অবিনশ্বর ও অয়োময়তার প্রতীক-একুশের চেতনা by মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

একুশের চেতনা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জ্ঞানের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি সম্মানবোধকে জাগিয়ে তুলেছিল। স্বধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেই মূল্যবোধের বলিষ্ঠ বিকাশ প্রত্যাশিত রয়ে গেছে আজও। তবে সেই মূল্যবোধের বাঞ্ছিত বিকাশের সুযোগ সুদূরপরাহত নয়। একুশের চেতনা কালপরিক্রমায় সেই মনোভঙ্গি ও দূরদৃষ্টিকে করে সবল ও স্বচ্ছ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বাঞ্ছিত লক্ষ্যে আজ এগিয়ে সবাই।


এটি একুশের চেতনার অবিনশ্বর অভিযাত্রা কোনো কোনো বিশেষ ঘটনা, কোনো কোনো আত্মত্যাগ আদর্শগত কারণে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যবহ রূপ লাভ করতে পারে। সেই আত্মত্যাগ যদি হয়ে থাকে মহত্তম কোনো আদর্শের প্রশ্নে, সেই বিশেষ ঘটনায় যদি ঘটে অনির্বাণ আকাঙ্ক্ষার অয়োময় প্রত্যয়ের প্রতিফলন; স্থান-কাল-পাত্রের সীমানা পেরিয়ে সেই ঘটনা ভিন্নতর প্রেক্ষাপটেও নতুন নতুন চেতনার জন্মদাত্রী হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে তেমনি এক অসীম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, যা আমাদের সার্বিক জাগরণের উৎসমুখও। একুশের চেতনা কখনও প্রত্যক্ষে, কখনও পরোক্ষে অনুপ্রেরণার সঞ্চারী হিসেবে অন্তরে অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলে। একুশের চেতনা বারবার সংকটে দিকনির্দেশক, বিভ্রান্তিতে মোহজাল ছিন্নকারী এবং আপাত বন্ধ্যত্বে সৃষ্টিমুখরতার দ্যোতক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ছয় দশক আগে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়, তার তাৎক্ষণিক তাৎপর্য মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠান প্রশ্নে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কালপরিক্রমায় এর তাৎপর্যের পরিধি বিস্তৃত হয়। ১৯৪৭-এর ভারত বিভক্তির পর নবসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ববঙ্গ প্রদেশবাসীর জাতীয় সত্তা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে শুরু করে প্রথম থেকেই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতিদানে প্রকাশ্য অস্বীকৃতি পূর্ববঙ্গবাসীদের জাতীয়তাবাদী চেতনার মর্মমূলে আঘাত হানে । ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ, ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এক নতুন প্রত্যয় ও প্রতীতি দান করে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একুশের চেতনাই ছিল প্রাণশক্তি।
একুশের চেতনা যে সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম দেয়, তার মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশমুখী আন্দোলনের একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও ছিল। একুশের চেতনা এমনই প্রগতিশীল ছিল, এমনই প্রগাঢ় ছিল যে, যার জন্য স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম তীব্রতর হয়েছিল। একুশের ভাবধারা প্রথমদিকে কতিপয় ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে তাতে দেশের আপামর জনসাধারণও উদ্বুদ্ধ হয়ে, সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। একুশের মূল্যবোধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, স্বৈরাচারের পতনকার্যে একতাবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করতে, নিপীড়িত জনগণের পাশে এসে দাঁড়াতে সর্বোপরি মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে শিক্ষা দেয়। একুশের চেতনা দেশের সাহিত্যাঙ্গনেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জাতীয়তাবোধের উচ্চারণে সমৃদ্ধ সাহিত্যের পাশাপাশি গণমুখী সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন দেশের কবি-সাহিত্যিকরা। সাহিত্যধারায় সূচিত হয় এক নবযুগ। একুশের চেতনা স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে এক মহান আত্মপ্রত্যয়ী, স্বধর্মে নিষ্ঠাবান এবং স্বঐতিহ্যের ধারক-বাহক হওয়ার জাতিসত্তার চেতনাকে জাগ্রত করেছিল। একুশের আন্দোলন ছিল মূলত বাঙালির আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের উদ্বোধন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তাই একুশের চেতনা গোটা জাতির দীর্ঘ পরাধীনতার অভিশাপপ্রসূত দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে আত্মসম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে গঠনমূলক প্রতীতির জন্ম দিয়েছিল। এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে_ ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার সুফল পেঁৗছে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে একুশের চেতনার সার্থক স্বীকৃতি। স্বাধীনতার স্পর্শে জাতীয় জীবনে নৈতিকতা, পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, বলিষ্ঠ জাতীয় চরিত্রচেতনার বিকাশ এবং দারিদ্র্য বিমোচনের দ্বারা স্বনির্ভরশীলতা অর্জনের মধ্যেই একুশের প্রকৃত প্রত্যয় নিহিত।
বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের ব্যানারে চলেছিল মূলত বাঙালির আত্মরক্ষার সংগ্রাম আর স্বাধীনতা লাভের পর তা প্রতিভাত হয় আত্মবুদ্ধি ও চেতনার প্রসারের। আবেগের তীব্রতায় একুশের চেতনা স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে যেভাবে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করেছিল সবাইকে, সেখানে মৃত্যুও তুচ্ছ ছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে আজ সেই চেতনা আমাদের তা সসম্মানে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায় এবং যার জন্য এখন নিছক আবেগ নয়, সার্বিক উন্নয়ন অভীপ্সায় আজ সুষ্ঠু গাণিতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। সমগ্র ও বিপুলভাবে বাঁচার প্রয়োজনে সমষ্টিগত পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ ও নিরুদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ প্রয়োজন। জাতীয়তাবোধকে দীর্ঘায়ু করার লক্ষ্যে অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করাও আবশ্যক। কৃষিভিত্তিক দেশে কৃষির বাস্তবমুখী প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ, যন্ত্রশিল্পের শ্রমিকের গুরুত্ব নির্ধারণে তার তৈরি পণ্যের প্রয়োজনীয়তাকে অর্থবহকরণ, কর্মে অনীহা দূরীকরণ এবং জনজীবন থেকে অদৃষ্টের দোহাই দূরীকরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের উন্নত জীবনবোধ প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার তাগিদ অনুভূত হয়। একটি সংহত অর্থনৈতিক ভিত্তিতেই তা সম্ভব। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সমাজের সকল স্তরের লোকদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার কোনো বিকল্প নেই।
একুশের চেতনা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জ্ঞানের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি সম্মানবোধকে জাগিয়ে তুলেছিল। স্বধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেই মূল্যবোধের বলিষ্ঠ বিকাশ প্রত্যাশিত রয়ে গেছে আজও। তবে সেই মূল্যবোধের বাঞ্ছিত বিকাশের সুযোগ সুদূরপরাহত নয়। একুশের চেতনা কালপরিক্রমায় সেই মনোভঙ্গি ও দূরদৃষ্টিকে করে সবল ও স্বচ্ছ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বাঞ্ছিত লক্ষ্যে আজ এগিয়ে সবাই। এটি একুশের চেতনার অবিনশ্বর অভিযাত্রা।
দেশের বিপুল জনসমষ্টিকে মানবসম্পদে রূপান্তরের মধ্যেই সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় নিহিত। স্বনির্ভর অর্থনীতি উৎসারিত আত্মমর্যাদাবোধ জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অন্যতম রক্ষাকবচ। সে লক্ষ্যে পেঁৗছতে হলে মানবসম্পদের উন্নয়ন আবশ্যক। বলিষ্ঠ চরিত্রচেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে এটি এক মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। নৈতিকতা, দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদাবোধের ভিত্তি রচনা করে যেসব চরিত্রচেতনা, তার বলিষ্ঠ ও বাঞ্ছিত বিকাশ প্রয়োজন। একুশের চেতনা সেই আকাঙ্ক্ষাকে অর্থবহ রূপদান করতে পারে। ইতিহাসের বিচিত্র পরিক্রমণে কখনও মানুষের নেতৃত্বে যুগের পরিবর্তন ঘটে, কখনওবা ঘটনার নেতৃত্বাধীনে মানুষ পরিবর্তিত মূল্যবোধে সংস্কৃত হয়ে ওঠে। একুশের চেতনা এ মুহূর্তে দেশবাসীকে সেই প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে এবং জাগাতে পারে শক্তি ও সাহস। নৈতিক চরিত্র ও কর্তব্যবোধকে সচেতন করতে মূল্যবোধ সংকট উত্তরণে সচেষ্ট হতে দেশের চিন্তাভাবনার রাজ্যে ও মূল্যবোধের প্রসাদে একুশের চেতনার সজীব উপস্থিতি একান্ত আবশ্যক।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ :সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.