জলবায়ু বিপর্যয় একটি পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচার-পরিবেশ by পাভেল পার্থ

ইতিহাস থেকে ইতিহাসে কালজয়ী নারীরা সে সাহস দেখিয়েছে। জানি, জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আবারও জাগবে এক সম্মিলিত অগি্নশিখা। পুরুষতান্ত্রিক উন্নয়ন-আঘাতের কবল থেকে গ্রাম-বাংলার নারীরাই মুক্ত করবে বাংলাদেশের জলবায়ু-পঞ্জিকার ন্যায্য পরিবর্তনশীলতা 'জলবায়ু পরিবর্তন' একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।


কিন্তু বিপর্যস্ত জলবায়ুকে ঘিরে 'জলবায়ু পরিবর্তনের' যে ধারণা সম্প্র্রতি দুনিয়াময় উচ্চারিত হচ্ছে, সেখানে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে মানুষের বিগত ২০০ বছরের কর্মকাণ্ডকে; যেসব কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত এবং ক্ষমতা কাঠামোবিহীন নয়। মূলত উত্তরের ধনী দেশের পুরুষতান্ত্রিক ভোগবিলাসের জীবনই মাতৃ দুনিয়াকে এমন এক দুর্বিষহ জলবায়ু পরিবর্তিত অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ জলবায়ুর প্রাকৃতিক পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছে, বিরাজিত থেকেছে প্রতিবেশের প্রতিটি টুকরো তারতম্যের সঙ্গে। সেই বাংলাদেশকেই আজ কর্তৃত্ববাদী ধনী দেশের হিসাবহীন কার্বন পোড়ানো জীবনের পোড়া দাগগুলো নিজেদের শরীর ও স্বাস্থ্যে নিয়ে আবারও টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তিত এই অসময়ের সবচেয়ে বড় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দেশের গ্রামীণ জনগণকে। মূলত গরিব কৃষক ও গ্রামীণ নারী এই বিপর্যস্ত জলবায়ুর সবচেয়ে বড় শিকার। কিন্তু এই গ্রামীণ নারী ও কৃষক সমাজই এখনও টিকিয়ে রেখেছে দেশের উৎপাদন খাত ও খাদ্য অর্থনীতি। কৃষির প্রতি চরমভাবে অমনোযোগী উন্নয়ননীতি এবং একই সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনকেও দেখে বৈষম্যের চশমা চোখে দিয়ে। সমাজ, রাষ্ট্র ও করপোরেট বৈষম্যের এই চশমা ভাঙতে হবে। জলবায়ু বিপর্যয়কে দেখতে হবে বাংলাদেশের মতো জলবায়ুদুর্গত গ্রামীণ নারী ও প্রান্তিক কৃষকের চোখ দিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষি ও গ্রামীণ নারীর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেললেও জলবায়ু বিষয়ক কর্মকৌশলে গরিব ও প্রান্তিক কৃষক এবং গ্রামীণ নারীরা বরাবরই বাদ পড়ে থাকেন। কিন্তু গরিব কৃষক ও গ্রামীণ নারীদের ছাড়া কোনোভাবেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
খনার বচনে অভ্যস্ত এই জনপদের গ্রামীণ নারীরা জলবায়ুর পরিবর্তনগুলোকে নিজেদের চিন্তা ও মনস্তত্ত্বে ধরতে পারলেও বিগত ৮০-৯০ বছরের পরিবর্তনকে তারা নিজেরা নিজেদের প্রকৃতিবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই সময়ে আবহাওয়া এবং জলবায়ুতে এমন দ্রুত কিছু পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, যা কৃষি পঞ্জিকানির্ভর প্রান্তিক জনগণের হিসাবে নানা রকমের গরমিল তৈরি করছে। নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকার গ্রামীণ নারীরা লক্ষ্য করেছেন, বর্তমানে আবহাওয়ার পরিবর্তনে একেক সময় ঠাণ্ডা-গরম কমবেশি হচ্ছে এবং এর ফলে হাঁস-মুরগি আর আগের মতো ডিম দেয় না এবং ডিমে তা দেওয়া মুরগির অভ্যাসেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমির আদিবাসী নারীরা জানান, দিনে দিনে গরম এত বাড়ছে যে এর প্রভাব গরু-মহিষের শরীর-স্বাস্থ্য এবং আচরণ দেখলেও বোঝা যায়। বরেন্দ্র এলাকায় ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা খরার কারণে গরুর দুধের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এভাবেই আবহাওয়ার এই উল্টাপাল্টা খেলা দুর্বিষহ করে তুলেছে গ্রামীণ কৃষি ও জুম জীবনধারা। কিন্তু আমাদের সচেতন থাকা জরুরি, গ্রামীণ জনপদের এই পরিবর্তনের জন্য সাম্প্র্রতিক জলবায়ু বিপর্যয়ই অন্যতম কারণ নয়। দেশের গ্রামীণ জনগণের প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার দিনে দিনে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। উন্নয়নের নামে কৃষি-জুমসহ সব ধরনের গ্রামীণ উৎপাদন সম্পর্ক থেকে জনগণকে বারবার উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার চলি্লশ বছরে দেশের কৃষিকে অনেকটাই কোম্পানিনির্ভর করে গড়ে তোলা হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, বিষ সংহারী বীজ, যন্ত্র ও সেচনির্ভর করে কৃষিকে করে তোলা হয়েছে এক উচ্চ গ্রহণশীল উৎপাদন খাত। তথাকথিত সবুজ বিপল্গবের নামে ষাটের দশক থেকে প্রবর্তিত রাসায়নিক কৃষি গ্রামীণ নারীর খাদ্যভাণ্ডার ও স্বাস্থ্যকে সর্বাধিক বিপন্ন করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের প্রশ্নে জলবায়ু বিষয়ক অত্যাচারকে আলোচনায় রাখা হয় না। কিন্তু নারী এই অত্যাচারের শিকার। তাই দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টানো জরুরি।
