চিরকুট-চলচ্চিত্রের ফেরিওয়ালা by শাহাদুজ্জামান

শেষদিকে নিজেকে চলচ্চিত্রের ফেরিওয়ালা বলেই অভিহিত করতেন তারেক মাসুদ। নিজের ছবি রানওয়ে নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন, নিজেই টিকিট বিক্রি করেছেন, প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। খুব শখে করেননি। দেশের প্রচলিত চলচ্চিত্র পরিবেশনা ব্যবস্থা থেকে সহযোগিতা না পেয়ে নানা জেলা শহরের চলচ্চিত্র সংসদের তরুণ কর্মীদের সহায়তায় বিকল্প পরিবেশনা ব্যবস্থায় যেতে হয়েছিল তারেককে।


প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতা তারেকের জন্য নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। সেন্সর বোর্ড তাঁর ছবি আটকে দিয়েছে, চরম দুর্দিনেও রাষ্ট্রের কাছে থেকে ছবি নির্মাণের জন্য কোনো আনুকূল্য পাননি। নিজের সম্পদ, সঞ্চয় বিক্রি করে নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র। অথচ কোনো বাণিজ্যবুদ্ধির তাড়নায় নয়, এমনকি শুধু শিল্পসৃষ্টির প্রণোদনা থেকেও নয়। লক্ষ করি, তারেক চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছিলেন মূলত তাঁর দেশপ্রেম উদ্যাপনেরই একটি মাধ্যম হিসেবে। তিনি এ দেশে বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করার জন্য যেমন প্রাণাতিপাত করেছেন, তেমনই নিজের ছবিতে তুলে এনেছেন এ দেশের যা কিছু গৌরবের—মুক্তিযুদ্ধ কিংবা লোকজীবনের ঔদার্য। কিন্তু প্রচলিত বাণিজ্যকাঠামোর বাইরে থেকে, বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কোনো সৃজনশীল চর্চা করতে গেলে এ দেশে যে নিরতিশয় দুর্ভোগে পড়তে হয়, এর আদ্যোপান্ত অভিজ্ঞতা তারেকের হয়েছে।
আশির দশকের গোড়ায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পথিকৃৎ মুহাম্মদ খসরুর অনুপ্রেরণা, গুণী চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের উসকানি—সব মিলিয়ে অনেক তরুণ তখন চড়ে বসেছিলেন চলচ্চিত্রের ভেলায়, সে ভেলার আমিও এক যাত্রী। চলচ্চিত্র তখন ছিল আমাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনেরও এক হাতিয়ার। ফিল্ম আর্কাইভের চলচ্চিত্র অধ্যয়নের অংশ হিসেবে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অগণিত উঁচু শৃঙ্গ দেখে যেমন আপ্লুত হয়েছি, তেমনি বেদনার্ত হয়েছি আমাদের নিজস্ব চলচ্চিত্রের দিকে তাকিয়ে। সেখানে কেবলই গুটিকয় ঢিপি কিংবা বড়জোড় টিলা। শৃঙ্গের সাধ জেগেছে, কিন্তু সাধ্য কোথায়? সাহসে ভর করে তখন মাঠে নেমে গেলেন কতিপয় তরুণ। প্রমাণ সাইজের না হোক, তৈরি হোক ছোটখাটো ছবি। ৩৫ মিলিমিটারে না হোক, হোক ১৬ মিলিমিটারের ছবি। মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল ও তারেক মাসুদের হাত ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যোগ হলো নতুন ভোক্যাবুলারি—স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। শৃঙ্গ স্পর্শ করা হয়তো হলো না, কিন্তু স্বপ্নের জানালা খুলল। চলচ্চিত্রের আছর লাগা সেই কালে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি তারেককে, নজর রেখেছি তাঁর পরবর্তী কর্মকাণ্ডেও। চলচ্চিত্রের বারান্দায় তারেক এসেছিলেন অনেক দূর এক রাজ্য ছেড়ে। মাদ্রাসার জগৎ থেকে তিনি এসে পড়েছিলেন ক্রফো, গদার, ঋত্বিকের পৃথিবীতে। মাদ্রাসা থেকে মন্তাজের রাজ্যে চলে এসে এখানেই বসতবাড়ি বানিয়েছিলেন তিনি; এখানেই নিবিড়ভাবে করেছেন চাষাবাদ।
তারেককে লক্ষ করি দুটি ভূমিকায়, সংগঠক হিসেবে এবং সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার হিসেবে। বাংলাদেশে শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রটি সংগঠিত করার জন্য বিস্তর শ্রম, জীবনীশক্তি ব্যয় করেছেন তিনি। চলচ্চিত্র সংসদের অগ্রগামী কর্মী ছিলেন তারেক, ফিল্ম আর্কাইভের ব্যবস্থাপনায় সরকারের সঙ্গে দেনদরবার, ফিল্ম অ্যাপ্রিশিয়েশন কোর্স আয়োজনের খুঁটিনাটি নিয়ে সদা তৎপর দেখেছি তাঁকে। ১৯৮৮ সালে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তারেক মাসুদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ ডকুমেন্টারি নাইন মাসন্থস টু ফ্রিডম তাঁরই তৎপরতায় উদ্ধার হয়েছিল, যেমন পরবর্তীকালে তিনি বিস্মৃতি থেকে উদ্ধার করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আরেক দলিলমুক্তির গান। চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রকাশনা নিয়েও তাঁর উৎসাহ ছিল নিরন্তর। চিত্রলেখা নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। প্রচলিত চলচ্চিত্র ফরম্যাট পেরিয়ে এ দেশে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন তারেক। এ দেশে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রের বিকল্প প্রদর্শনীরও পথ তৈরি করেছেন তিনি। বাংলাদেশে শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র চর্চার ক্ষেত্র তৈরির ইতিহাসে সংগঠক তারেক মাসুদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে একটি বিশেষ অধ্যায়।
একজন সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার হিসেবে পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার সুযোগ তারেক পাননি। তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রা থেমে গেছে অকালে। চলচ্চিত্রকার হিসেবে তবু তাঁর সৃষ্টির পথ লক্ষ করলে দেখতে পাই শক্তির সম্ভাবনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এ দেশের লোকজীবন তাঁর চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য। মুক্তিযুদ্ধের অপ্রচলিত বয়ান তিনি উপস্থিত করেছেন চলচ্চিত্রে। মুক্তির গানে যুদ্ধমাঠের সাংস্কৃতিক যোদ্ধাদের প্রথমবারের মতো দেখলেন দর্শক। মুক্তির কথায় গ্রামীণ অন্তজ মানুষের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনা গেল, যা আগে রয়ে গিয়েছিল ঊহ্য। নরসুন্দর ছবিতে তারেক হাজির করলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন এক অবাঙালির বয়ান। তারেক তাঁর ছবিতে ইসলামের লোকজ চরিত্রটি ধরারও চেষ্টা করেছেন। বোঝার চেষ্টা করেছেন সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের উত্থানকেও তাঁর শেষ ছবি রানওয়েতে। তাঁর খানিকটা দলছুট ছবি অন্তর্যাত্রায় প্রবাসী এক পরিবারের গল্প দিয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছেন ‘দেশ’ ধারণাটির। এ ছাড়া তাঁর নাতিদীর্ঘ আরও বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারিতে তারেক তুলে এনেছেন নানা সমসাময়িক প্রসঙ্গ। আমেরিকার ডিভি লটারি-প্রত্যাশীদের নিয়ে, এফডিসির বাণিজ্যিক ছবির জগৎ নিয়ে, শ্রমজীবী শিশুদের জীবন নিয়ে এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার-পরিস্থিতি নিয়ে ডকুমেন্টারি করেছেন তিনি। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের জঙ্গম ইতিহাস, সর্পিল রাজনীতি আর জটিল সমাজের অগণিত প্রসঙ্গের সঙ্গে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছেন তারেক মাসুদ।
বলা বাহুল্য, বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতায় তারেকের কৃতিত্ব অঢেল হলেও তাঁর সব কাজ নির্মাণশৈলীতে, শিল্পগুণে উতরেছে কি না, সে প্রশ্নে নির্দ্বিধা হতে পারি না। বিশ্বের নানা প্রান্তের অগণিত চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে যদি বিচার করি, তবে তারেকের ছবি শৃঙ্গ ছুঁয়েছে—এমন দাবি করতে পারি না। তাঁর ছবিকে অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে বানিয়ে তোলা, হয়ে ওঠা নয়। এ প্রসঙ্গে অন্যত্র লিখেছি। এ নিয়ে বিতর্কও হয়েছে তারেকের সঙ্গে। অবশ্য তারেক নিজেই বলতেন, এযাবৎ তিনি কেবল প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাঁর যাবতীয় অভিজ্ঞতার নির্যাস তিনি প্রয়োগ করবেন তাঁর পরবর্তী ছবি কাগজের ফুল-এ। হয়তো সে ছবিতেই তিনি শৃঙ্গ স্পর্শ করতেন। সেই ছবির শুটিং স্পট থেকেই বৃষ্টিমুখর মানিকগঞ্জ রোডে ফিরছিলেন তিনি। গাড়ির ভেতর বসে সেই ছবির কথাই ভাবছিলেন। আর ঠিক তখনই জাদুকরের হাতের রঙিন রুমালের মতো পৃথিবীর মঞ্চ থেকে তারেককে উধাও করে দিল মৃত্যু। অনেক শ্রম ও ঘামে অনেক দিন ধরে তিলে তিলে তৈরি হয়েছিলেন তারেক মাসুদ। এ শূন্যতা ঘোচাবার নয় সহজে। তারেকের কথা ভেবে বেদনার ক্ষত নিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে থাকি। জালাউদ্দিন রুমি প্রিয় ছিল তারেকের। রুমির পঙিক্ত মনে পড়ে:
‘হোক ক্ষত, ক্ষতের রন্ধ্র পথেই প্রবেশ করে আলো।’
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.