মৃদুকন্ঠ-সমদর্শীদের দর্শন-বিভ্রাট by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

সমদর্শী' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো সব কিছুকে সমান দৃষ্টি দিয়ে দেখা। ব্যাখ্যা করলে এমনটা দাঁড়ায়_একটি ক্ষুদ্র জলবিন্দু আর সাগরকে জলজ্ঞানে একই রকম ভাবা। ছোট্ট একটি টিলা আর সুউচ্চ পর্বতকেও সমান করে দেখা। সামান্য স্খলন আর মহাপাপকে সমান জ্ঞান করা। তবে 'সমদর্শী' শব্দটির প্রায়োগিক অর্থ এমনটা নয়। প্রায়োগিক অর্থে সমদর্শী হলো ছোটকে ছোট দেখা, বড়কে বড় দেখা।


সামান্য স্খলনকে ত্রুটি জ্ঞান করা এবং হত্যাকে মহাপাপ জ্ঞান করা। শব্দটির আক্ষরিক এবং প্রায়োগিক অর্থে বেজায় ফারাক। প্রকৃতই ভিন্নার্থ।
শব্দটি মনে পড়ল কয়েক দিন আগে বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম দেখে। কলাম-নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল, 'মৃদু আঘাত ও হালকা নাশতার গণতন্ত্র'। লেখক সজ্জন, নিরপেক্ষ ও সমদর্শী। কিন্তু শিরোনামটি দেখেই হোঁচট খেলাম। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক গত ৬ জুলাই হরতালের সময় যে আঘাত পেয়েছিলেন, তাকে সরকারের পক্ষ থেকে 'মৃদু আঘাত' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, সেটাকে হামলাকারীদের কেউ একজন শেখ হাসিনাকে 'হালকা নাশতা করানো' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। এই দুটি উক্তিকে একই শিরোনামে গেঁথে দিয়ে লেখক যে সমদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন, তাতে আঁতকে উঠতে হয়। দুটি ঘটনাই নিন্দনীয়। কিন্তু ঘটনা দুটি কি তুলনীয়?
জয়নুল আবদিন ফারুক যেমন 'মৃদু আঘাতপ্রাপ্ত' হয়েছিলেন, তেমনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও ইতিপূর্বে 'মৃদু আঘাতপ্রাপ্ত' হয়েছিলেন। একজন নিরস্ত্র মহিলা হয়েও বেগম মতিয়া চৌধুরী একদিন মৃদু আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। জয়নুল আবদিন ফারুক, মোহাম্মদ নাসিম এবং বেগম মতিয়া চৌধুরীর 'মৃদু আঘাত' প্রাপ্তি নিয়ে যদি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হতো, তাহলে লেখকের সমদর্শিতার পরিচয় পেতাম। এসব মৃদু আঘাতে গণতন্ত্র কতটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তা অনুধাবন করা সম্ভব হতো। মাত্রাজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকত না।
তা না করে যখন জয়নুল আবদিন ফারুকের আঘাতপ্রাপ্তির সঙ্গে ২১ আগস্টের বীভৎস গ্রেনেড হামলা এক শিরোনামে ঠাঁই পায়, তখন অনেক প্রশ্নই মনে উদয় হয়। জানতে ইচ্ছা হয়, সমদর্শিতার অর্থ কী? নিরপেক্ষতা বলতে কী বোঝায়? লাঠি আর গ্রেনেড কি তুলনীয়? গ্রেনেডের সঙ্গে বুটের লাথির তুলনা করে লেখক কার পক্ষ নিচ্ছেন? কার অপরাধকে লঘু করে দিচ্ছেন? গণতন্ত্রের উপকার করছেন, নাকি ক্ষতি সাধন করছেন? সমদর্শিতার অন্তরালে তাঁর প্রকৃত দর্শন বা লক্ষ্য কী?