আবহাওয়াগত বিপর্যয়ের ফলে দেশের প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষক আরও বেশি দরিদ্র ও প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। ভেঙে পড়ছে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত গ্রামীণ শ্রেণী কাঠামো। ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো আঘাত হানায় এসব গ্রামীণ পরিবার আরও বেশি ক্ষতির সম্মুুখীন হচ্ছে। জায়গা-জমি, সহায়-সম্পদ সব হারিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য সহায়-সম্বলহীন নারী ও পুরুষ গ্রাম উদ্বাস্তু হয়ে অচেনা-অজানা শহরে কাজের সন্ধানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবেলা ও ত্রাণের নামে বারবার দেশের প্রান্তিক কৃষক ও নারীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। স্থানীয়দের কোনো ধরনের মতামত ও সম্মতি ছাড়াই খাওয়ার অযোগ্য খাদ্য ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হয়। দেশের অনেক জায়গায় শিশুদের দিয়ে ত্রাণসামগ্রী বহন করানো হয়। দুর্যোগ মোকাবেলার নামে মাটি কাটা, পুকুর খনন, বসতভিটা উঁচুকরণ ইত্যাদি কর্মসূচির নামে স্থানীয় মানুষকে আরও বেশি কর্মবিমুখ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় উৎপাদন সম্পর্ককে নিশ্চিত না করে দরিদ্র মানুষের স্বেচ্ছাসেবী শ্রমকে কেবল টাকার অঙ্কে হিসাব করা হচ্ছে। এতে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ সমাজে এমনকি দুর্যোগের সময় একে অপরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। দুর্গত এলাকার অনেক ত্রাণ ও আশ্রয় শিবিরে ঘটে চলেছে নারী ও শিশু নির্যাতন। এমনকি দুর্যোগ মোকাবেলা কর্মসূচিতে সমানভাবে কাজে অংশগ্রহণ করেও নারী ও পুরুষের মজুরিতে বৈষম্য থাকছে। এভাবে দুর্গত নারী আরও বেশি দুর্গত হয়ে পড়ে দুর্যোগের সময়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর রয়েছে দুর্যোগ মোকাবেলার এক সংগ্রামমুখর ইতিহাস। সমস্যা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনসহ দুর্যোগ মোকাবেলার কোনো উন্নয়ন ও উদ্যোগে গ্রামীণ জনগণের এই লোকায়ত কর্মকৌশল ও জ্ঞানকে কখনও গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হয় না। লোকায়ত অভিযোজন কৌশলকে দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজে লাগানো জরুরি। সর্বজনীন প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্ঞানে নারী ও প্রান্তিক কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবেলার জাতীয় কৌশল ও কর্মপরিকল্পনায় গ্রামীণ জনগণের পরামর্শ ও জ্ঞান-অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। দুর্যোগ ঠেকাতে উত্তরের ধনী দেশের ওপর চাপ তৈরি করতে দুর্গত দেশের গ্রামীণ নারী ও কৃষকদের কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। দুর্গত গ্রামীণ জনগণের জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য নাগরিক সামাজিক আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে। গণমাধ্যমকে আরও বেশি জনবান্ধব ও বৈষম্যহীন হতে হবে। দেশের নারী ও কৃষকের কোনো অপমান ও ক্ষতি হয়, এমন কোনো জলবায়ুগত চুক্তি বা কার্বন-বাণিজ্যের মতো কর্মসূচি গ্রহণে রাষ্ট্রকে বিরত থাকতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যাতে উচ্ছেদ হয়ে জন্মমাটি ছেড়ে বারবার নিরুদ্দেশ না হয় তার নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে। জলবায়ুদুর্গত সবার কাজ-সম্পদ-জীবিকার নিশ্চিত নিরাপত্তা দিতে হবে। জাতীয় নারীনীতি, কৃষিনীতি, জলবায়ু কর্মকৌশলকে সমন্বিত করে কর্মপ্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে গরিব মানুষের ওপর অন্যায় কৃষিবাণিজ্য ও গবেষণার কর্মসূচি চাপানো যাবে না। আর কয়েকদিন বাদেই আসবে ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নগর ও গণমাধ্যমে কিছু উন্নয়নবাদী নড়াচড়া হবে। কিন্তু সব বিপর্যয়ের জন্য দায়ী পুরুষতান্ত্রিক উন্নয়ন-আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না রাষ্ট্র। কারণ এই নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা 'এক চিমটি' নারী অধিকারকে জায়গা দিয়ে উন্নয়নের স্যালাইন বানায়। নয়া উদারবাদী স্যালাইন দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক উন্নয়ন-আঘাতের ডায়রিয়া সারবে না। এর জন্য জরুরি এক সত্যিকারের সাহসী জাগরণ। ইতিহাস থেকে ইতিহাসে কালজয়ী নারীরা সে সাহস দেখিয়েছে। জানি, জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আবারও জাগবে এক সম্মিলিত অগি্নশিখা। পুরুষতান্ত্রিক উন্নয়ন-আঘাতের কবল থেকে গ্রাম-বাংলার নারীরাই মুক্ত করবে বাংলাদেশের জলবায়ু-পঞ্জিকার ন্যায্য পরিবর্তনশীলতা।

পাভেল পার্থ :গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
animistbangla@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.