দূরের দুরবীনে-বিশ্বজোড়া নিদ্রাহীন তারুণ্য : কে ধরিবে হাল? by অজয় দাশগুপ্ত

বিশ্বজুড়ে আগামী দিনের নেতৃত্ব নিয়ে শঙ্কিত সুধীজনদের ধারণা, প্রযুক্তিই এর পেছনের বড় কারণ। যে জন্য রাজনীতির প্রতি বিশ্বতারুণ্যের তেমন কোনো আগ্রহ এখন আর চোখে পড়ে না। শুধু আমাদের দেশে নয়, দুনিয়াজুড়ে এটাই এখন বাস্তবতা।


এর কারণ বহুবিধ_প্রথমত. আমাদের বয়সী বা আরো দুয়েক প্রজন্ম অনুজদের সঙ্গে আজকের প্রজন্মের বড় ব্যবধান মিডিয়া বা প্রযুক্তি। দেশে দেশে রেস্তোরাঁ, রক, ছাদ বা গলির দেয়াল আগলে আড্ডা দেওয়ার রেওয়াজ পুরনো ও প্রাচীন। সে আড্ডা থেকে জন্ম নিয়েছেন এমন প্রতিভাও অজস্র। বাঙালি তো এ কারণে ভুবনবিখ্যাতও বটে। সে সময়কালে আড্ডা মানে ছিল সাক্ষাৎ ও পারস্পরিক দেখাশোনা। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান যে এক বিষয় নয়, আজকের সঙ্গবঞ্চিত অদর্শনজনিত আড্ডাই তার বড় প্রমাণ। যত দিন বিজ্ঞান দাপট বিস্তার করেছে, আবিষ্কার জননীর ভূমিকায় ছিল মানুষের দেখা-সাক্ষাৎ বা পার্সোনাল টাচ ছিল অক্ষত। প্রযুক্তি যখন থেকে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করল, মানুষ হয়ে উঠতে লাগল যন্ত্রের দাস। শিক্ষা, বাণিজ্য, ব্যাংকিং, এমনকি লন্ড্রির মতো কাজেও আজকাল মানুষের প্রয়োজন হয় না। এসব দেশে বড় বড় সেলাই মেশিন বসানো আছে। সেলফ হেলফ এসে একদিকে কাপড় ঢুকিয়ে অন্যদিকে কয়েন বা পয়সা ঢোকালেই প্রক্ষালনের শুরু। ওই ১০-১৫ মিনিট সময় কাটানোর জন্য পাশেই বসানো আছে আরেক যন্ত্রদানব, ছোট্ট কম্পিউটার, তাতে কয়েন ঢুকিয়ে ইন্টারনেট, ফেসবুক, চ্যাট_যা খুশি করা সম্ভব। তেষ্টা বা চা-কফির তৃষ্ণা নিবারণ? তাও যন্ত্রচালিত, এক কোণে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা কফি মেশিনে পয়সা ঢোকালে এক এক করে বেরিয়ে আসবে গরম পানি, চা অথবা কফির ফোয়ারা। জনশূন্য, কোথাও মানব-মানবী নেই। বড় বড় সুপারস্টোরে মূল্য চুকানোর জন্য সারি সারি লাইনে অপেক্ষমাণ ক্রেতাদের সামলাতে ব্যস্ত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা কমছে। আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে এ খাতের সম্ভাবনা। হঠাৎ করে সেলফ সার্ভিসের নামে চালু হওয়া অটো কাউন্টারগুলো আপনি নিজেই অপারেট বা পরিচালনা করতে পারেন। দ্রব্যসামগ্রী জায়গামতো বসালে বা স্ক্যান করলে কম্পিউটার নিজেই দাম বাতলে দেয়, টাকা-পয়সা দেওয়ার খোঁপ, এমনকি কার্ড ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ নেওয়ারও ব্যবস্থা আছে এ প্রক্রিয়ায়। ফলে এখন আর মানবসঙ্গ অপরিহার্য নয়। এমনটি চলতে থাকলে একদিন হয়তো জনমানবশূন্য সুপারস্টোরকে ভৌতিক মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক ঠেকবে না। আর ওই ভৌতিক দোকানপাট থেকে যন্ত্রের দাসানুদাস হয়ে বেরিয়ে আসা আমাদের মনে হবে এলিয়েন বা ভিনগ্রহের এক আজব প্রাণী।