ঘটনা দুটি আমরা সবাই জানি। তবু অনেক সময় 'রি-প্লে' করে ফুটেজ দেখে নিই ভ্রান্তি নিরসনের জন্য। স্মরণ করার চেষ্টা করা যাক। কী ঘটেছিল ওই দুই দিন। গত ৬ জুলাই বুধবার ছিল বিএনপি আহূত হরতালের প্রথম দিন। সংসদ ভবনের আশপাশে সংসদ চলাকালীন দিনগুলোতে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জয়নুল আবদিন ফারুকসহ বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্যরা মিছিল বের করেন। তাঁরা সংসদে যান না, কিন্তু সংসদ এলাকায় মিছিল করতে বিব্রত হননি। ভিডিও ফুটেজ এবং পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিগুলো থেকে বোঝা যায়_(ক) পুলিশ মিছিলে বাধা দিচ্ছে, (খ) জয়নুল আবদিন ফারুক উত্তেজিত হয়ে কিছু বলছেন, (গ) জয়নুল আবদিন ফারুক একটি ঢিল ছুড়ছেন, (ঘ) জয়নুল আবদিন ধাক্কা দিয়ে এক পুলিশকে মাটিতে ফেলে দিয়েছেন, (ঙ) 'পাগল' 'পাগল' উচ্চারণে জয়নুল আবদিনকে ধাওয়া করা হচ্ছে, (চ) পুলিশের সঙ্গে তাঁর ধস্তাধস্তি হচ্ছে, (ছ) পুলিশ তাঁকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে, বুটের আঘাত করেছে, (জ) জয়নুল আবদিনের মাথা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, (ঝ) তিনি খালি গায়ে পালাচ্ছেন, তবু তাঁকে ধাওয়া করা হচ্ছে, (ঞ) তিনি আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার লেখচিত্র রচনা একটি অসম্ভব কাজ। কারণ ঘটনার নৃশংসতা, ভয়াবহতা, নাটকীয়তা ও প্রাণহানি বর্ণনার অতীত। তবু কয়েকটি তথ্য চয়ন করা যেতে পারে, ভিডিও ফুটেজ এবং পত্র-পত্রিকার সচিত্র বর্ণনা থেকে_(ক) ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে দলের শান্তি সমাবেশ, তৎকালীন বোমা হামলা, সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে; (খ) খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিলেন; (গ) বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই গ্রেনেড চার্জ হতে লাগল, একটার পর একটা। সারা রাস্তা রক্তে লাল; (ঘ) নেতা-কর্মী-শ্রোতারা মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, (ঙ) ২৪ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানও মৃত্যুবরণ করেছেন; (চ) অসংখ্য মানুষ গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, (ছ) পুলিশ সরে গেছে, (জ) হত্যাকারীরা পালিয়ে যাচ্ছে, পুলিশ তাদের ধরছে না; (ঝ) শেখ হাসিনার চারপাশে মানববর্ম রচনা করে তাঁকে ঘিরে রেখেছেন নেতারা। স্প্লিন্টারে তাঁরাও আঘাতপ্রাপ্ত। তাও সরে যাননি। নেত্রীকে নামিয়ে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো; (ঞ) সবাই নিহত, আহত বা হতবিহ্বল। মোটামুটি এই হলো ঘটনা সম্পর্কিত কয়েকটি চিত্র। পরের ঘটনা আরো চমকপ্রদ। প্রকৃত গ্রেনেড চার্জকারীরা বীরদর্পে পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে সটকে পড়ল। বিএনপি নেতারা ঘটনাটিকে আওয়ামী লীগের দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব হিসেবে অভিহিত করলেন। তদন্তে জজ মিয়া নামের এক যুবককে দায়ী সাব্যস্ত করে আটক করা হলো। প্রহসনের তদন্ত এগিয়ে চলল। সরকারের পতন হলো। ১০ ট্রাক মামলার অস্ত্র উদ্ধারের সঙ্গে ২১ আগস্টের ঘটনার সম্পর্ক নির্ণিত হলো। ঘটনার পুনঃতদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এল। এখনো বেরোচ্ছে, আরো বেরোবে। মামলার বিচার চলাকালে বিবেককে স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো অনেক কথাই হয়তো বেরিয়ে আসবে।
এখন বিচারের ভার পাঠকদের কাছে। জয়নুল আবদিন ফারুককে লাঠিপেটা করার ধৃষ্টতার সঙ্গে বিদেশি শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় তৎকালীন সরকারের জ্ঞাতসারে (অনুমোদনক্রমে?) শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে জনসভায় গ্রেনেড হামলার নৃশংসতার ঘটনাকে এক সূত্রে গেঁথে লেখক কি সমদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন? লাঠির আঘাতে একজন আহত হওয়া আর গ্রেনেডের আঘাতে ২৪ জন নিহত এবং অনেক মানুষ পঙ্গু হয়ে যাওয়ার ঘটনা সমান দৃষ্টি দিয়ে দর্শনও কি সমদর্শন?
আক্ষরিক অর্থে 'সমদর্শন' প্রকৃতপক্ষে অসমদর্শন, বিষমদর্শন। সমদর্শন অর্থ হলো সত্য দর্শন। সত্য দর্শনই সমদর্শনের প্রায়োগিক অর্থ, প্রকৃত অর্থ। সমদর্শীর কাজ হবে সত্যকে সত্যজ্ঞান করা এবং মিথ্যাকে মিথ্যাজ্ঞান করা। 'অর্ধসত্য' বলে কোনো কথা নেই। কারণ অর্ধসত্য অর্থ হলো অসত্য। মিশ্রসত্যও অসত্য। লঘুকে লঘুই দেখতে হবে, গুরুকে গুরু। লঘু ও গুরু সমান নয়। লঘু ও গুরুকে এক করে ফেললে লঘুর লঘুত্ব লোপ পায় এবং গুরুর গুরুত্ব উপেক্ষিত হয়। এক লহমায় 'লঘু আঘাত' আর 'হালকা নাশতা'র উল্লেখ করলে লঘু আঘাত কি গুরুতর হয়ে ওঠে না? কিংবা হালকা নাশতা কি একেবারেই হালকা হয়ে যায় না?
