বান্টুস্তান! by এম আবদুল হাফিজ

বিশৃঙ্খল বাংলাদেশ পরিণত হতে যাচ্ছে বান্টুস্তানে_ সম্প্রতি আমাদের সেনাবাহিনীতে সংঘটিত একজন নেপথ্য কুশীলব প্রবাসী ইশরাক আহমদের বরাত দিয়ে খবরটি ছেপেছে বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী 'দ্য ইকোনমিস্টে'র ২৮ জানুয়ারি সংখ্যা। সাময়িকীটির নিরপেক্ষতা ও প্রকাশিত খবরের প্রামাণিকতা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।


তবে আমি বিশ্বাস করি না যে, বাস্তব চিত্র যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের মতো ষোল কোটি স্বাধীনচেতা মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত এই দেশ কখনও তেমন একটি রাষ্ট্রে (বান্টুস্তানে) পরিণত হবে।
Chambers 21st Century Dictionary বান্টুস্তানের ব্যাখ্যা দিয়েছে এভাবে Any of the partially self-governing regions of south Africa populated and administered by blacks before the end of apartheid in 1994. যা আমাদের প্রসঙ্গে করদ মিত্র রাজ্যের সঙ্গে তুলনীয় ভাবা যায়_ কোনো মহলই সেভাবে এ দেশকে রূপান্তরিত করার শক্তি রাখে না। তা হলে আদৌ কেন এমন একটি গুঞ্জনের উদ্ভব? বাস্তবে এ দেশ বান্টুস্তানে পরিণত না হলেও এ গুঞ্জনই আমাদের জন্য অপমান ও গ্গ্নানিকর। তবে এ গুঞ্জনের কারণ কিছু ঘটেনি_ তাও বলা যাবে না। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক স্থাপনে সর্বোচ্চ পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফরও ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, স্বাক্ষরিত হয়েছে কিছু চুক্তি, উচ্চারিত দু'পক্ষ থেকেই বন্ধুত্বের বাণী। এরপরও আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি, তা একটি অব্যাহত বঞ্চনার চিত্র। ৩০ বছরের গঙ্গার পানি চুক্তি যা আওয়ামী লীগের বিগত মেয়াদে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা নিয়ে দলটির কৃতিত্বের দাবি থাকলেও বাস্তবে তার ফল সন্তোষজনক। চুক্তির ফাঁকফোকর গলিয়ে গঙ্গার পানির যে প্রবাহ গঙ্গার ভাটিতে পেঁৗছে তা দিয়ে তৃষ্ণার্ত পদ্মার নদীবক্ষও ভেজে না। অনায়াসে এককালের প্রমত্তা পদ্মা দিয়ে এখন গরুর গাড়ি চলে। পরিদৃষ্ট হয় ধু-ধু বালুর চর।
ভারতের সঙ্গে আমাদের চুয়ান্নটি অভিন্ন নদী আছে। ভাটির দেশ হওয়ায় এর অধিকাংশ নদীতে আমাদের পানির হিস্যা থাকলেও উজানে বাঁধ দিয়ে বা নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে উজানের দেশ ভারত এসব নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। গঙ্গার পানির অপর্যাপ্ত প্রবাহের কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ যা প্রকারান্তরে এখন বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার; তাতে মরুকরণের প্রক্রিয়া ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর থেকেই সূচিত হয়েছে। এখন বহু প্রত্যাশিত তিস্তার পানি চুক্তি এড়িয়ে ভারত সমগ্র উত্তরবঙ্গকে মরুভূমিতে পরিণত করার পরোক্ষ পদক্ষেপ নিয়েছে।
আমি জানি না বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা কি বান্টুস্তানের কৃষ্ণাঙ্গদের এভাবে জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি হরণ করে ভোগান্তিতে ফেলত? আমাদের জীবন ও জীবিকাকে বিপন্নকারী 'বন্ধু' ভারতকে নানা ছলছুতোর আশ্রয় নিয়ে ট্রানজিট দিয়ে বিদ্রোহী 'সেভেন সিস্টারে' বিদ্রোহ দমনে অংশ নিয়েছি আমরা। তবু ভারতকে খুশি করতে পারিনি।
এ ছাড়া ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাংলাদেশিদের জন্য 'ট্রিগার হ্যাপি' আচরণে মনেই হয় না যে, তারা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের প্রাপ্য বাংলাদেশকে দিতে প্রস্তুত। আমি নিশ্চিত যে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদীরাও এমন আচরণ বান্টুস্তানবাসীদের সঙ্গে করেনি বা সিকিমের অধিবাসীরাও ভারতীয়দের কাছে এমনভাবে নির্যাতিত হয়নি।
আমাদের কি প্রতিবাদ জানানোরও ক্ষমতা নেই_ প্রতিকার তো দূরের কথা। ভারতের সঙ্গে আমাদের কতটা এবং কখন কী সম্পর্ক হবে তা নির্ণয়ে ষোল কোটি মানুষের কি কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই?
দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে অসলো শান্তি প্রক্রিয়ার আওতায় ফিলিস্তিনিদেরও পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের যে ছক ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা দোসররা তুলে ধরেছে_ ফিলিস্তিনিরাও তা বান্টুস্তানের একটি সংস্করণ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এখনও সত্যিকার অর্থে এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য লড়ে যাচ্ছে, আর আমরা? দ্বিপক্ষীয় অসংখ্য আলোচনায় আমরা এ পর্যন্ত শুধু দিয়েই গিয়েছি, ন্যায্য পাওনাটাও আদায় করতে পারিনি। অবশেষে বান্টুস্তানের অভিধা যদি আমাদের পেতেই হয়, কাউকে তো আমরা তার জন্য দোষ দিতে পারব না।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.