যুক্তরাষ্ট্র-যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর্থিক সংকটের ভূত by আসজাদুল কিবরিয়া

নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে ন্যাসডাক ওএমএক্সের অন্যতম কার্যালয়। ন্যাসডাক ওএমএক্স হলো যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান, যারা কিনা ন্যাসডাক স্টক এক্সচেঞ্জসহ ইউরোপের আটটি স্টক এক্সচেঞ্জের মালিক। সার্বিকভাবে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। আর বাজার মূলধনের দিক দিয়ে ন্যাসডাক স্টক এক্সচেঞ্জ হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুঁজিবাজার। প্রথম স্থানে আছে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ।


গত সেপ্টেম্বর মাসে যেদিন দুপুরে আমরা ১৫ দেশের ১৫ জন অর্থনৈতিক সাংবাদিক ন্যাসডাক পরিদর্শনে গেলাম, তার আগের দিনই আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ‘অপারেশন টুইস্ট’ ঘোষণা করেছে। ফলে পরদিন আর্থিক বাজার, বিশেষত পুঁজিবাজারের ওপর এ ঘোষণার প্রভাব দেখাটাও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। আমেরিকায় আগের দিন যখন ফেডারেল রিজার্ভ (সংক্ষেপে ফেড) অর্থনীতি চাঙা করতে এ ঘোষণা দেয়, তখন এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে লেনদেন শেষ হয়ে গেছে। তবে দিনের শেষভাগ হওয়ায় ওয়াল স্ট্রিট তথা আমেরিকার পুঁজিবাজার নিম্নমুখী হয়েই দিনের লেনদেন শেষ করে।
ন্যাসডাক কার্যালয়ের প্রথম তলার যে কক্ষটির দেয়ালে ডিজিটাল পর্দায় বিশ্বের বিভিন্ন শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকের গতি-প্রকৃতি প্রদর্শিত হতে থাকে, সেই কক্ষ থেকেই টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা বাজারের হালনাগাদ খবর প্রচার করেন। আমরা কক্ষটিতে প্রবেশের পর দেখতে পেলাম যে প্রায় সব সূচক লাল অর্থাৎ নিম্নমুখী হয়ে গেছে। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের ডাও জোনস সূচক দিনের প্রথমভাগেই ৩০০ পয়েন্টের বেশি খোয়া গেছে। আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন ন্যাসডাকের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোয়ে ক্রিস্টিন্যাট। তাঁর কাছেই জানতে চাওয়া হলো, ফেডারেল রিজার্ভের ঘোষিত পদক্ষেপ কেন নেতিবাচক প্রভাব ফেলল। তাঁর ‘অব দ্য রেকর্ড’ জবাবটা এ রকম ছিল: বাজারের যে প্রত্যাশা ছিল, ফেডের ঘোষণা তা ঠিক পূরণ করতে পারেনি। তা ছাড়া ফেড আসলে কী করতে চাইছে, অনেকে সেটাও ঠিক বুঝতে পারেনি।
প্রত্যাশাটা কী ছিল? ছিল, বাজারে যেন আরও নগদ অর্থ ঢালা হয়। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে দুই দফা মুদ্রানীতি শিথিল করে কোটি কোটি ডলার আর্থিক বাজারে ঢেলেছে। এ পদক্ষেপকে বলা হয়েছে কোয়ান্টিটেভি ইজিং। বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের বন্ড (যেমন, বন্ধকিভিত্তিক সিকিউরিটিজ ও ট্রেজারি বন্ড) কিনে নিয়েছে। আর বন্ড কেনা মানে আসলে ঋণ প্রদান করা। ২০০৮ সালে আর্থিক সংকট দেখা দেওয়ার পর প্রথম দফায় কয়েক হাজার কোটি ডলারের বন্ড কিনে নেওয়া হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। উদ্দেশ্য, এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো সস্তায় যে ঋণ পাচ্ছে, তা আবার তারা ঋণ প্রদান করে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করতে ভূমিকা রাখবে। বাস্তবে তা আর হয়নি। বরং ২০১০ সালে দ্বিতীয় দফা কোয়ান্টিটেভি ইজিং (কিউ-২) শুরু করে ফেড। এভাবে আর্থিক বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙা করার চেষ্টা চলে।
কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালার ফলে আর্থিক বাজারের খেলোয়াড়েরা লাভবান হলেও আমেরিকার অর্থনীতি তেমন একটা চাঙা হতে পারেনি। ফলে ফেড বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ে। অন্যদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ শেয়ারবাজারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করতে থাকেন যে আরও অর্থ দিতে হবে। তা না হলে বাজার চাঙা ও স্থিতিশীল হবে না। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বর মাসে অপারেশন টুইস্ট কার্যক্রম ঘোষণা করে ফেড সব দিক সামাল দেওয়ার একটা চেষ্টা করেছে বলে অনেকেই মনে করেন।
অপারেশন টুইস্টের আওতায় ফেড ২০১২ সাল পর্যন্ত ৪০ হাজার কোটি ডলারের দীর্ঘমেয়াদি বন্ড কিনে নেবে। একই সময়ে বাজারে ছেড়ে দেবে তার কাছ থাকে স্বল্পমেয়াদি বন্ডগুলো। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সুদের হার কমার সুযোগ সৃষ্টি হবে, তবে বাজারে নগদ অর্থ প্রবাহ বাড়বে না। আর সুদের হার কমলে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ঋণের (যেমন, বন্ধকি ঋণ) খরা কাটবে। এই উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে যথেষ্ট। তার চেয়েও বড় কথা, এভাবে ফেড আসলে প্রকৃত সঞ্চয়কারীদের বিপাকে ফেলে দিচ্ছে বলে জোর সমালোচনা উঠেছে। কেননা, ফেডের পদক্ষেপ স্বল্পমেয়াদি ফাটকাবাজিকে উৎসাহিত করতে যাচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনাকে নয়। সার্বিকভাবে অপারেশন টুইস্টের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিফলিত হয়েছে যে তিন বছর আগে সৃষ্ট আর্থিক সংকটের ক্ষত যথেষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারেনি আমেরিকা।
একই দিন বিকেলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত কনফারেন্স বোর্ডে গিয়ে আমেরিকাসহ বিশ্ব-অর্থনীতির একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের আভাস পাওয়া গেল। আমেরিকার অর্থনীতির দুরবস্থা প্রসঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদদের অভিমত হলো, রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি—কোনোটিকেই ঠিকমতো কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কথা উল্লেখ করে বলেন যে তারা ‘কোনো কর নয় বনাম কোনো ব্যয়-কর্তন নয়’ অবস্থা তৈরি করেছে।
দুই দলের আইন প্রণেতারাই আমেরিকার বিরাট রাজস্ব বা বাজেট ঘাটতি কমাতে চান। তবে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা তুলনামূলকভাবে ধনীদের ওপর আয়কর বাড়াতে চাইলেও রিপাবলিকানরা কোনোভাবেই তাতে রাজি নন। বরং তাঁরা চান সামাজিক খাতে ব্যয় কমিয়ে আনতে, যেটা আবার ডেমোক্র্যাটরা চান না। এ রকম অবস্থায় নিম্নকক্ষের রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ওবামার কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা আটকে দিচ্ছেন। ফলে উচ্চকক্ষে ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য থাকলেও ওবামা সুবিধা করতে পারছেন না।
আমরা অবশ্য এসব স্থানে যাচ্ছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রামের আওতায়। ন্যাসডাক ও কনফারেন্স বোর্ডে যাওয়ার আগের দিন সকালে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ক্রেডিট সুইসের নিউইয়র্ক কার্যালয়ে। সুইজারল্যান্ডের জুরিখভিত্তিক এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর্থিক বাজারে চলতি প্রবণতার আলোকপাত করেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপকালে বোঝা গেল, আর্থিক সংকট সৃষ্টির জন্য প্রধানত দায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোভাবেই এই দায় মেনে নিতে রাজি নয়।
