খোলা চোখে-বাঙালির শিরশ্ছেদ ও সরকারি সাফাই by হাসান ফেরদৌস

বাকপটু ও ধীমান বলে পরিচিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, সৌদি আরবে আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদে অন্যায় কিছু হয়নি। সবই সে দেশের আইন মোতাবেক হয়েছে। তদন্ত হয়েছে, তদন্ত শেষে বিচারপতি রায় দিয়েছেন। এখন সে রায়ে যদি বাঙালির গর্দান যায়, আমাদের—অর্থাৎ সরকার বাহাদুরের—কী করার থাকতে পারে!


একদিকে তিনি যথার্থ আমলার মতো কথাই বলেছেন। কোথায় কোন বাংলাদেশির—তা দেশে হোক বা বিদেশে—ভাগ্যে কী ঘটছে, তা নিয়ে ভাবার মতো সময় কোথায় সরকার বাহাদুরের? বিদেশের জেলে কতশত বাঙালি আটক রয়েছে তা জানি না। ভারতে, পাকিস্তানে, আমেরিকায় সব মিলিয়ে মোট সংখ্যা হয়তো কয়েক হাজার হবে। এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো আইন ভঙ্গের কারণে জেলে আছে। কেউ হয়তো ভিসা ছাড়া বিদেশে গেছে, কেউ অপরাধী চক্রের পাল্লায় পড়ে ধরা খেয়েছে। অসংখ্য মেয়ে-নারী পাচারকারীদের প্রতারণা ও অপরাধের শিকার। তো, তাদের ব্যাপারেও সরকারের কিছু করার নেই। আইন তার নিজের গতিতে চলবে এবং অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর তারা বছরের পর বছর জেলে পচে মরবে।
মরুক গে, আমাদের কী! ও রকম দু-দশটা জেলে পচলে কার কী আসে যায়! এর চেয়ে অনেক জরুরি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
সরকারের হয়তো আসে যায় না, কিন্তু আমাদের আসে যায়। যাদের গর্দান গেল, তাদের কেউ হয় আমাদের ভাই, নয়তো বন্ধু বা প্রতিবেশী। আর কিছু না হোক স্বদেশবাসী। সেই পোড়ার দেশের মানুষের কথা ভেবে আমরা এই প্রবাসেও প্রতিবাদ জানাতে শুক্রবার (২১ অক্টোবর) জাতিসংঘের সামনে প্রতিবাদ জমায়েতের আয়োজন করেছি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রবাসী বাঙালিরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এই ‘বর্বরতার’ প্রতিবাদ জানিয়ে তারবার্তা পাঠাবে। শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, কোনো কোনো আমেরিকান ভাই-বন্ধুও আমাদের সঙ্গে এই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। অথচ সেই ঘটনার সাফাই গাইছে আমাদের সরকার। এখন আমাদের প্রতিবাদের জবাবে যদি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, বাছারা, তোমরা এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন। তোমাদের সরকার বাহাদুর যেখানে এই শিরশ্ছেদে বেশ হয়েছে বলে সাফাই গায়, সেখানে তোমরা এত বেচঈন কেন?
আমরা বেচঈন হই, কারণ আমাদের চোখে বিশ্বের যেকোনো সভ্য মানুষের চোখে খোলা আকাশের নিচে, লোকজন ডেকে, চকচকে তরবারি বের করে কারও মাথা ঘ্যাচ করে কেটে দেওয়া একটি মধ্যযুগীয় প্রথা। একে মেনে নেওয়া যায় না। মানা উচিত নয়। বিদেশে আইন থাকতে পারে, কিন্তু সেই আইনকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিশেষত সে আইন যখন সভ্য পৃথিবীর রীতিনীতির বিপরীত। কয়েক বছর আগে এই আইনের দোহাই দিয়ে আফগানিস্তানের তালেবানি সরকার একাধিক বিদেশির প্রকাশ্য শিরশ্ছেদ করেছিল। কাবুলের একটি স্টেডিয়ামে মহা উৎসব করে ফাঁসি দেওয়া হতো। পৃথিবীর মানুষ সে ঘটনায় ছি ছি করেছে। আমরাও করেছি। সৌদি আরবে যে ঘটনা ঘটল—তাকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়ার অর্থ মধ্যযুগীয় ব্যবস্থাকে স্বীকার করে নেওয়া। এই আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নিজস্ব আইনজ্ঞ নিয়োগের সুযোগ পর্যন্ত নেই। যে তদন্ত হবে, তার পুরোটাই করবে সে দেশের পুলিশ ও আইন বিভাগ। একে আর যা-ই হোক আইনানুগ ব্যবস্থা বলা যায় না।
ঢাকার সৌদি রাষ্ট্রদূত নিদেনপক্ষে তাঁর দেশের আইনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, শরিয়াহ আইনের অপরিবর্তনীয় বিধান নিয়ে দু-চার কথা বলে আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন। পররাষ্ট্রসচিব সে পথেও যাননি। তাঁর সাফ কথা, অযৌক্তিক কিছুই হয়নি। আইনের শাসন মানলে এই বিচার মানতেই হবে। কী আশ্চর্য, একজনের মৃত্যুর জন্য আটজনের শিরশ্ছেদ হলো, এমন অদ্ভুত বিচার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না? তাহলে তো সচিব মহোদয়ের চাকরি নিয়েও টান পড়ে!