তাহলে সমদর্শীদের নিরপেক্ষতা কোথায়? একদা বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেছিলেন, একমাত্র শিশু ও পাগলই নিরপেক্ষ। প্রত্যেকেরই নিজস্ব মত রয়েছে_এই অর্থে এবং ওইটুকু পর্যন্ত নেত্রীর কথাটা কিছুটা প্রকাশ পায়। যদিও নিরপেক্ষ হওয়ার মানসিক গভীরতা এবং স্থায়িত্ব শিশু ও পাগলের নেই। নিরপেক্ষ হওয়ার যোগ্যতা যুক্তিবাদী মননশীল ব্যক্তির রয়েছে। নিরপেক্ষ ব্যক্তিরও নিজস্ব মত রয়েছে, তবে তিনি অন্যের মতামতকেও শ্রদ্ধা করতে শিখেছেন। এ কারণে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে কোনো জড়ষব ঢ়ষধু করার দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি ওই জড়ষব-এর উপযোগী ব্যবহার প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। নিজস্ব বিশ্বাস-মতামতের বাইরে এসে দায়িত্বপ্রাপ্ত জড়ষব-টিকে পৃথকভাবে গ্রহণ করে থাকেন। নিজস্ব বিশ্বাস বিসর্জন দিতে হয় না।
বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক সচেতনতা থাকলেই নিরপেক্ষ আচরণ করা সম্ভব। নিরপেক্ষতার আবরণে নিজস্ব মত প্রচার করা উদ্দেশ্য হলে নিরপেক্ষতা টেকে না। অনেকে আবার সব পক্ষকেই সন্তুষ্ট করাকে নিরপেক্ষতা মনে করেন। এটা আসলে প্রতারণা, যা সহজেই ধরা পড়ে যায়। প্রতারণামূলক নিরপেক্ষতায় লঘু পাপে গুরুদণ্ড এবং গুরু পাপে লঘুদণ্ড দিয়ে 'উভয়কে দণ্ড প্রদানের' সমতা বিধান করা হয়। এতে স্বল্প দোষীকে বিরাট অপরাধী বানিয়ে ফেলা হয় এবং নৃশংস দুরাচারীকে স্বল্প দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যা মিথ্যাচারের পর্যায়ে পড়ে।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অথবা প্রতারণামূলক সমদর্শিতা কখনো স্বভাবসুলভ, কখনো স্বার্থপ্রণোদিত, কখনো আবার ষড়যন্ত্রপ্রসূত। সবাইকে খুশি রাখা অথবা কারো বিরাগভাজন না হওয়ার মানসিকতা থেকে সমদর্শী হলে সেটাকে স্বভাবজাত বলা যেতে পারে। কিন্তু পুরস্কারপ্রাপ্তি বা কারো সুনজরে থাকার লক্ষ্যে কোনো বিষয়কে আড়াল করা হলে তা হবে স্বার্থপ্রণোদিত। সবচেয়ে নিন্দনীয় সমদর্শিতা হলো, ষড়যন্ত্রে তা দেওয়া। যেমনটা করা হয়েছিল ১/১১-এর পর সমদর্শী সেজে আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে সমান করে ফেলার প্রয়াস। সমদর্শীরা জানতেন, দল দুটি একেবারেই ভিন্ন ধাতুতে গড়া। জন্মকথায় মিল নেই, চলার পথে মিল নেই, আদর্শেও মিল নেই। এক শ্রেণীর সমদর্শী দল দুটিকে এক পাল্লায় মেপে বাতিল ঘোষণা করল। কারণ, ষড়যন্ত্র ছিল তৃতীয় শক্তির উন্মেষ ঘটানোর। প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক ধারা থেকে উদ্ভূত হলে তৃতীয় শক্তির উন্মেষ ঘটতেই পারত। কিন্তু ঘটেনি। কারণ, অশুভ প্রক্রিয়ার শক্তিহীন শক্তিকে টেনে আনার লক্ষ্যে তথাকথিত সমদর্শীরা আওয়ামী-বিএনপি দল দুটিকে একই সঙ্গে বর্জনীয়রূপে চিত্রিত করেছিল। সমদর্শনের পেছনে ছিল এক বিরাট ষড়যন্ত্র। আর ষড়যন্ত্রের বাহ্যিক আবরণ ও বেশভূষা ছিল সমদর্শন। 'সমদর্শন' থেকে সাবধান, 'সমদর্শীদের' থেকে সাবধান।

লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.