সপ্তাহের হালচাল-আপদ বিপদ আর মুসিবত by আব্দুল কাইয়ুম

চাঁদপুরে ১৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সমাবেশে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারকে এক ব্যতিক্রমী হুমকি দিয়ে বলেন ‘লুলা-ল্যাংড়া’ বানিয়ে ছেড়ে দেব। আগামী ১২ মার্চ ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে কি চারদলীয় জোট সেই পরিকল্পনা নিয়েছে? তাহলে তো পুলিশ বসে থাকবে না।


বেগম খালেদা জিয়া এত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হয়ে ওরকম হিংসাত্মক কথা জনসমাবেশে প্রকাশ্যে কীভাবে উচ্চারণ করলেন? সরকারের হাতে এমন একটা অস্ত্র তিনি তুলে দিলেন যে এরপর পুলিশের জেল-জুলুম-অত্যাচারের প্রতিবাদের যৌক্তিক ভিত্তি তাঁদের আর থাকবে না। কারণ, তাঁরাই তো আগ বাড়িয়ে আঘাত হানার প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন। এরপর পুলিশ যা কিছু করবে, তা করবে ‘আত্মরক্ষার’ স্বার্থে। বলবে, না হলে তো ‘লুলা-ল্যাংড়া’ বানিয়ে ছাড়বে! সরকারকে ‘লুলা-ল্যাংড়া’ বানাতে হলে যে হিংসাত্মক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, তা ভাবলেও চমকে উঠতে হয়। হাতুড়ি পেটা বা দুরমুজ না করলে তো কাউকে লুলা-ল্যাংড়া বানানো যায় না। তাহলে কি বিএনপি সে পথেই যাচ্ছে?
এই হলো বিএনপিকে নিয়ে বিপদ। তারা সহজে লুলা-ল্যাংড়া বানানোর কথা ভাবতে পারে, কারণ তাদের সঙ্গে রয়েছে জামায়াত-শিবিরের মতো দল, যারা হাত-পায়ের রগ কাটা-কব্জি কাটার রাজনীতিতে অভ্যস্ত। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, এই সময় সরকারকে লুলা বানিয়ে ছাড়তে পারলে তাদের পোয়া বারো!
একজন রোগী গেছেন চোখের ডাক্তারের কাছে। চিকিৎসার ফাঁকে ফাঁকে তিনি রাজনীতির আলাপ জুড়ে দিলেন। বললেন, তিনি প্রায়ই রাত জেগে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে মনোযোগ দিয়ে টক শো দেখেন। কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের একটি মন্তব্য তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। তিনি বলছিলেন, দেশ এখন আপদ, বিপদ আর মুসিবতের পাল্লায় পড়েছে। আপদ মানে আওয়ামী লীগ, বিপদ মানে বিএনপি আর মুসিবত মানে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা।
আপাতত বড় মুসিবতের তারিখ পড়েছে ১২ মার্চ। সেদিন বিএনপির ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, মার্চ মাসজুড়েই তাদের কর্মসূচি থাকবে। কর্মসূচিতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। শুধু ১২ মার্চ কর্মসূচি না দিলেই হলো। কিন্তু তারা কি ওই দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? এত সুবোধ বালক তো তারা নয়। একটা পত্রিকায় দেখেছি, ১২ মার্চ বিএনপির পাল্টা কোনো কেন্দ্রীয় কর্মসূচি না দিয়ে পাড়া-মহল্লায় সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। কথা তো সেই একই। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যটা কী? ওই দিন বিএনপির ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে লোকজনকে জড়ো হতে দিতে চায় না নাকি?
গত ১২ ফেব্রুয়ারি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক আলোচনা সভায় এ রকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। জনগণের ‘চোখের ভাষাকে’ বোঝার চেষ্টা করার পরামর্শ দিয়ে তিনি সরকারকে বলেন, তারা যেন গণতন্ত্রকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়। তাঁর পরামর্শটা ভালো। বিরোধী দলকে কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া গণতন্ত্রসিদ্ধ নয়। আওয়ামী লীগ তথা ক্ষমতাসীনদের সেটা মেনে চলতে হবে। না হলে কিসের গণতন্ত্র?
কিন্তু বিএনপি যে ‘ঢাকা চলো’ বলে একটা হুজুগ তুলেছে, সেটা গণতন্ত্রের কোন ব্যাকরণে পড়ে? যেখানে ঢাকাতেই দেড় কোটি মানুষ, সেখানে আবার বাইরে থেকে আসতে হবে কেন? ঢাকার লোকজনের শতকরা এক ভাগকে রাস্তায় ডাক দিলেই তো ১৫ লাখ লোকে রাজধানী সয়লাব হয়ে যাবে। বিএনপি দাবি করে, তাদের পক্ষে সব মানুষ। তাহলে সেই মানুষদের একবার মাঠে নামালেই তো যথেষ্ট।
‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিটাকে একটু ঘুরিয়ে তারা বলুক ‘সংসদে চলো’। ঢাকার সেই ১৫ লাখ লোক সংসদ ভবনের চারপাশে ‘মানববন্ধন’ করে ঘিরে রাখবে, আর বিরোধী দল যাবে সংসদে। তাহলে নিশ্চয়ই আর ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলের নেতাদের বক্তৃতার সময় ‘মাইক বন্ধ করে’ দেওয়ার বা বিরোধী দলকে ‘অশালীন’ ভাষায় কিছু বলার সাহস পাবে না। বিএনপি তো এই সব অজুহাত তুলেই সংসদে যায় না। সেটা যদি এই পথে দূর করা যায়, তাহলে ওরকম কর্মসূচি নেয় না কেন?
