রঙ্গব্যঙ্গ-ঘাতকের দিনলিপি by মোস্তফা কামাল

কেরানীগঞ্জে গলাকাটা আমজাদ নামের এক সন্ত্রাসী ছিল। সে দিনদুপুরে মানুষ জবাই করত। টাকা দিয়ে তাকে মানুষ খুন করার জন্য নেওয়া হতো। মাত্র ১০ হাজার টাকায় একজন মানুষ খুন করত সে। তার ভয়ে এলাকার মানুষ থরথর করে কাঁপত। সে কারো কাছে চাঁদা নিতে আসত না; মানুষ তাকে বাড়িতে দিয়ে আসত।


চাঁদাবাজির টাকা দুই হাতে খরচ করত আমজাদ। কথায় বলে না, যে পথে আয় সে পথে ব্যয়। আমজাদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল। টাকা যতই আয় হতো, ততই খরচ হতো। তার একমাত্র ছেলে ছিল। নাম আক্কাস আলী। তার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। পড়াশোনাও খুব একটা করেনি।
আক্কাস আলী একদিন তার বাবা গলাকাটা আমজাদকে বলে, 'বাবা, মানুষে বলে, বাঘের ছেলে বাঘ হয়, বিড়ালের ছেলে বিড়াল। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো হয়েছে। আপনি বাঘ আর আমি হয়েছি বিড়াল।'
_এই, কী বলিস এসব! আমি বাঘ!
_কথার কথা বললাম আর কি!
_আচ্ছা বাবা, আপনি তো সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি করে জীবন পার করলেন। আমার তো আপনার মতো অত সাহস নেই। আমার কী হবে? আমি কী করে খাব?
আমজাদ বেশ ভাব নিয়ে বলল, 'তুই আমার নাম বেইচা খাবি।'
_কিন্তু আপনি তো আগে বলতেন, 'দাদার নামে গাধা, বাবার নামে আধা, নিজের নামে শাহজাদা।'
আমজাদ বলল, 'সেই কথা ভুলে যাও বাবা আক্কাস আলী! এখন উল্টো গীত গাও। নিজের নামে গাধা, দাদার নামে আধা, বাবার নামে শাহজাদা।'
আক্কাস আলী মনে মনে ভাবে, কী করে বাবার নাম বেচা যায়! আমি বরং একটা ব্যাগ বানাই। সেই ব্যাগের ওপর লেখা থাকবে, 'আমি গলাকাটা আমজাদের ছেলে'। আমি যত অন্যায় কাজ করব বাপের নামে করব। ভালোই হলো। নিজের নামটা সেফ থাকল।
আক্কাস আলীর টাকা দরকার। সে ব্যবসায়ীদের কাছে যায়। তারপর তাদের ইশারায় ব্যাগটা দেখায়। তাতে তারা বুঝে যায়। ব্যবসায়ীরা চাঁদা দিয়ে আক্কাসকে বিদায় করেন। আক্কাস বাসে উঠলে কন্ডাক্টর ভাড়া চায়। সে ব্যাগটা দেখায়। তখন কন্ডাক্টর কাঁচুমাচু করে বলে, 'সরি, ভুল হইয়া গেছে।'
বাজারে গিয়ে চাল ডাল মাছ তরিতরকারি কিনে আক্কাস পয়সা দেয় না। ব্যাগ দেখিয়ে চলে আসে। এভাবে আক্কাসের দিন কাটে। কিন্তু দিন তো আর মানুষের এক রকম যায় না! এলাকার মানুষ সচেতন হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, আক্কাস আবার বাপের নামে চাঁদাবাজি করলে তাকে শায়েস্তা করবে। বাপের নাম ভোলাবে। যে কথা সেই কাজ। আক্কাস আলী যখন ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে চাঁদা দাবি করল তখন সবাই মিলে তাকে দিল দৌড়ানি। সেই দৌড়ে এলাকাছাড়া হলো আক্কাস আলী।