যদিও ক্রেডিট সুইসের একজন কর্মকর্তা বলেই ফেললেন যে ওই সময় ঋণের চাহিদা তৈরি করা হয়েছিল এবং চাহিদা অনুযায়ী ঋণও দেওয়া হয়েছিল। আর এই চাহিদা তৈরিতে ও বর্ধিত চাহিদা অনুসারে ঋণ প্রদান করে ব্যাংকগুলো সংকট সৃষ্টিতে একটা ভূমিকা রেখেছে। তবে অন্যরা এর সঙ্গে এও যুক্ত করলেন যে শুধু ব্যাংকগুলো নয়, বরং গ্রাহকদের বা ঋণ গ্রহীতাদের দায় আছে, নিয়ন্ত্রকদের দায় আছে। অথচ গ্রাহকেরা এখন বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছেন। সেই সব মামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে এখন বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
ক্রেডিট সুইসের কর্মকর্তারা আরও দাবি করলেন যে এখন বিশ্ববাজারে, বিশেষত এশিয়ায় ঋণের চাহিদা বেশ বেড়েছে। তবে তাদের মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন নিজেদের মূলধন ভিত্তি সুসংহত করার দিকেই এখন বেশি মনোযোগী। সে জন্য চাহিদা অনুসারে পাল্লা দিয়ে ঋণ আপাতত তারা দিতে পারছে না। বিশেষত, আর্থিক সংকটের পর ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়িভাবে আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের সরকারগুলো। নিয়ন্ত্রণহীনতা ও অস্বচ্ছতার সুযোগে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের অপকীর্তি করে যেভাবে সংকট তৈরি করেছে, ভবিষ্যতে যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে রকম চেষ্টাই চলছে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের দিক থেকে।
এ প্রসঙ্গে ক্রেডিট সুইসের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেল আরেকটি তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ ব্যাংক আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মূলধনবিষয়ক নির্ধারিত বিভিন্ন মানদণ্ড (যা ব্যাসেল-২ নামে পরিচিত) অনুসরণ করেনি। বরং অনেকেই এখনো ব্যাসেল-১ মানদণ্ডের মধ্যে রয়ে গেছে। অথচ আর্থিক সংকটের পর ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট (বিআইএস) ঝুঁকি রোধের মানদণ্ড কঠোরতর করে ব্যাসেল-৩ মানদণ্ড প্রণয়ন করেছে এবং তা অনুসরণের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের সব ব্যাংককে এই মানদণ্ড পরিপালনের সময়সীমা বেঁধেও দেওয়া হয়েছে। ক্রেডিট সুইসে অবশ্য ২০১৩ সালের মধ্যেই অনেকখানি পরিপালন করে ফেলবে বলে জানা গেল।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ ব্যাংক, যেখানে এখনো ব্যাসেল-২ পুরোপুরি পরিপালন করছে না, সেখানে কীভাবে তারা ব্যাসেল-৩ অনুসরণ করবে? এই প্রশ্নটা ক্রেডিট সুইসের মতো আরও অনেকেরই। সে কারণেই তাদের আশঙ্কা, সংকট উত্তরণে কোটি কোটি ডলার ঢেলে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধার করা হলেও আর্থিক বাজারে তারা এখনো পুরোমাত্রায় ঝুঁকি তৈরি করে রেখেছে। আর তাই আরেকটি আর্থিক সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নিউইয়র্কে পরের সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন ব্রডওয়েতে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা অপেরা দেখতে গিয়েছিলাম। সেটার নাম ‘ফ্যান্টম অব দ্য অপেরা ইজ দেয়ার’ (অপেরার ভূতটা এখানে আছে)। অসাধারণ কারিগরি কৌশল, মঞ্চের ওপর আলো ও শব্দের চমৎকার সমন্বয় আর শিল্পীদের অনন্য অভিনয় মিলে প্রায় তিন ঘণ্টা সময়টা কেটেছে অনেকটা সম্মোহিতের মতো। অপেরা থেকে বের হওয়ার পর বুঝি ঘোরের মধ্যে ছিলাম কেউ কেউ। এ অবস্থায় হোটেলে ফেরার পথে একপর্যায়ে একজন আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থাকে অভিহিত করল ‘ফ্যান্টম অব দ্য ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস ইজ দেয়ার’ বলে। আমার মনে হলো, ঠিকই বলেছে। আমেরিকাকে সত্যিই এখন আর্থিক সংকটের ভূত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আরেক দফা মন্দা (ডবল ডিপ) তৈরি হওয়ার জোরালো আলামত বুঝি সেই ভূতকে সত্যি করে তুলতে যাচ্ছে।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক ও লেখক।
asjadulk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.