আমরা ক্ষমা চাই by ড. হাসিবুর রহমান

গত ১২ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত অবমাননা ও গ্লানিকর একটি দিন। এদিন দুপুরের পর পরই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে দেশের মানুষ জানতে পেরেছে এবং বিশ্বাস করছে, শিক্ষক সমিতির সভায় হাতাহাতি হয়েছে। শিক্ষক সমিতির সভাপতি লাঞ্ছিত হয়েছেন। কোনো কোনো ইলেট্রনিক মিডিয়া তাঁর গুরুতর আহত হওয়ার খবরও প্রচার করে। এর সঙ্গে যোগ হয় একটি ভিডিওক্লিপ প্রচার, যেখানে একজন শিক্ষককে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় মঞ্চে দেখা


যায়। তাঁর শারীরিক ভাষা, তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা, দুঃখ-ভারাক্রান্ত সভাপতির ভিডিও ছবি পরদিন দৈনিক পত্রিকাগুলোর খবর বিশেষ করে একটি অগ্রগামী ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের বরাত দিয়ে প্রক্টরের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে ঘুষি মারার খবর প্রকাশ- সব মিলিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ললাটের কলঙ্কের কালিমা লিপ্ত হয়েছে। জাতি বিশ্বাস করেছে, এই শিক্ষক সমাজ দিয়ে আর যা-ই হোক, মানুষ গড়ার কারিগর তৈরি অসম্ভব। এ কারণেই ১২ জানুয়ারি দিনটি শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, শিক্ষক সমাজের জন্য একটি লজ্জা, বেদনা ও গ্লানিকর দিন। এই গ্লানির প্রায় পুরোটাই লেখক-সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁদের ১৭ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধে চাপিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন-শিক্ষকদের কাঁধে। ১২ জানুয়ারির ঘটনাবলিতে নবীন শিক্ষকদের যে ভূমিকা তাঁরা চিত্রিত করেছেন, আমি সবিনয়ে তাঁদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি। অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদকে বলতে চাই স্যার, আপনি প্রতারিত হয়েছেন। যাঁরা আপনাকে ১২ জানুয়ারির ঘটনার বিরণ শুনিয়েছেন, তাঁরা সত্য ভাষণ দেননি। ১১ জানুয়ারি জরুরি সাধারণ সভার মুলতবি অধিবেশন ১২ জানুয়ারি শুরু হওয়ার পর তৃতীয় বক্তা জুবায়ের আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন শিক্ষক সমিতির সভাপতির সামাজিক কর্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ছাড়া সভাপতি কর্তৃক কার্যকরী পরিষদের তাঁর বলয়ের বাইরে বাকি ১১ জন নির্বাহী সদস্যের প্রতি সভার শুরুতেই অত্যন্ত অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ার সমালোচনা করেন এবং কার্যকরী পরিষদের জরুরি সভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত বিকৃত করার তীব্র সমালোচনা করে তিনি মন্তব্য করেন, 'আপনার জায়গায় আমি হলে এই নৈতিক গ্লানি নিয়ে পদত্যাগ করতাম।' এরপর সভায় আর শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়নি। বক্তার বক্তব্যের মধ্যেই চিৎকার করে তাঁর বক্তব্য প্রদানে বাধা দেওয়া হয়, আবার অন্য অনেকেই সভা চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে তাঁদের শান্ত হয়ে বসার আহ্বান জানান। এ পর্যায়ে একজন সিনিয়র শিক্ষক একজন নবীন শিক্ষককে বলেন, 'তুই বস'। এই 'তুই' বলা নিয়ে উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ সময় ওই সিনিয়র শিক্ষক (যিনি সভাপতির অনুসারী) অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় মঞ্চে গিয়ে মাইকে তাঁর একসময়ের ছাত্র ও বর্তমান সহকর্মীকে 'তুই' বলার বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে মঞ্চে উপবিষ্ট সাধারণ সম্পাদক এবং মঞ্চের নিচে থেকে আসা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক অনুসারী আরো একাধিক শিক্ষক তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন, যার ভিডিওক্লিপ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। এ পর্যায়ে সভাপতির অনুসারী একজন শিক্ষক তাঁকে দ্বিতীয় দিনের জন্য সভা মূলতবি করার পরামর্শ দিলে সভাপতি সভা মূলতবি করে সভাস্থল ত্যাগ করেন। কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদের ভাষায় 'কই যাস? দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে বের হয়ে যা। অসৌজন্যমূলক সম্বোধন হাতের বলিষ্ঠ ব্যবহার'- এই বর্ণনা কাল্পনিক। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আবুল মকসুদকে আবারও বলতে চাই, স্যার আপনি প্রতারিত হয়েছেন।
আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাই। ১৩ জানুয়ারি Daily Star জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষকের বরাত দিয়ে প্রক্টর সভাপতিকে ঘুষি মারার যে সংবাদ পরিবেশন করে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলতে চাই, এই তথ্যটি সঠিক নয়। আমরা শিক্ষকরা সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশে প্রচলিত সংকীর্ণ রাজনৈতিক কূটকৌশলকেও হার মানিয়েছি। এ জন্য শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে জাতির কাছে ক্ষমা চাই। ফারুক ওয়াসিফের লেখায় নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় ২০০ জন শিক্ষকের নিয়োগের সংখ্যাটি সঠিক। গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন চালু করা প্রায় ১০টি আধুনিক বিভাগ ও নিকটঅতীতে খোলা বিভাগগুলোর কলেবর বৃদ্ধির কারণে এই সংখ্যাটি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তিনি এই ২০০ জন শিক্ষকের যোগ্যতা ও মানসিক উৎকর্ষতা নিয়ে যেভাবে প্রশ্ন তুলেছেন, সেটি সঠিক নয়। তিনি বাইরের মানুষ, আমি তাঁকে দোষারোপ করবা না, কারণ তাঁকেও সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি। এমনকি আমাদের একজন সম্মানিত শিক্ষক দাবি করেছেন, শিক্ষক নিয়োগের নামে ভিসি গুণ্ডাপান্ডা নিয়োগ দিয়েছেন (মানবজমিন ১৫ জানুয়ারি)। কিন্তু একটা তথ্য আমি জানাতে চাই, এই ২০০ জনের মধ্যে অন্তত ৫০ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মেধা তালিকার শীর্ষে আছেন। অন্ততপক্ষে ১৫০ জন মেধাতালিকার প্রথম শীর্ষ চারের মধ্যে আছেন। অন্ততপক্ষে ২০ জন দেশে-বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চয.উ ধারী আছেন। আপনারা ঢালাওভাবে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না। ফারুক ওয়াসিফের ভাষায়, 'নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ২০০ জন শিক্ষক, শিক্ষক সমিতির সভায় হাতাহাতি করে প্রমাণ করেছেন তাঁদের নিয়োগদাতার হাত কত শক্তিশালী।' অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে চাই, ফারুক ওয়াসিফ আপনিও প্রতারিত হয়েছেন। আপনার কাছেও ক্ষমা চাই কিন্তু একজন সাংবাদিক হিসেবে আপনি নিজ দায়িত্বে সত্যানুসন্ধানের দায় এড়াতে পারেন না। আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, সেদিন সভাস্থলে কোনো হাতাহাতির ঘটনা ঘটেনি; এবং এই ২০০ জন নবীন শিক্ষক কোনো হাতাহাতিতে অংশগ্রহণ করেননি। এত বেশিসংখ্যক নবীন শিক্ষকের সামাজিক লাঞ্ছনা, অসম্মানের মনোবেদনা ও ক্ষোভের ওপর পাড়া দিয়ে হয়তো অনেক উপরে ওঠার সিঁড়ি পাওয়া যায়, নোংরা গোষ্ঠী রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে যাওয়া যায় কিন্তু সর্বস্তরের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও সম্মান এভাবে পাওয়া যায় না এবং একজন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করি, এভাবে জীবনে শান্তিও আসে না। সবশেষে আমি ইলকট্রনিক মাধ্যম ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গ্লানিকর যেকোনো ঘটনা অবশ্যই জাতি হিসেবে আমাদের সবার জন্য গ্লানিকর।
আপনারা সত্যানুসন্ধান করুন। এবং প্রকৃত লজ্জা, গ্লানি ও অপমানের জায়গাগুলো চিহিত করে মুক্তচিন্তা ও উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ হিসেবে স্বপ্নের সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে সহায়তা করুন। মিথ্যার আড়াল থেকে সত্য প্রকাশিত হতে মাঝেমধ্যে হয়তো কিছুটা সময় নেয়, কিন্তু তা মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সূর্যের মতোই ভাস্বর। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, এই বিশ্ববিদ্যালয় অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর। এখনো যা কিছু ভালো ও মঙ্গলময়, তাঁর জন্য নিবেদিতপ্রাণ প্রভাষক থেকে শুরু করে অধ্যাপক পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষকের অভাব নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাতেগোনা দু-একজন আছেন, হয়তো যাঁরা গোষ্ঠীস্বার্থের খাতিরে বিশ্ববিদ্যালয় তথা, জাতিকে যেকোনো লজ্জার মুখোমুখি কেেত দ্বিধা করেন না। লেখাটি দীর্ঘ হওয়ায় পাঠকের কাছে ক্ষমা চাই। আমরা জুবায়েরকে বাঁচাতে পারিনি এ জন্য তাঁর মা-বাবার কাছে ক্ষমা চাই। নীতিহীন ছাত্র রাজনীতির নীল ছোবলে আক্রান্ত মেধাবী ছাত্রদের সর্বনাশের পথ থেকে আমরা সরিয়ে আনতে পারিনি বলে জাতির কাছে ক্ষমা চাই। শিক্ষকতার মহান পেশায় এসেও নারী নিপীড়নের দায় নিয়ে শাস্তি পেতে হয়, এ জন্য আমরা জাতির কাছে ক্ষমা চাই।

লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ

No comments

Powered by Blogger.