বিএনপি এর আগে ঢাকায় গণমিছিলের কর্মসূচি নিলে আওয়ামী লীগও সেই একই দিন সমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে ভুণ্ডল করার পায়তারা করেছিল। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে সব সমাবেশ-মিছিল বন্ধ করে। কিন্তু পরদিন সমঝোতার ভিত্তিতে আবার দুই পক্ষই কর্মসূচি পালন করে। এই সমঝোতার পথে যাওয়াই তো ভালো।
কিন্তু রাজনীতিতে সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। বরং অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। ক্ষমতাসীন দল লাঠিপেটা করে বিরোধী দলকে ঠান্ডা করতে চায়। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলেই পাইকারি গ্রেপ্তার করে কয়েক হাজার ‘অজ্ঞাত’ আসামির নামে মামলা করে। তারপর বেছে বেছে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের নাম সেই মামলায় ঢুকায়। এভাবে হয়রানি করা হয়। আর ওদিকে পুলিশেরও কিছু বাণিজ্যের সুবিধা হয়। কারণ যে কারও নাম সেই মামলায় ঢোকানোর সুযোগ তো তাদের আছেই। এভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।
এটা নিশ্চয়ই নিন্দনীয়। কিন্তু বিএনপি কি ভুলে গেছে যে তাদের বিগত সরকারের সময়ও তারা সেই একই নিন্দনীয় কাজগুলো করেছে? আজ তারা বলে আওয়ামী লীগ ‘স্বৈরাচারী’ আচরণ করছে। একই অভিযোগ আওয়ামী লীগ করত চার-পাঁচ বছর আগে বিএনপির সরকারের বিরুদ্ধে। ২০০৬ সালের এপ্রিলে ১৪ দলীয় জোটের হরতালের সময় ঢাকায় যুব মহিলা লীগের মিছিলে পুলিশ হামলা চালিয়ে একজন নারী কর্মীকে যেভাবে টানাহেঁচড়া ও অপমান করেছিল, সে কথা কি কেউ ভুলতে পারে? পুলিশের সেই নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর ছিঃ ছিঃ পড়ে যায়।
এখন ঘটনা আবার সেদিকেই যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা দেবে না। আর বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচন করবে না। রাজপথে এর কোনো সমাধান নেই। আলোচনায় বসতে হবে। বিএনপি নির্বাচন কমিশনও মানবে না। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন করতে হলেও তো নির্বাচন কমিশন লাগবে। সরকার নির্বাচন করে না, তারা কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাহায্য করে। তাহলে নির্বাচন কমিশনকে অস্বীকার করে কী লাভ?
অনেকে মনে করেন পরিস্থিতি আবার ২০০৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের মতো পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। আবার হয়তো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ঘটবে। গণতন্ত্র, নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে। এ রকম পরিণতি কারও কাম্য নয়। আন্দোলন, ঘেরাও, অবরোধ এমনকি দু-চারটা হরতাল হলেও হোক, এর বেশি কিছু মেনে নেওয়া যাবে না। ‘লগি-বৈঠা’ বা ‘ল্যাংড়া-লুলা’র চিন্তা বাদ দিতে হবে। ওগুলো আর চলবে না। সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথ হবে নির্বাচন। সময় হলে সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। মানুষ যাকে ভোট দেবে ওরা সরকার গঠন করবে। এর বাইরে অন্য কোনো পথ গ্রহণযোগ্য নয়। এখন সেই নির্বাচন কি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে, নাকি ‘অন্তর্বর্তী’ সরকারের অধীনে হবে, সেটা ঠিক করে নিক রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো।
মিয়ানমারে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে, আর বাংলাদেশে এই সময় সংবিধানবহির্ভূত তৃতীয় কোনো শক্তি চেপে বসবে, তা কী করে হয়? মিয়ানমারে ১৯৬২ সাল থেকে সামরিক শাসন চলছে। কিন্তু এখন তারা গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসতে চাইছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, অন্যান্য রাজবন্দীকেও মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনে সু চি অংশগ্রহণ করছেন। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর থেকে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার প্রাথমিক উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। এই অঞ্চলে এখন কোনো সংবিধানবহির্ভূত উপায়ে ক্ষমতার হাতবদলের কথা চিন্তা করার ভিত্তি নেই।
সুতরাং যা করতে হবে, সংবিধানের মধ্যেই করতে হবে। রাজনৈতিক বিবাদ যা থাকে, সংসদের ভেতরেই তার মীমাংসা করতে হবে।
আপদ-বিপদ আছে, থাকবে হয়তো আরও বহু বছর। কিন্তু ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে দেবেন না। এই বালা-মুসিবত থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে যত্নবান হতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.