দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি-শুধু নির্দেশ দেওয়া নয়, কার্যকরও করতে হবে

এটাই তো রাষ্ট্রের উপযুক্ত কাজ। মহলবিশেষ যেন দেশের মানুষকে ঠকাতে না পারে কিংবা গলা টিপে ধরতে না পারে, তার নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। বাজার থেকে চিনি উধাও হয়ে গিয়েছিল। অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে ক্রেতারা দোকানে দোকানে ঘুরেও এক মুঠো চিনি সংগ্রহ করতে পারেননি। আর গোপনে কোথাও চিনি বিক্রি হলেও তা বিক্রি হয়েছে


সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে। অথচ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, দেশে এ সময় চিনির কোনো অভাব ছিল না। চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরের গুদামগুলোতে চিনির বিপুল মজুদ ছিল। বন্দরে চিনির জাহাজগুলো অপেক্ষমাণ থাকলেও সেগুলো থেকে চিনি খালাস করা হচ্ছিল না। তার অর্থ হলো, নৈতিক বা মানবিক মূল্যবোধবর্জিত কিছু ব্যবসায়ীর কারসাজিতেই বাজারে চিনির কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। এর আগে পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে কম লাভে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করা এবং বাজার স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেছিলেন। ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওয়াদাও করেছিলেন। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী চিনি নিয়ে ব্যাপক কারসাজির আশ্রয় নেন, ফলে বাজারে চিনির সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় সরকারও কিছুটা কঠোর অবস্থানে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী পুনরায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এবং যেকোনো ধরনের কারসাজি বন্ধ করার নির্দেশ দেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আট ডিও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং চার উৎপাদককে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে হাইকোর্টও সরকারের প্রতি বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেশকিছু নির্দেশ দেন। আমরা দেখলাম, সরকারের সামান্য চোখ রাঙানিতেই আশ্চর্য ভোজবাজির মতো চিনির বাজার স্বাভাবিক হয়ে গেল। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে এখনো এ দেশে এমন কিছু ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা অনুরোধ বোঝেন না, কেবল চোখ রাঙানি বোঝেন। আর সরকার কঠোর হলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
আসলে যার যেমন স্বভাব তার সঙ্গে তেমন আচরণই করতে হয়। সরকার বড় দেরিতে তা উপলব্ধি করেছে। প্রকৃত অর্থে এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো কৌশলই সরকারের হাতে নেই। আর তা না থাকলে একসময় এই চোখ রাঙানি কেন, হাতুড়ি মারলেও কোনো কাজ হবে না। আগের সরকারগুলোর আমলে তো নয়ই, এই সরকারের আড়াই বছরেও টিসিবিকে কার্যকর করা গেল না। কসকর কিংবা রেশন ব্যবস্থা চালু করারও কোনো উদ্যোগ নেই। অভিযোগ আছে, ব্যবসায়ীদের একাংশের অনুরোধেই সরকার তা করছে না। কিন্তু সরকার ব্যবসায়ীদের অনুরোধ শুনলেও ব্যবসায়ীরা যে সরকারের অনুরোধ শোনেন না, তা তো আমরা দেখতেই পেলাম। মাঝখানে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। অনেকের ঘরে রোগীকে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়ানোর মতো এক মুঠো চিনিও নেই। তাদের কথা কি কেউ ভাবে? অথচ নির্বাচনের সময় দেশের মানুষকে নানা রকম গালভরা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের পর আর সেসব প্রতিশ্রুতির কথা মনে রাখা হয় না। কিন্তু জনগণের বিপুল ম্যান্ডেটে জিতে আসা মহাজোট সরকারের কাছে মানুষ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সেই একই ধারাবাহিকতা আশা করেনি। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখাকে বর্তমান সরকার তাদের বাকি সময়টুকুতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আর সে জন্য টিসিবিকে কার্যকর করতে হবে, রেশনিং ব্যবস্থা আবার চালু করতে হবে, বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়িয়ে ক্রেতা ঠকানো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনীতিবিদদের মনে রাখা প্রয়োজন, আবারও তাঁদের জনগণের কাছে যেতে হবে। দুই দশকের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, জনগণ যেমন ক্ষমতায় বসাতে পারে, তেমনি প্রতিশ্রুতি না রাখলে প্রত্যাখ্যানও করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.