দেশের মানুষ—তা যে কারণেই হোক না কেন বিদেশে বিপদে পড়লে সরকার তার পেছনে দাঁড়াবে, নিদেনপক্ষে সহানুভূতি দেখাবে—এমন আশা করা অন্যায় কিছু নয়। পৃথিবীর সব সভ্য দেশই তা করে থাকে। বছর দুয়েক আগে তিন মার্কিন যুবক-যুবতী ইরাক-ইরান সীমান্তপথে হাইকিং করার সময় ইরানের সীমান্তে ঢুকে পড়লে সে দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন। আইন ভাঙা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে কথা শুনে ‘বেশ হয়েছে, এখন মরো’ বলে বসে থাকেনি মার্কিন সরকার। বরং তাঁদের মুক্তির জন্য হেন কাজ নেই, যা তারা করেনি। প্রকাশ্য প্রতিবাদ ও গোপন তদবির তো ছিলই। ইরানের বন্ধু এমন দেশের সঙ্গে দেন-দরবার করে গোপনে জামিনে মুক্তির টাকাও তারা জোগাড় করে দেয়। সে তিনজনই এখন দেশে ফিরে এসেছেন।
আমেরিকার কথা ছেড়ে দিই, আমাদের মতোই এক মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার কথা বলি। এ বছরের জুন মাসে রুয়াতি বিনতি সাপুবি নামে ইন্দোনেশিয়ার এক নারী গৃহকর্মী তাঁর গৃহস্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁকে ছুরি চালিয়ে হত্যা করেন। যেকোনো সভ্য দেশে এ অপরাধে লঘু শাস্তি হওয়ার কথা তাঁর। কিন্তু সৌদি আরবের আইন ব্যবস্থায় যে বিচার হয়, তাতে ওই নারীর প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ইন্দোনেশিয়া সরকার কী অবস্থান নিয়েছিল শুনবেন? না, সৌদি আইনের সপক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য সাংবাদিক ডেকে তারা কোনো সম্মেলন করেনি। ‘সবই যুক্তিপূর্ণ’, এমন কথাও কেউ বলেনি। তারা প্রথমে চেষ্টা চালায় এই শিরশ্ছেদ ঠেকাতে। তাতে সফল না হলে টাকার বিনিময়ে মুক্তি আদায়ের চেষ্টা চালায়। তার পরও যখন শিরশ্ছেদের ঘটনা ঘটে, সে দেশের সরকার অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। না, সেখানেই তারা থেমে থাকেনি। প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানানোর উদ্দেশ্যে ইন্দোনেশীয় সরকার নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে রিয়াদ থেকে ডেকে পাঠায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দেন, সৌদি সরকার অবন্ধুসুলভ (ইল উইল) মনোভাব দেখিয়েছে। না, এতেই প্রতিবাদ শেষ হয়নি। সে দেশের প্রেসিডেন্ট সুসিল বামবাং নিজে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক সংবাদ সম্মেলনে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিন্দা করে বলেন, ‘সৌদি সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সব রীতিনীতি লঙ্ঘন করেছে।’ তিনি শিরশ্ছেদের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা এই সৌদি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ নিহতের পরিবারের উদ্দেশেও তিনি সমবেদনা প্রকাশ করেন। সৌদি আরবে এ মুহূর্তে আরও ২৩ জন ইন্দোনেশীয় নাগরিক মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য রাষ্ট্রপ্রধান একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা ঘোষণা করেন এবং সৌদিতে সাময়িকভাবে সব গার্হস্থ্য কর্মী পাঠানো স্থগিত করেন।
আমাদের সরকার এত কিছু করবে, এমন আশা করি না। প্রতিবাদ করার তো প্রশ্নও ওঠে না। নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা দেখাবে, তা-ও দুরাশা। কিন্তু তাই বলে বিদেশি সরকারের একটি মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়ে তার সাফাই গাইতে হবে? আইনের নামে যাদের শিরশ্ছেদ করা হলো, তারা নিতান্তই গরিব, ছাপোষা মানুষ। ওপরতলার মানুষ হলে সম্ভবত ভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হতো। কিন্তু এসব ছাপোষা শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু-দশ টাকা দেশে পাঠায় বলেই না আমাদের অর্থনীতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। পায়ের নিচের ওই নরম গালিচাখানা টেনে সরিয়ে নিলে সরকার বাহাদুরের অবস্থা কেমন হবে? সচিব বাহাদুরের নধর বপুখানির অবস্থাই বা কী দাঁড়াবে?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইন বদলেছে, নিয়মকানুন বদলেছে। মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি রদ করার আন্দোলন এখন বিশ্বজুড়ে। সম্পূর্ণ বাতিল না হোক, তা আপাতত স্থগিত রাখা হোক, এ দাবি জানিয়ে জাতিসংঘে পর পর দুটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে। বলা বাহুল্য, সৌদি আরবের দেখাদেখি বাংলাদেশও সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। মৃত্যু দণ্ডাদেশের মতো চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষ যে এই দণ্ডাদেশে শাস্তি ভোগ করবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণে জানি, মৃত্যু দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পর দেখা গেছে সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষ দণ্ড পেয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষা ব্যবস্থা আইনসম্মতভাবে গৃহীত হওয়ার পর থেকে গত ৩৫ বছরে মৃত্যু দণ্ডাদেশ পাওয়া মানুষের মধ্যে ১৩৫ জন সম্পূর্ণ বেকসুর খালাস পেয়েছে।
শুনেছি সৌদি আরবেও নাকি পরিবর্তনের হাওয়া এসে লাগছে। সম্প্রতি সে দেশের বাদশাহ মেয়েদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। ধর্মীয় আইনের নামে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করা সেখানে কবে বন্ধ হবে?
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.