প্রকৃতি-অধ্যাপকের স্মরণসভায় by দ্বিজেন শর্মা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী অধ্যাপক, পক্ষী ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের পুরোধা, প্রকৃতিবিদ জাকের হোসেনের মৃত্যুসংবাদ কাগজে দেখেছি, তাঁকে নিয়ে কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। সংস্কৃতিজগতে বিজ্ঞানের অবস্থান অন্তরালবর্তী, সেখানে চমক ঘটে দৈবাৎ, বিষয়গুলোও দুর্বোধ্য, তাই সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ তাতে কম এবং এই পারক্য বৈশ্বিক।


গত ১৫ অক্টোবর বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি পরিষদ আয়োজিত স্মরণসভায় কোনো সাংবাদিক ছিলেন না, শ্রোতার উপস্থিতিও নগণ্য, কিন্তু জাকের হোসেনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও দীর্ঘদিনের বন্ধুরা সভাগৃহের এই শূন্যতা অগ্রাহ্য করে দীর্ঘ বক্তৃতা করেছেন, আবেগাপ্লুত হয়ে কেউ কেউ কেঁদেও ফেলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালে (১৯৫৬-৫৮) এই অধ্যাপকের কথা আলোচিত হতে শুনেছি—পরনে হাফপ্যান্ট, মাথায় টুপি, গলায় ঝোলানো ক্যামেরা, হাতে বাইনোকুলার নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান ঢাকা শহরে, দেশের দূর-দূরান্তর। এ ধরনের ছন্নছাড়া অধ্যাপক আমাদের শিক্ষাঙ্গনে, সমাজে নতুন, সে জন্যই এই কৌতুকী বাকচর্চা। পূর্ববঙ্গে পাখি দেখা তখনো চালু হয়নি। বন্য প্রাণীর খোঁজখবর অনেক পরবর্তী ঘটনা। অধ্যাপক হোসেন অক্সফোর্ডে গবেষণা করেছেন, ইংল্যান্ড ও দূরদেশে সংগ্রহ ও সন্ধান অভিযানে গেছেন, নিসর্গী-স্বভাব অর্জন করেছেন, তাই দেশে ফিরে আমাদের সামাজিক রক্ষণশীলতা আর মান্য করেননি।
কলেজে শিক্ষকতা ও দীর্ঘ বিদেশবাসের দরুন তাঁর সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময়ের কোনো সুযোগ আমার ছিল না। আমাদের দুজনের ছাত্র, পরে বন্য প্রাণীবিশারদ রেজা খানের সঙ্গে দীর্ঘ ঘনিষ্ঠতার সূত্রে জাকের হোসেন সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে পেরেছি। তাঁর কিছু কিছু লেখাও পড়েছি এবং সভা-সমিতিতে আমাদের একাধিকবার দেখাও হয়েছে। মৃত্যুর অল্প দিন আগে আমাদের শেষ দেখা প্রথম আলোর প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের আলোচনা সভায়। ৮০ বছর বয়সেও তাঁকে অদম্য মনে হয়েছে, আলাপে তরুণদের সমকক্ষ, অনেকক্ষণ বক্তৃতাও করলেন। সমমতাদর্শী ও সহযাত্রীদের পারস্পরিক বন্ধন অদৃশ্য সূত্রেই ঘটে। জাকের হোসেনকে সর্বদাই আপনজন মনে হয়েছে, যেন আমরা অনেক দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা আসলে প্রায় সমবয়স্ক।
জাকের হোসেন যখন প্রকৃতিচর্চায় ব্রতী হয়েছেন, বাংলাদেশের নিসর্গ পরিস্থিতি তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। লোকসংখ্যা পাঁচ কোটি, বনভূমি, জলাভূমি অটুট, নদীগুলো স্বচ্ছসলিলা, কলকারখানার সংখ্যা নগণ্য, পরিব্যাপ্ত পরিবহন অনুপস্থিত, ঢাকা শহর তেজগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত। একাত্তরের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে উন্নয়ন শুরু হলে মাত্র ৩০ বছরে ভূ-প্রাকৃতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং আমাদের পরিবেশ-সংকটের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। অথচ পঞ্চাশের শেষার্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার ক্লাসে ইকোলজি পড়েছি, ইকোলজিক্যাল ক্রাইসিসের কথা শুনিনি, পরিবেশবিদ্যা নামের বিষয়টিও অজানাই ছিল।