২.
লক্ষ্মীপুরের গডফাদার আবু তাহেরের নাম কে না জানে! হালে তিনি পৌর মেয়র হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির ডজনখানেক মামলা। তাঁর সুযোগ্য (!) ছেলে বিপ্লব আক্কাস আলীদের মতো নয়। সে বাপের চেয়ে কয়েক ডিগ্রি ওপরে। লোকে বলে, তাহেরের ভয়ে লক্ষ্মীপুর কাঁপে আর বিপ্লবের ভয়ে দেশ কাঁপে।
বিপ্লবকে নিয়ে এবার একটা গল্প বলি। বিপ্লব তখন ছোট। কৈশোর তখনো পার হয়নি। মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল। খেলার এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হলো। তারপর ভীষণ ঝগড়া বেধে গেল। ঝগড়ার এক পর্যায়ে বিপ্লব দৌড়ে গিয়ে সেলুন থেকে একটা ক্ষুর নিয়ে এল। তারপর মাঠে এসে একজনের কান কেটে দিল। এ নিয়ে তো হৈ-হট্টগোল! এলাকার লোকজনও জড়ো হলো। বিপ্লবকে ধরল। তার বিচার হবে। কিন্তু কে করে তার বিচার! বিপ্লবের বাবা আবু তাহের ঘটনাস্থলে এসে গর্জন করে উঠলেন। 'আয়, কে করবি আমার ছেলের বিচার? ছেলে তো কান কাটছে। আমি ভুঁড়ি গালিয়ে দেব।'
ভয়ে এলাকার লোকজন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল। আবু তাহের ছেলেকে ডাকলেন। তারপর বললেন, 'দেখলে আমার পাওয়ার? আমার একার গর্জনে সব লোক নীরবে চলে গেল। কিন্তু বাপধন, আমার গর্জনের তো মূল্য আছে, নাকি? ছোটখাটো ঘটনার জন্য তো আমি গর্জন দিতে পারব না। আমি গর্জন দেব বড় ঘটনার জন্য। তোমাকে বাপধন, কান কাটতে কে বলল? তুমি ভুঁড়িটা গালিয়ে দিতে পারলে না? তুমি আবু তাহেরের ছেলে। আবু তাহেরের ইজ্জত এত ছোট না, বাপধন! তুমি বুঝতে পারছ? ভবিষ্যতে যেন মনে থাকে।'
ব্যস, বাপের সাহস পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে বিপ্লব। তার পর থেকে বিপ্লব একে মারে ওকে ধরে। কথায় কথায় মানুষকে গালমন্দ করে। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি তো আছেই! একবার বিপ্লব হাতে রামদা নিয়ে বিএনপি নেতা নূরুল ইসলামের বাড়িতে যায়। রামদা উঁচিয়ে বলে, 'কোথায় নূরুল ইসলাম। বড় নেতা হয়েছে নাকি! দেখি কত বড় নেতা হয়েছে!'
নূরুল ইসলাম উপায়ান্তর না পেয়ে খাটের নিচে লুকান। কিন্তু লুকিয়ে থাকবেন কতক্ষণ! বিপ্লব তাঁকে খুঁজে বের করে। তারপর ঘাড়ের ওপর রামদা রেখে বলে, 'এখন আমি তোর জান কবজ করব! হি হি হি!'
নূরুল ইসলাম প্রাণভিক্ষা চান তার কাছে।
বিপ্লব আবার হাসে_'হি হি হি! প্রাণভিক্ষা! এইটা আবার কী?
বিপ্লব রামদা দিয়ে তাঁকে কুপিয়ে মারে। তারপর বাড়িতে এসে বলে, 'বাবা, নূরুল ইসলামকে খুন করে এসেছি। এই যে দেখেন, আমার হাতে রক্ত!'
আবু তাহের তার পিঠ চাপড়ে বলে, 'সাব্বাস! বাঘের বাচ্চা! এবার প্রমাণ করলি, তুই আবু তাহেরের ছেলে।'
এবার আইনের বেরসিক লোকটি বিপ্লবের দরজায় কড়া নেড়ে বলল, 'বাছাধন, মানুষ মেরে পার পাওয়া যায় না! এবার চলো লাল দালানের ভাত খাবে। তারপর ফাঁসিতে ঝুলবে।'
অবশেষে বিপ্লবের ফাঁসির আদেশ হলো। কারাগারে ফাঁসির প্রকোষ্ঠে বসে বিপ্লব কাঁদে আর বলে, 'বাবা, তুমি আমাকে ছোটবেলা থেকে সাহস দিয়েছ বলেই তো খুন করতে পেরেছিলাম। এখন আমার নাকি ফাঁসি হবে?'
দূর থেকে আবু তাহের ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বলে, 'কে বলেছে তোর ফাঁসি হবে। তোর পাশে দয়ালু রাষ্ট্রপতি আছেন। তিনি দেবেন প্রাণভিক্ষা।'
_কিন্তু বাবা, আমি তো নূরুল ইসলামকে প্রাণভিক্ষা দেই নাই।
_তাতে কী?
তারপর দেশ-কাঁপানো ঘটনা ঘটল! বিপ্লবকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দিলেন। বিস্মিত দেশবাসী বলল, ঘাতক পেল ক্ষমা! একি করলেন রাষ্ট্রপতি! তিনি কি তাঁর স্ত্রীর হত্যাকারীকে ক্ষমা করবেন!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.