পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষকদের অভয়াশ্রম! by ড. বেগম জাহান আরা

শুধু কাগুজি ডিগ্রি অর্জন করলেই তাকে শিক্ষিত বলা যায় না। বহু শিক্ষিত, না আসলে ডিগ্রিধারী মানুষের আচার-ব্যবহার দেখলে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। মানুষ মূলত রিপুবশ প্রাণী। শিক্ষার আলোই শুধু পারে রিপুগুলোকে পিটিয়ে-পুড়িয়ে বশে আনতে। তখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো। মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে দায়দায়িত্ব, সততা, ন্যায়পরতা, মানবতা, জবাবদিহিতা, কর্তব্যপরায়ণতা, সুস্থ চিন্তা, দেশপ্রেম ইত্যাদি।


এসব কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। এখন কেউ বলেও না। শোনেও না। ছোটবেলায় শুনেছি গুরু পরম ভক্তির মানুষ। সাত্তি্বক গুরু পিতার মর্যাদায় সমাসীন। এখনো শিক্ষককুলের প্রতি অগাধ ভক্তি-শ্রদ্ধা আমাদের প্রজন্মের। এমনকি কেউ শিক্ষার সর্বোচ্চ আলয়ে এমএ বা অনার্স পড়ছে শুনলেও ভালো লাগে। মনে হয়, একজন সাচ্চা মানুষ তৈরি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি এখনো দুরন্ত সম্মান পোষণ করি। সম্মানবোধে নত থাকি শিক্ষকদের প্রতি। তাই শিক্ষকদের আচরণে সুস্থ বুদ্ধির ঘাটতি দেখলে খুবই কষ্ট পাই। আত্ম-অপমানে মিশে যাই মাটিতে। কারণ আমিও একজন শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে জীবন কাটিয়েছি। এখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কাজই করছি। বিশ্বাস করি, এই পেশা মহৎ এবং পবিত্র।
দেশে উচ্চশিক্ষার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কিছু শিক্ষক ধার নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ চালাতে হয়েছে। মানে তাঁরা খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নতুন বিদ্যাপীঠে শিক্ষাদান করতেন। সে ক্ষেত্রে একটা যুক্তি কাজ করে। কিন্তু ২০১১ সালে এসে যখন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে দেখি, '৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৯ হাজার ২৪১ জন শিক্ষকের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক কোনো না কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন (২৫.০৬.১১, যুগান্তর) মূল শিক্ষা কার্যক্রম থেকে', তখন মাথাটা গুলিয়ে যায়। শুধু সংশ্লিষ্টরা বলবেন কেন, আমরাও বুঝতে পারি যে এত শিক্ষক কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত না থাকায় দেশের সার্বিক উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্জিত হচ্ছে না ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার গুণগত মান। এ প্রতিবেদন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই এসব কথা ইউজিসি জানবে। এমনটাই হওয়ার কথা। ইউজিসি আছেই তো এসব বিষয়ে তদারকি-খবরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য!
তবে ইউজিসি কিছু খবর যে রাখে তা বোঝা যায় প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনে। একই প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০০৯ সালের ইউজিসির দেওয়া বার্ষিক তথ্যে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি একটি নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করে বলেছে 'সাম্প্রতিককালে কমিশন উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিতভাবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিশেষত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে) খণ্ডকালীন শিক্ষকতা বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কনসালট্যান্সি' করছে। ২০১০ সালের প্রতিবেদনেও একই উদ্বেগ। এই প্রতিবেদন নাকি সংসদে পেশও করা হয়েছে। তার ফলাফল কিন্তু আমরা জানি না। প্রতিবেদন সূত্র আরো জানায়, অভিযোগ রয়েছে যে শিক্ষকদের এই 'ছুটি বাণিজ্য' এবং অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে থাকে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইউজিসির দেওয়া তথ্যে আরো জানা যায় (সূত্র : ওই একই), বিদেশে শিক্ষা ছুটিতে আছেন এক হাজার ৬০৭ জন শিক্ষক। আর এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ডখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪৫ জন শিক্ষক শিক্ষাছুটিতে বিদেশে অবস্থান করছেন। অনুমোদনহীন ছুটি নিয়ে আছেন আরো ছয়জন শিক্ষক। সরকারি প্রেষণে নিয়োজিত আছেন আরো ৫৩ জন। বর্তমানে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কয়েকটির চিত্র হলো :
ক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন আছেন_২৪৫ জন শিক্ষাছুটি+৬ জন ছুটি ছাড়াই ছুটিতে+৫৩ জন সরকারি প্রেষণে = ৩০৫ জন,
খ. বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫২৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৩২ জন শিক্ষাছুটিতে + ৫ জন ছুটি ছাড়াই ছুটিতে = ১৩৭ জন,
গ. খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮৭ জন শিক্ষাছুটিতে + ৯ জন প্রেষণে = ৯৬ জন,
ঘ. শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮৬ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৫১ জন শিক্ষাছুটিতে + ৯ জন প্রেষণে = ১৬০ জন,
ঙ. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০৬৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৯৫ জন শিক্ষাছুটিতে + ২৫ জন প্রেষণে = ২২০ জন,
চ. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৬৯ শিক্ষকের মধ্যে ১৪১ জন বিনা ছুটিতেই ছুটিতে, ২৬ জন প্রেষণে = ১৬৮ জন,
ছ. বুয়েটে ৫৭৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৬৭ জন শিক্ষাছুটিতে + ১৫ জন প্রেষণে = ১৮২ জন ইত্যাদি। কত আর নাম উল্লেখ করা যায়? কম বেশি চিত্র এ রকমই ভয়াবহ।
এমন পরিসংখ্যানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষাদানের আশা করা যায় কি? কেমন করে কোন যুক্তি বা নীতির ভিত্তিতে এত শিক্ষক শিক্ষাছুটিতে থাকেন। এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে ইউজিসি পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের এবং শিক্ষা বাজেটের স্বল্পতার কথা জানায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহারে শিক্ষাছুটি নেওয়ার ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এক আদেশে বিভাগওয়ারি ৩০ শতাংশ শিক্ষকের বেশি শিক্ষক ছুটিতে যেতে পারবেন না বলা হলেও শিক্ষক সমিতিগুলোর চাপে মন্ত্রণালয় নমিত হয়। প্রজ্ঞাপন তুলে না নিলেও চোখ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে শিক্ষকদের ছুটি বাণিজ্যের দিক থেকে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও বেশ হ-য-ব-র-ল অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লে শিক্ষকের প্রয়োজন হবে, এটা তো স্বতঃসিদ্ধ কথা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও যথেষ্ট ছেলেমেয়ে পাস করে বের হচ্ছে। তারা যাচ্ছে কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষকের একটা অনুপাত তো থাকতেই হবে। বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব ইউজিসির। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই দায় বইতে হবে। শুধু কথা নয়, শক্ত হাতে সমাধান করতে হবে এই আত্মঘাতী সমস্যার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষকদের অভয়াশ্রম করা যাবে না কোনোমতেই।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.