পশ্চিমেও এসব বিষয় ৬০ বছর আগে ততটা গুরুত্ব পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত প্রযুক্তি করায়ত্ত হওয়ার ফলে শিল্পোন্নয়নের ত্বরণ গোটা পৃথিবীর দৃশ্যপট পাল্টে দেয়, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটে এবং একই সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের মারাত্মক অবক্ষয়। উন্নয়ন ও দূষণ সন্ধিবদ্ধ বাস্তবতা, যা এড়ানো মানুষের সাধ্যাতীত। জাকের হোসেন জীবনসায়াহ্নে যে বাংলাদেশ দেখেছেন, তা যৌবনে কল্পনাও করেননি। বাংলাদেশের অভিন্ন আয়তনের ভূখণ্ডে জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি, ঢাকায় দেড় কোটি, বনভূমি কমে সাত শতাংশ, জলাভূমি দ্রুত ভরাট হচ্ছে, নদীগুলো দূষিত, জীববৈচিত্র্যের পরিস্থিতি ভয়ংকর, কলকারখানা অনেক ও যত্রতত্র যাতায়াতের উন্নতি অভূতপূর্ব, দূষণ ব্যাপক এবং একই সঙ্গে বিত্তবান বহু লোক, সর্বসাধারণের জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি ঘটেছে। এ অবস্থায় একজন প্রকৃতিপ্রেমীর অসহায়ত্ব সহজবোধ্য।
অধ্যাপক জাকের হোসেন পাখি ও বন্য জন্তুদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বিজ্ঞান ও ভালোবাসার তাগিদে এবং তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রী ও জনসাধারণকে সে কথাই বলেছেন। কিন্তু আজ আর এটুকু যথেষ্ট নয়। তত্ত্বকথার পরিবর্তে সংগ্রাম সমাগত। প্রকৃতিসচেতন নতুন প্রজন্ম ভালোই জানে, সমস্যাটির মূল গোটা সভ্যতার গভীরে প্রোথিত। এতে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, জনমনস্তত্ত্ব, এমনকি মানববিবর্তন ও বংশগতি। জাকের হোসেনের ঐতিহ্য যাঁদের ওপর বর্তেছে, তাঁরা অতঃপর তাঁদের কর্মপরিসর আশা করি অনুধাবন করতে পারছেন। সাসটেইনেবল বা পরিপোষক উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সভ্যতার বিশাল যান্ত্রিক কাঠামোর যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে অপারগ, তা সহজবোধ্য।
তাহলে কী ঘটবে? যন্ত্রসভ্যতা কি আপন অর্থদ্বন্দ্বে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, নাকি প্রকৃতি কোনো মহাপ্রলয়ে এই সভ্যতাকে ধ্বংস করবে? আমরা সঠিক কিছুই জানি না। জানি শুধু এটুকু যে আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। আমাদের শেষ ভরসা—মানুষের শুভবুদ্ধির নিশ্চিত জয়। পৃথিবীর সকল কালের সকল মনীষী তাঁদের মহৎ কর্মকাণ্ডের উপকরণ দিয়ে এই ভরসাস্থল নির্মাণ করে গেছেন। আশা করি, মানুষ ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ থেকে অর্জিত তার বংশানুসৃত স্বার্থপরতা ও প্রতিযোগিতার প্রবণতাগুলো একদিন বর্জন করতে পারবে।
দ্বিজেন শর্মা: নিসর্গী, লেখক।

No comments

Powered by Blogger.