বিশেষ সাক্ষাৎকার : তালুকদার মনিরুজ্জামান-আমি মনে করি না শেখ হাসিনা ভারতের হাতের পুতুল

তালুকদার মনিরুজ্জামান। জন্ম ১ জুলাই, ১৯৩৮ সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কানাডা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৭ সালে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।


তাঁর বিখ্যাত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মিলিটারি উইথড্রল ফ্রম পলিটিঙ্, সিকিউরিটি অব স্মল স্টেটস, দ্য বাংলাদেশ রেভল্যুশনস অ্যান্ড ইটস আফটারম্যাথ, রেডিক্যাল পলিটিঙ্ অ্যান্ড দ্য ইমার্জেন্সি অব বাংলাদেশ, পলিটিঙ্ অ্যান্ড দ্য সিকিউরিটি অব বাংলাদেশ, জাপানস সিকিউরিটি পলিসি ফর দ্য টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি ইত্যাদি। এই বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন কালের কণ্ঠের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন।
কালের কণ্ঠ : দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : বিখ্যাত মনীষী চার্চিলের একটা কথা আছে, 'ম্যাগনানিমিটি ইন ভিক্টরি অ্যান্ড ডিফায়্যান্স ইন ডিফিট'। (জয়ের ক্ষেত্রে থাকতে হবে উদার আর পরাজয়ের ক্ষেত্রে থাকতে হবে ভ্রূক্ষেপহীন)। বিজয় হলে মানসিকতা হতে হবে উদারতাপূর্ণ। আর যদি পরাজয় হয় তাহলে ভেঙে পড়লে হবে না। আমাদের এখানে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা দূর করতে হলে আওয়ামী লীগকে উদার হতে হবে। এতে করে আওয়ামী লীগ ছোট হবে না। আমার মনে হয় শেখ হাসিনাকে বোঝানো উচিত। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করুক। যেমন_বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা জনগণ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে নমনীয় হতে হবে। মূল দায়িত্ব সরকারের। দেশের জানমাল নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। বিরোধী দলের যেসব দাবি আছে, সেসব মেনে নিতে পারে। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টা। খালেদা জিয়া তো বলেছেন, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি আছেন। আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা যে কাজটি করলেন তাতে তিনি বড় একটা কাজ করেছেন বলে মনে করলেও আসলে কিন্তু তেমন নয়। তাঁকে উদার হতে হবে। তাঁকে আলোচনায় বসতে হবে।
কালের কণ্ঠ : কোথায়, কিভাবে আলোচনা হবে?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : যেকোনো জায়গায় হতে পারে। মধ্যস্থতা করতে পারেন এমন মানুষও আছেন। ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মতো অনেকেই আছেন। একবার মনে আছে কী স্যার নিনিয়ানও এসেছিলেন বাংলাদেশে। আসলে ইচ্ছা থাকা প্রয়োজন।
কালের কণ্ঠ : আপনি কি মনে করেন দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিশেষ কোনো মহল (দেশীয় ও আন্তর্জাতিক) সক্রিয় রয়েছে?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এবং রাজনৈতিক নেতাদেরও একটি অংশ মনে করে ভারত আওয়ামী লীগকে দিয়ে খেলায়। তাদের বক্তব্যকে আমরা অস্বীকার করতে পারি। কিন্তু তাদের একথা বলতে পারি না, তোমরা বোকার মতো কাজ করছ। ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক অনেক ভালো। নেপথ্যে কী আছে জানি না। বাংলাদেশের জামায়াত সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যা বললেন, সেটা না বললেই পারতেন। তবে অস্থিতিশীল অবস্থা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে, প্রাথমিক কারণগুলো কিন্তু দেশের ভেতরেরই ব্যাপার।
কালের কণ্ঠ : সরকারি দল সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার পরও কিছু ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলের হরতাল পালন করাকে কিভাবে দেখছেন?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : ব্যাপার হলো কী শেখ হাসিনা একজন রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি জানেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর বিসমিল্লাহ সংবিধান থেকে উঠিয়ে দিলে তিনি নির্বাচনে হেরে যাবেন। তিনি তাঁর দলীয় নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, বিসমিল্লাহ থাকুক। রাষ্ট্রধর্মটাও থাকুক। মিছেমিছি বিরোধী দলকে খেপিয়ে লাভ নেই।
কালের কণ্ঠ : তার পরও কিছু ধর্মাশ্রিত রাজনৈতিক দল সম্প্রতি হরতাল ডেকেছে।
তালুকদার মনিরুজ্জামান : মেনে নিলেই হয়। ওটাও থাক। রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে, বিসমিল্লাহ রয়েছে, ওটাও থাক না। মেনে নিলেই হলো। সুতরাং ধর্ম সম্পর্কে যেটুকু বাদ আছে সেটুকু থেকে যাক। সংবিধানে ঢুকিয়ে দিলেই হলো। বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম এমন বিষয়গুলো প্রতীকী ব্যাপার। এগুলো থাকলে অসুবিধা কি। তারা তো মদিনা রাষ্ট্র বানাতে চায় না। তা হলো জনগণের ধর্মের প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল তার একটা প্রতীক মাত্র।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সরকারবিরোধী দলকে প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিএনপি সংসদে যায়নি। তারা আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : শেখ হাসিনাকে নিশ্চিত করতে হবে সংসদে সংসদীয় আচরণ হবে। সেখানে সংসদীয় ভাষা ব্যবহার করতে হবে। সরকারি দলের দায়িত্ব হচ্ছে সেখানে যাতে অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার না হয়।