এমন বাস্তবতায় আদর্শ, ভালোবাসা, জনসেবা, দেশপ্রেম_এগুলো কি সত্যি খুব কার্যকর শোনায়? প্রবাসের কথা শেষ করে দেশের কথায় আসব। এই যে ইউরোপ, একদা দেশ জয় আর সাম্রাজ্য বিস্তারে বিবদমান ছোট ছোট দেশ কী কাণ্ডই না ঘটিয়ে তুলত! ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেনের দাপটে নাভিশ্বাস উঠেছে পৃথিবীর। সর্বত্রগামী বিজয় পতাকা ওড়ানোর সে কী তুমুল প্রতিযোগিতা! জার্মানির কথা তো বলাই বাহুল্য, দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের মূল হোতা ওই দেশ তো চেয়েছিল দুনিয়াই চলে আসবে পদতলে। সে ইতিহাস থেকে কিঞ্চিৎ পৃথক, আদর্শ বা নিষ্ঠায় ব্যতিক্রম হলেও পূর্ব ইউরোপের চিত্রটি প্রায় ভিন্ন। রাশিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া সে আরেক বিপ্লব। অন্য এক বিজয়নিশানের উন্মুল উচ্ছ্বাস। আজ দেখুন, সব এসে শেষে মিশে গেছে শেষের মতো একবিন্দুতে একাকার। দেশগুলোর ভৌগোলিক রেখা, সীমানা, পতাকা আর সংগীত ভিন্ন বটে, সবচেয়ে দরকারি ও প্রয়োজনীয় যে অর্থ বা মুদ্রা তা কিন্তু অভিন্ন। অভিন্ন পাসপোর্ট, বহু ক্ষেত্রে একযোগে আন্তর্জাতিক অঙ্গন, খেলাধুলা, যুদ্ধবিগ্রহ, সম্মেলনের একীভূত রূপ মনে করিয়ে দেয় সর্ব ইউরোপ হয়তো একটি একক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আদর্শিকগত ক্ষয়িঞ্চু এ যুগে অর্থনীতিই মূল নিয়ন্ত্রক। নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি ও অস্ত্রভাণ্ডার।
এসব দেশের তারুণ্যকে তাই ভোলানোটাও জরুরি। যুবশক্তির নিয়মই হচ্ছে বিদ্রোহ, পরিবারের কথাই ভাবুন। টিনএজের শুরুতে পাল্টে যাওয়া তরুণ-তরুণীরা পরিবারের কঠিন শৃঙ্খল ভাঙতে উন্মুখ ও অধীর হয়ে ওঠে। যৌবনে তারা প্রেম-ভালোবাসা, বন্ধন চায়, শাসনের বাইরে এক জগৎ গড়ে তুলে স্বাবলম্বী বা নিজের পায়ে দাঁড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই সময়কালকে যদি নিয়ন্ত্রিত বা অন্য কোনো নেশায় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, রাষ্ট্র ও সমাজপতিদের দুর্ভাবনা হ্রাস পায়। পৃথিবীর সব দেশের হাল-সুরতই প্রায় এক ধরনের। শাসক বা নিয়ন্ত্রকরা কখনোই বিদ্রোহ চায় না। চায় না নতুন চ্যালেঞ্জ বা রাস্তা-কাঁপানো যৌবনের প্রতিবাদ। ইউরোপ তো নিজেই সে দাহের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ফলে ওই জায়গাটুকু বা আদর্শিক ভাবনার বয়সকাল ভরিয়ে তুলতে হাজির হয়েছে ইলেকট্রনিক দানব। সে দানবের পৃষ্ঠপোষকতা ও আগলে রাখার কাজটি করে সভ্য দেশের পুঁজি ও বেনিয়াবৃত্তি।
