সরওয়ার-রুনি হত্যা-মেঘদের কী উত্তর দেবে সমাজ?

এমন রুদ্ধবাক ও অশ্রুসজল বিদায় যেন আর নেই। কর্মমুখর নিউজরুম থেকে বেরিয়ে নিজের বাসার নিরাপদ বেডরুমে ফিরে দুঃসংবাদের ভবিতব্য মেনে নিতে হলো সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে। অজ্ঞাত হত্যাকারীর নির্মম আঘাতে প্রাণ দিতে হলো প্রতিভাবান দুই সাংবাদিককে। অপরের দুঃখ-শোকে, আনন্দ-বিষাদে যারা সাংবাদিক হয়ে সঙ্গ দিয়েছেন এতকাল, তারাই পরিণত হলেন বিষাদগ্রস্ত হেডলাইনে। শোকাতুর হয়ে উঠলেন দেশের প্রত্যেক সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী।


যারা এ সংবাদ শুনেছেন তাদের মধ্যে কার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠেনি? যারা টিভির পর্দায় একবার মেঘ নামে সাড়ে পাঁচ বছরের সেই ছোট্ট শিশুকে দেখেছেন, তার কথা শুনেছেন; তাদের কে হতবুদ্ধি হয়ে যাননি? রুনি ও সরওয়ারের হতভাগ্য সন্তান মেঘ। কোমলমতি এই শিশুটির ঘাড়েই পড়েছিল এক গুরুদায়িত্ব। বাবা-মায়ের মৃতদেহ দেখার পর এই অবুঝ শিশুটি ছাড়া কেউ আর ছিল না, যে নিকটাত্মীয়ের কাছে এ হত্যাকাণ্ডের খবর পেঁৗছাতে পারে। শিশুটি খবর জানিয়েছে ঠিকঠাক। কিন্তু সেও তো খবর। বহু মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, আক্ষেপ করেছেন_ মেঘদের জন্য কী ভবিষ্যৎ রেখে যাচ্ছি আমরা? যে হত্যা, রক্তপাত, নৃশংসতা ও নির্মমতার বাস্তবতা নির্মিত হয়েছে চারদিকে, সে দুঃস্বপ্ন থেকে কখনও বের হয়ে আসতে পারবে কি মেঘরা? কোনো দিন বাবা-মায়ের মৃতদেহের ছবি মন থেকে সরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে কি ফেরা হবে মেঘের? দুঃসহ স্মৃতি শুধু মেঘের নয়, আরও অনেক শিশুর। এ রাজধানী শহরেই নিষ্পাপ শিশুর অপমৃত্যু ও হত্যাকাণ্ডের খবর আসছে প্রতিনিয়ত। কখনও দুর্ঘটনায়, কখনও খুনি-ছিনতাইকারী-ডাকাতের আক্রমণে নিহত হচ্ছে মানুষ। অপঘাত-গুম-খুনের নিয়তি বরণ করতে হচ্ছে অনেককে। সাংবাদিকরা শিকার হচ্ছেন হত্যাকাণ্ডসহ নির্মম আক্রমণের। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে খুনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কোনো খুনেরই প্রতিবিধান হচ্ছে না। এ পর্যন্ত কয়েকজন সাংবাদিক নিহত হলেও কোনো বিচারই শেষ হয়নি। বরং মামলাগুলো স্তিমিত কিংবা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে সাংবাদিকদের নিকটজনেরা হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন। একটি দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পেশাগত নিরাপত্তা বজায় রাখতে হলে সাংবাদিক হত্যার বিচার হতেই হবে। পুলিশের যে ভাষ্য মিলেছে তাতে এখনও স্পষ্ট নয়_ রুনি-সরওয়ার কেন নিহত হলেন? হতে পারে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, হতে পারে অন্য কোনো কারণে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পশ্চাৎপট উন্মোচিত হওয়া উচিত। আর দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। প্রধানমন্ত্রী হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হবে হত্যাকারীদের। এ সম্পাদকীয় যখন পড়বেন পাঠকরা, তখন ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে। আমরা আশা করি, পুলিশ এ সময়ের মধ্যেই হত্যাকারীদের গ্রেফতার করবে। শুধু রুনি ও সরওয়ার হত্যাকাণ্ডই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে নগরীতে যেভাবে হত্যাকাণ্ড বেড়ে চলেছে তা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে থাকলে নাগরিকদের মনে নিরাপত্তার বোধ বলতে আর কি অবশিষ্ট থাকবে? আমরা মনে করি, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর এদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। সরকার ও পুলিশের সার্বিক চেষ্টায় যে কোনো মূল্যে নাগরিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। পদস্থ ব্যক্তিদের মৌখিক দাবি এক্ষেত্রে খুব বেশি কাজে আসার কথা নয়। সরকার এদিকে সজাগ হবে বলে আমরা আশা করি। পাশাপাশি, সমাজে যেভাবে সহিংসতা, নৃশংসতা, হত্যা, জিঘাংসা বেড়ে চলেছে তা রোধ করার জন্য সামাজিক সচেতনতা দরকার। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য দেশ আমরা কীভাবে উপহার দেব?
 

No comments

Powered by Blogger.