বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩১৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, বীর প্রতীক সফল এক নৌ-কমান্ডো রাস্তায় স্টেনগান হাতে সতর্ক প্রহরায় মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। অদূরে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিকআপ গাড়ি।
তাঁর সহযোদ্ধারা নিঃশব্দে তাতে মাইন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র তুলছেন। আধাআধি তোলা হয়েছে, এমন সময় মোহাম্মদ খোরশেদ আলম দেখতে পেলেন কাছেই এক তরুণ পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে। দুর্ভাবনায় পড়লেন—ওই তরুণ রাজাকার না মুক্তি! তিনি জানেন না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, যদি রাজাকার হয়, তবে পিস্তল তাকে (তরুণকে) স্টেনের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকলেন। আর তখনই ওই তরুণ দিল চম্পট। অনুসরণ করলেন, কিন্তু ধরতে পারলেন না। তরুণটি পালিয়ে গেল।
এ ঘটনা চট্টগ্রাম শহরে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। মোহাম্মদ খোরশেদ আলমসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা (মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো) তখন গোপনে চট্টগ্রাম এসেছিলেন বন্দরে অপারেশন করার জন্য। সীতাকুণ্ডে রাখা ছিল তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র। সে দিন মোহাম্মদ খোরশেদ আলমসহ কয়েকজন সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রাম শহরে সেগুলো নেওয়ার জন্য পিকআপে তুলছিলেন। বিপদ উত্তরণে মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পিকআপ নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়েন। বড় রাস্তায় এসে তরিতরকারি (বরবটি, ঝিঙে ইত্যাদি) কিনে বিছিয়ে দেন ওপরে। গাড়ি ছেড়ে দিলেই শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। পরিস্থিতি তাঁদের সহায় হয়। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তাঁরা শেষ পর্যন্ত নিরাপদেই শহরের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছেন।
১৫ আগস্ট শেষ রাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ১৬ আগস্ট) তাঁরা চট্টগ্রাম বন্দরে সফলভাবে অপারেশন করেন। তাঁদের অপারেশনে কয়েকটি জাহাজ, বার্জ, গানবোট ও পন্টুন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস এবং কয়েকটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ছিল জাহাজ এমভি আল আব্বাস, এমভি হরমুজ, বার্জ ওরিয়েন্ট, দুটি গানবোট ও দু-তিনটি পন্টুন। এ ছাড়া ছোট কয়েকটি বার্জ সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। অপারেশনে অংশ নেন ৩৭ জন। নৌ-কমান্ডোরা বেশির ভাগ পানিতে নেমে সাঁতরিয়ে নির্দিষ্ট টার্গেটে গিয়ে মাইন লাগান। কয়েকজন তীরে ও দূরে থাকেন প্রহরায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দলনেতা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীর উত্তম-বীর বিক্রম), মোহাম্মদ খোরশেদ আলমসহ কয়েকজন। তিনি ছিলেন পেছনে। তাঁর ওপর দায়িত্ব ছিল অপারেশনের সাফল্য বা ব্যর্থতায় কোনো অঘটন ঘটলে তা সামাল দেওয়ার। সফলতার সঙ্গে তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন।
মোহাম্মদ খোরশেদ আলম ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যাওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ খোরশেদ আলমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৯৫। গেজেটে নাম মোহাম্মদ খুরশেদ আলম।
মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামে। বর্তমানে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের জাকির হোসেন সড়কের সুফিয়া মঞ্জিলে বসবাস করেন। এই বাড়ি তাঁর বাবার। তাঁর বাবা চাকরিসূত্রে স্বাধীনতার আগে থেকেই চট্টগ্রামে বসবাস করতেন। বাবার নাম সাদত আলী। মা সুফিয়া খাতুন। স্ত্রী সুলতানা আরা বেগম। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১০ এবং মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো, মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ বীর প্রতীক। ছবি: রাশেদ মাহমুদ।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.