বাংলাদেশেও আজ তার জয়জয়কার। আমরা পেছনের সারির দেশ। উন্নত ও অগ্রসর বিশ্বের গাড়ি, কাপড়, প্রসাধনী, জুতা, এমনকি ব্যবহৃত অস্ত্র নিয়েই কারবার আমাদের। আদর্শ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা-পরিষেবা অর্থনীতির মতো জরুরি বিষয়েও আমরা এদের অনুসারী। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, মুক্তবাজার, খোলা অর্থনীতি, অবরুদ্ধ একনায়কতন্ত্র এর কোনোটাই আমাদের নয়। আমরা দেখেছি, শিখেছি অথবা ধার নিয়ে কাজে লাগিয়ে চলেছি।
যেটুকু আমাদের নিজস্বতা, ওই যে আড্ডা, সংস্কৃতি, পরিবার প্রথা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম_সেগুলোও আজ হুমকির মুখে। তরুণ-তরুণীদের ঘুম কেড়ে নেওয়া নীল বাঙ্ আজ নৈশ আড্ডাঘর। নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন, প্রত্যাশাহীন এক অদ্ভুত জীবনধারায় ভেসে চলেছে এরা। এক রাতে মানুষের বডি ক্লক বা দেহঘড়ির ওপর একটি প্রামাণ্য ছবি দেখছিলাম। বিজ্ঞান বলছে মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে বাঁধা। সংখ্যাধিক্য মানুষের দেহ দিনে যত সচল, সন্ধ্যার পর থেকে সে শরীরই হয়ে পড়ে অবসাদগ্রস্ত ও ম্রিয়মাণ, রাত যত বাড়ে তত তার কাহিল অবস্থা। পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট করেই বলা আছে, দিন হচ্ছে কর্ম আর জীবনের জন্য, রাতের সৃষ্টি হয়েছে বিশ্রাম ও নিদ্রার জন্য। বেদ, উপনিষদ, বাইবেলও তা-ই বলে। বিজ্ঞান প্রমাণ করছে নিদ্রাহীন শিশু বা তরুণ-তরুণীকে দেওয়া হোম টাস্ক আর সুখনিদ্রা থেকে জাগ্রত শিশু বা তরুণ-তরুণীর কাজের মানে অনেক প্রভেদ, বিশাল পার্থক্য।
সুস্থতা ও সহজ জীবনের প্রতিকূল হয়ে ওঠা যন্ত্রদানবের সবচেয়ে বড় আগ্রাসন তার অবাধ আহ্বান। সে ডাকে দেশপ্রেম, রাজনীতি বা দেশসেবার মতো জরুরি বিষয়ও আজ লোপাটের পথে। সারা দুনিয়ার একই চেহারা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। উন্নত দেশে সমাজগর্ভে জন্ম নেওয়া মেধাবীরাই দেশ ও সমাজ শাসনের দায়িত্ব লাভ করে। এসব দেশে প্রধান বিচার্য মেধা ও শ্রম। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ ও পিছিয়ে থাকা সমাজে চাই সবল উত্থান, সে কাজটা হয়েছিল বলেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা। এখন যদি তা না হয়, আর যা-ই হোক এগোতে পারব না আমরা। বিকৃত, কুৎসিত, উদগ্র, দলবাজির রাজনীতি এ তারুণ্যের ঘুম ভাঙাতে পারবে না। বরং তাকে বিষিয়ে তুলতে যথেষ্ট। দি অনলি অ্যান্ড ওয়ান হোপ বা একমাত্র ভরসা পরিবার। সেখান থেকে যদি দেশপ্রেমটা জাগানো যায়, সংস্কৃতি দিয়ে ঘেরাটোপ বা ব্যারিকেড তৈরি হয়, তবেই বাংলাদেশ নতুন সম্ভাবনার নব তারুণ্যের জোয়ারে ভাসতে পারে। অন্যথায় এখনকার ব্যর্থতার গ্লানি আর দোষারোপের রাজনীতিকে শাসন করা বয়স্করাই ছড়ি ঘুরিয়ে যাবেন। ফেসবুক, কম্পিউটার, মোবাইল ও যন্ত্রনির্ভর নির্ঘুম প্রজন্মের ঘুম ভাঙাতে কি এগিয়ে আসবে আমাদের সমাজ?
লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmai.com

No comments

Powered by Blogger.