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগের আড়াই বছরের সরকারকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন। সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : অর্থনৈতিক দিকটি মোটামুটি ভালো। শিক্ষা ক্ষেত্রে যদিও মৌলভীরা কিছু বিরোধিতা করছে। সেই শিক্ষানীতিটা অবিতর্কিত না থাকলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছুটা ভালো করেছে সরকার। এটা আরো ভালো হতো যদি শেখ হাসিনা ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মাঝে মাঝে ভালো। যদিও সাহারা খাতুন শতভাগ সফল বলে দাবি করেন, তা ঠিক নয়। দলীয়করণের ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তেমন ভালো হতে পারেনি। আরো সুন্দর হতে পারত যদি আওয়ামী লীগ নিজেদের ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত।
কালের কণ্ঠ : বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে সাফল্য-ব্যর্থতা?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : আমাদের ছোট দেশ। আমাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে ভারত আমাদের খাতির করতে চায়। মিয়ানমারও খাতির করতে চায়। চীনও চায়। খুব সাবধানে চলাই ভালো। ভারতের দিকে যেভাবে ঝুঁকে গেছেন, সেভাবে না ঝুঁকেও শেখ হাসিনা পারতেন। ট্রানজিট নিয়ে যেসব চুক্তি হতে যাচ্ছে, বাংলাদেশের স্বার্থ যাতে রক্ষা হয় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি আমি মনে করি না শেখ হাসিনা ভারতের দালাল বা ভারতের হাতের কোনো পুতুল।
কালের কণ্ঠ : দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে কী মনে করেন?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দ্রব্যমূল্য কমানো এত সোজা নয়। কেন যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নেই তা বাইরে থেকে বলা মুশকিল। প্রথমে বলা হলো সিন্ডিকেট থেকে এটা করা হচ্ছে। পরে দেখা গেল সিন্ডিকেট নেই। বলা হচ্ছে, বিদেশে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। আমার মনে হয় সারা পৃথিবীতেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে চলেছে। ভারতেও দেখেন না, সেখানে আন্দোলনও হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে।
কালের কণ্ঠ : অনেকে বলছেন সরকার অনেক ফ্রন্ট খুলে ফেলেছে। এখন এগুলো সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত চাই।
তালুকদার মনিরুজ্জামান : শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে পুনর্নির্বাচিত হতে হলে তাদের কাজ করতে হবে। সে জন্যই হয়তো নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের সামনে আরো আড়াই বছর আছে। হয়তো কিছু কাজ হতেও পারে।
কালের কণ্ঠ : গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : সংসদীয় পদ্ধতির সরকার মানে সরকারি দল ও বিরোধী দল মিলে সরকার গঠন হবে। তার পরও সরকারি দলের ভূমিকা বড়। যেমন বলি নেহরুর কথা। নেহরুর কোনো বিরোধী দল ছিল না। তিনি একজনকে বিরোধীদলীয় ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সরকারের সমালোচনা করার জন্য। আমাদের এখানেও সরকারকে কিছু ছাড় দিয়ে হলেও বিরোধী দলকে সংসদে নিয়ে আসা উচিত।
কালের কণ্ঠ : আমাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দল সে দায়িত্ব পালন করছে কী?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিরোধী দল যাতে এগিয়ে আসে সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে সরকার কি সঠিক পথে রয়েছে?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : ব্যাপার হয়েছে কী, অনেক দিন হয়ে গেছে। অনেকের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে, তাঁরা বলছেন আসলেই এটা একটা রাজনৈতিক বিচার হচ্ছে। যাঁরা একাত্তর দেখেছেন তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। এটা জনগণের ধারণা। আলাপ করে আমি যেটুকু মনে করেছি।
কালের কণ্ঠ : আপনার বিবেচনায় সরকারের ভুলগুলো কী? সেগুলো শোধরানোর উপায় কী?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : অপ্রয়োজনে বিরোধী দলকে হয়রানি করা। মিটিংয়ে বাধা দেওয়া। সরকার এটা না করলেও পারে।
কালের কণ্ঠ : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার কতটা আন্তরিক বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের বর্তমান কর্মকাণ্ডে আপনি কী সন্তুষ্ট?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : সরকারের ধরপাকড় চলছে। বিনা বিচারেই চলছে। প্রশাসন বাড়াবাড়ি করছে। বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি চলছে।
কালের কণ্ঠ : অব্যাহত সংসদ বর্জন এবং হরতালের মতো নেতিবাচক রাজনীতিকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : এটা চলে না। খালেদা জিয়াও বলেছেন হরতাল করবেন না। সংসদ বর্জনের ব্যাপারটা জনগণ চায় না। হাসিনাকে বলতে হবে সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে বিতর্ক করার সুযোগ দেওয়া হবে। পার্লামেন্টারিয়ান যাঁরা আছেন তাঁরা তো বলার জন্য উদগ্রীব। শুধু শেখ হাসিনাকে বলতে হবে, বিতর্কের সুযোগ দেওয়া হবে।
কালের কণ্ঠ : সংবিধান সংশোধন হয়ে গেছে সংসদে। সেখানে আবারও বিতর্কের সুযোগ আছে কী?
তালুকদার মনিরুজ্জামান : আমি পুনরায় সংশোধনের কথা বলছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
তালুকদার মনিরুজ্জামান : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.