বই পড়ার সময় কই? by তৌহিদা শিরোপা

বরাবরই বইয়ের পোকা ছিলাম। বড় ভাই নতুন কোনো বই কিনেছে, সেটি আমার আগে পড়া চাই। এ নিয়ে কত ঝগড়া করেছি ভাইয়ের সঙ্গে। এমনও হয়েছে, রাত জেগে বই পড়েছি বলে মায়ের বকা শুনেছি। একবার তো পরীক্ষার আগের রাতে পাঠ্যবইয়ের মধ্যে গল্পের বই লুকিয়ে পড়তে গিয়ে ধরা খেলাম।


বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনেও বইমেলায় যেতাম বন্ধুরা মিলে। সারা বছর অপেক্ষা করতাম নতুন বইয়ের জন্য,’ নাদিয়া হাসান বলেন, ‘জীবনে পরিবর্তন এভাবে আসবে, কখনো কল্পনাও করিনি। এখন হয়তো বইমেলায় বই কেনা হয়। কিন্তু সময় কোথায় পড়ার? সারা দিন অফিস করে বাসায় ফিরে সংসার সামলানো। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া তদারক করা। মাঝেমধ্যে অফিসের কাজ বাড়িতেও করতে হয়। ঘুমানোর আগে বই নিয়ে বসলে স্বামী বিরক্ত হয়। আলো জ্বললে তার ঘুম আসে না। মন খারাপ নিয়ে একসময় নিজেই ঘুমিয়ে পড়ি। আমিও ক্লান্ত থাকি। আর ছুটির দিনে তো রাজ্যের কাজ থাকে। বই নিয়ে বসলেও নানা কাজে বারবার উঠতে হয়। মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলে আর পড়তে ইচ্ছা করে না। আমেজটাই নষ্ট হয়ে যায়। মনে হয়, ইশ্, যদি আবার আগের মতো বই পড়ার সময় থাকত।’
গৃহিণী মনসেফা আলী (ছদ্মনাম) একটা সময়ে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। লেখালেখির শুরুটা তখন থেকেই। স্কুল-কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির ঝোঁক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন বাংলা বিভাগে। পত্রপত্রিকায়ও কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। ছাত্রজীবনেই বিয়ে হলো। স্বামীর কর্মস্থলের সুবাদে বেশ কয়েক বছর দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে। আর তিনি এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। ‘সংসার সামলে আর লেখালেখি’—দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন মনসেফা। তিনি বলেন, ‘আগে প্রচুর বই পড়তাম। লিখতে হলে তো ভালো বইও পড়তে হতো। কেউ কোনো উপহার দিতে চাইলে বই-ডায়েরি নিতাম। সেই আমি কত দিন লেখালেখি করি না। মাঝেমধ্যে পুরোনো ডায়েরিগুলো নিজের প্রকাশিত লেখা বের করে দেখি। নিজের জন্য সময় বের করতে পারি না বলেই হয়তো এমন হয়েছে। কিন্তু কীভাবে কী করব, তাও বুঝে উঠতে পারিনি এত বছরে। অবসরে পুরোনো অভ্যাস জেঁকে বসলেও নিজের সৃজনশীলতা খুঁজে পাই না। চাপা কষ্ট অনুভব হয় মনে, যা কাউকে বলতেও পারি না।’
‘যেকোনো গল্প, উপন্যাসের বই পেলেই গোগ্রাসে গিলতাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প, উপন্যাস, রোকেয়া রচনাবলি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই থেকে শুরু করে ঈদসংখ্যা পর্যন্ত,’ বলেন সরকারি কর্মকর্তা আশফিরা আমিন, ‘এখনো সময় পেলে বই পড়ার চেষ্টা করি। সন্তানদের নিয়ে বইমেলায় যাই। নিজে না পড়তে পারি। কিন্তু ওরা যেন পড়ে, সেদিকটা খেয়াল রাখি। আসলে পরিবার-অফিস সামলে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ছুটির দিনেও নানা ধরনের পরিকল্পনা থাকে। সামাজিক আচার অনুষ্ঠান তো আছেই। এসবের সঙ্গে চলতে চলতে কখন যে বই পড়ার অভ্যাসটাতে ছেদ পড়েছে, বুঝতে পারিনি। ইচ্ছা করে প্রিয় লেখকের বই, প্রিয় বইগুলো আবার যদি পড়তে পারতাম। নিজেও অনেক বই কিনি। স্তূপ হয়ে যায়। কিন্তু পড়ার সময় বের করতে পারি না।’

No comments

Powered by Blogger.