই উল্লেখ করেছি যে, ওই ধারায় প্রতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে হালনাগাদ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও আমরা এ ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম; কিন্তু বাস্তবতার আঙ্গিকে নির্ধারিত স্বল্প সময়ের মধ্যে সর্বতো সময় হালনাগাদ করা সম্ভব হয় না। প্রথমত, আমাদের অভিজ্ঞতায় বহু কারণে জানুয়ারিতে অনেক সময় হালনাগাদের কাজ শুরু করা সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ যেহেতু বর্তমানে হালনাগাদের কাজ চলছে; কিন্তু পূর্বতন ধারা বলবৎ থাকলে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আবার হালনাগাদ করার আইনি বাধ্যকতা থাকলে তা সম্পন্ন করা কমিশনের পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ ওই সময়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনে যে জনবল রয়েছে ওই জনবল দিয়ে এত অল্প সময়ে এই বিশাল কাজ সম্ভব নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এ ধারা পরিবর্তনে আমাদের সুপারিশ রদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেছে বলে মনে হয় না। বিবেচনা করলে সুপারিশকৃত ধারার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে যুক্তি তুলে ধরেছে তা ধোপে টেকে না। আমরা ১১(১) ধারায় যা সুপারিশ করেছিলাম তা ছিল বছরের সুবিধামতো সময়ে নির্বাচন কমিশন হালনাগাদ করার সময় নির্ধারণ করবে (হুবহু শব্দ নয়)। এ পরিবর্তন হলে নির্দিষ্ট সময়ের বাধ্যবাধকতা থাকে না এবং যে কোনো আইনি জটিলতায় পড়তে হবে না। ধারা অপরিবর্তিত থাকলে ওই ধারার ব্যত্যয় ঘটলে নির্বাচন কমিশনকে আইনি জটিলতায় পড়তে হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ধারা অপরিবর্তিত রাখার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে একজন কমিশনার বলেছেন, তারা মনে করেন যে, কমিশন আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের বাধ্যবাধকতাতেই থাকুক, অন্যথায় শিথিলতা আসতে পারে। আমার কাছে এ যুক্তি কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে হয়নি। আইনের এ ধারায় প্রস্তাবিত পরিবর্তন না আনলে উল্টো নির্বাচন কমিশনকে আইনের বাধ্যবাধকতার চাপে পড়তে হবে। হয়তো পড়তে হবে আইনি জটিলতায়, কারণ ওই স্বল্প সময়ের মধ্যে বর্তমান পদ্ধতিতে দেশব্যাপী যে হালনাগাদ করা যায় না সে অভিজ্ঞতা এ অল্প কয়েক মাসে বর্তমান কমিশনের হয়েছে বলে আমি মনে করি। কাজেই পূর্বতন কমিশনের সুপারিশকৃত ধারাটি বাদ দিয়ে পূর্বতন অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি অভিজ্ঞতার আলোকে নেওয়া হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তবে আমার মনে হয় তা পুনর্বিবেচনা করা উচিত হবে।
আমি দ্বিতীয় আরেকটি নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপর আমার মতামত তুলে ধরতে চাই। আমরা জাতীয় সংসদ এবং অন্যান্য নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে RPO-তে কয়েকটি নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব রেখেছিলাম। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ওইসব ধারা থেকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
RPO-তে যে অধিকতর সংস্কারের প্রস্তাব আমরা সুপারিশ আকারে চূড়ান্ত করেছিলাম সেগুলো বিগত জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রস্তুত করা হয়েছিল। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, আগামী নির্বাচন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালীকরণ এবং ব্যবস্থাপনায় আরও স্বচ্ছতা আনয়ন করা। এসব ধারা বহু বিবেচনা, বিশ্লেষণ এবং ২০০৭-০৮-এর ধারাবাহিকতায়_ কয়েকটি দল ছাড়া, প্রায় সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন মিডিয়ার সম্পাদকদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা এবং তাদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, নির্বাচনী ব্যয় তদারকি কমিটি গঠন প্রক্রিয়া। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ছিল সংসদ ভেঙে যাওয়া অথবা বর্তমান সাংবিধানিক ধারা মোতাবেক নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়ে কয়েকটি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগকে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা। আমাদের এসব প্রস্তাব সব রাজনৈতিক দলই গ্রহণ করেছিল। সর্বশেষ উলি্লখিত ধারায় আমরা মাত্র চারটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের_ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন (পূর্বতন সংস্থাপন), স্বরাষ্ট্র এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় উল্লেখ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এ ব্যবস্থা যে কোনো সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন হোক না কেন, এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পরামর্শ করে কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এই সংযোজন করা হয়েছিল নির্বাচনকে আরও সুষ্ঠু করার এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার প্রয়াসে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে এ ধরনের সংযোজনের প্রয়োজন হয়েছিল এবং এখনও আছে বলে মনে করি। কারণ অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও একতরফাভাবে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা নির্বাচন কমিশনকে পরে সংশোধন করতে বেগ পেতে হয়েছিল। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একাধিকবার একক সিদ্ধান্তে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করেছে। নির্বাচন কমিশনকে জানানোরও প্রয়োজন মনে করেনি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এককভাবে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করে কমিশনকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। এখনও তা-ই হয়েছে বলে মনে হয়। একটি জেলা সদরের পৌরসভা নির্বাচনের সময়সূচির পর একজন পুলিশ সুপারকে, যিনি সৎ এবং নিরপেক্ষ বলে পরিচিত ছিলেন_ নির্বাচন কমিশনের অগোচরে ছুটি নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। নির্বাচনী আইনে শুধু বদলির কথা বলা আছে_ ছুটির বিষয়ে কমিশনের পূর্বানুমতির উল্লেখ নেই। তাছাড়া নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের আগে চাকরির নথিপত্র তলব করার ক্ষমতাও নির্বাচন কমিশনের নেই। এসব মাথায় রেখেই এ সংযোজন করা হয়েছিল।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুপারিশকৃত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নতুন ধারা বাদ দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। RPO-1972-তে সর্বশেষ যে সংস্কার প্রস্তাব আলোচনার মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল সবই ছিল আমাদের অভিজ্ঞতার এবং বিভিন্ন শরিকের মতামতের ভিত্তিতে। কাজেই আমি মনে করি, RPO-1972-এর এসব পরিবর্তন অথবা সদ্য বিদায়ী কমিশনের সুপারিশ মনঃপূত না হলে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরিবর্তন করাই সমুচিত হবে।
আগামী নির্বাচনের আর বেশি সময় নেই। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সময় ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের কাজ সহজ করে দিয়েছেন। তবে কোন ধরনের সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হবে সে বিষয়ের রাজনৈতিক মীমাংসা হতে সময় লাগবে। অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানের ধারা ১২৩ যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ও নির্বাচন করতে হলে RPO-1972-তে আরও কিছু ধারার সংযোজন অবশ্যই করতে হবে। এমনকি রাজনৈতিক মীমাংসা হলেও আগামী নির্বাচনে নতুন মাত্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনার দিকগুলোর কথা মাথায় রেখেই নির্বাচনী আইনে অধিকতর সংশোধনী আনা প্রয়োজন। সংশোধনী আনতে হবে আচরণবিধিতেও। এসব কাজের জন্য নির্বাচন কমিশনের হাতে বেশি সময় নেই। আমি মনে করি, সে কাজ এখন থেকে শুরু করা উচিত।
জাতীয় নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়াতে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই যে আমাদের সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন শহরের জন্য আসন সংখ্যা ১৩ থেকে ১০-এ পাকাপোক্ত করার সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। একইভাবে চট্টগ্রামের জন্যও আসন সংখ্যা নির্ধারিত করা হয়েছিল। এ পরিবর্তনের খসড়াও হয়তো নির্বাচন কমিশন পুনঃপর্যালোচনা করছে। আমার সুপারিশ ছিল প্রত্যেকটি সিটি করপোরেশন এলাকায় সংসদীয় আসন নির্দিষ্ট করে রাখা। আমি মনে করি না এর কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।
যা হোক, আমি উপরোক্ত বিষয়ের অবতারণা করলাম এ কারণে যে, আমি মনে করি, অত্যন্ত কঠিন সময়ে আমরা সংস্কারের কাজ শেষ করে নির্বাচনগুলো করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি বর্তমান কমিশনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে। অন্যদিকে এসব সুপারিশ যে প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমরা করেছিলাম তা-ই সংক্ষেপে তুলে ধরলাম। এ মতামত নির্বাচন কমিশনকে এসব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে বলে আশা করি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hhintlbd@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.