সময়ের প্রতিধ্বনি-বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের দায়িত্ব কী by মোস্তফা কামাল

শুরুতেই ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনাপ্রবাহ পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ওয়ান-ইলেভেনের আগের মুহূর্তগুলো নিশ্চয়ই পাঠকদের মনে আছে। তখন কী এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল! পরিস্থিতি দেখে অনেকেই তখন আশঙ্কা করেছিলেন, দ্রুত রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তি করা না গেলে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে।


রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাবের কারণেই দেশে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। তখন আমরা বিদেশি কূটনীতিকদের অনেক দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। আমেরিকা ও ব্রিটেনের দূত বারবার ছুটে গেছেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের কাছে। রাজনৈতিক অরাজক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তাঁদের সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর সংগঠন টুয়েসডে গ্রুপ নিয়মিত বৈঠকে বসত। সেই বৈঠকে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করত এবং রাজনীতিকদের সবক দিত। কী করতে হবে না হবে, সেসব বিষয়ে তারা দিকনির্দেশনা দিত।
অবস্থা এমন হয়েছিল যে বিদেশি কূটনীতিকরাই দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধান করে দিচ্ছেন। তারপর তো তাঁদের সেই সমাধানের নমুনা আমরা দেখলাম। রাজনৈতিক সংকটকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান না করে অন্য পথ বের করা হলো। আমরা নতুন আদলে দীর্ঘমেয়াদি (২০০৭ থেকে ২০০৯) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন দেখলাম।
বাংলাদেশ ছোট বলে সবাই এর ওপর মাতব্বরি ফলাতে চায় এবং ফলিয়ে থাকে। কথায় বলে না, 'গরিবের বউ সবার ভাবি!' আমাদের হয়েছে সেই দশা। এই দেশটির ওপরই সবার নজর। এই দেশকে তারা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে চায়। কোনো সরকারকেই স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতে দিতে চায় না। যখন দেখবে কোনো সরকার তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করছে না, তখনই শুরু হবে ওই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তারা নানা ছুতায় সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করে দেবে। সরকারকে বিব্রত করতে ও বিপদে ফেলতে নানা বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে বেশি বেশি নাড়াচাড়া করবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে ব্যবহার করবে। সরকারবিরোধীদের বেশি বেশি উসকাবে। এভাবেই অস্থিরতা জিইয়ে রাখবে।
ইদানীংকালে ওয়ান-ইলেভেনের আগের মুহূর্তগুলো যেন আবার ফিরে আসছে। আমেরিকান নয়া রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বাংলাদেশে এসেই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খুব বেশি কথাবার্তা বলা শুরু করেন। তিনি নানাজনের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সেসব বৈঠকে মূলত রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করছেন। তিনি ইতিমধ্যেই পাঁচবার সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁর কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের গভর্নর। তিনি নির্দেশ করবেন আর রাজনৈতিক দলগুলো বৈঠকে বসতে বাধ্য হবে। তিনি সমস্যার সমাধান করতেও বাধ্য হবেন। তা না হলে নিশ্চয়ই আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টি করা হবে!
আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের মতো করেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা। ইতিমধ্যেই আমরা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের মন্তব্য শুনেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও রাজনৈতিক সংকট নিয়ে কথা বলেছেন। এবার বলেছেন নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত। গত রবিবার সংবাদ সম্মেলন করে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত আলফানস হেনিকেনস বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। আগামী দুই বছরে নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে নজর দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সম্পর্কে তিনি বলেন, উভয়েরই প্রথমে দেশের স্বার্থ দেখা উচিত। কথাগুলো শুনলে ভালোই লাগে। কিন্তু এই কথাগুলো বলার জন্য কি তাঁকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়েছে?
যেকোনো দেশের রাষ্ট্রদূতকেই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ওই দেশের নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। তা ছাড়া জেনেভা কনভেনশনেও রাষ্ট্রদূতের কর্মপরিধি সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। তিনি যে দেশে নিযুক্ত হবেন, সেই দেশের সঙ্গে নিজ দেশের সম্পর্কোন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করবেন। একই সঙ্গে ওই দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ রাষ্ট্রের প্রদত্ত দায়িত্ব্ব পালন করবেন। কিন্তু ওই দেশের রাজনৈতিক বিষয় কিংবা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কোনো মন্তব্য করবেন না। সরকারের কাজে নাক গলাতে পারবেন না। তাহলে জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করা হবে। সে জন্য তাঁকে প্রত্যাহারসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশে এসেই যেন গভর্নরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। রাষ্ট্রদূতরা নিজেরাও জানেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করে তাঁরা জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করছেন। তার পরও কেন এই বাড়াবাড়ি? বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দরিদ্র দেশ বলে? বাংলাদেশকে সাহায্য করে ধন্য করছেন বলে? নাকি সরকার ও বিরোধী দলকে সবক দিয়ে তাঁরা আনন্দ পান!
ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। সেখানে কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা তো দূরের কথা, কথায় কথায় মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও করতে পারেন না। কোনো রাষ্ট্রদূত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার সাহস দেখালে তাঁকে রীতিমতো বিমানে তুলে নিজ গন্তব্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উন্নত দেশগুলোতে তো রুটিন কাজের বাইরে কিছুই করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে এলেই তাঁদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়।
বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের এই বাড়াবাড়ির জন্য আমাদের রাজনীতিকরাও অনেকাংশে দায়ী। সব কিছুর জন্য আমাদের রাজনীতিকরা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের কাছে ছুটে যান। অবস্থাটা এমন, যেন তাঁরাই সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানায় রাষ্ট্রদূতদের কাছে। আবার সরকারও রাষ্ট্রদূতদের তোয়াজ করে চলে। তাঁদের হাতে রাখার নানা কৌশল নিয়ে থাকে। তাঁরা অসন্তুষ্ট হতে পারেন_এই ভয়ে তাঁদের 'রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ' নীরবে সহ্য করে। এ অবস্থার অবসান হওয়া খুবই জরুরি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই রাষ্ট্রদূতের কর্মপরিধি সম্পর্কে সচেতন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য সংবাদ সম্মেলনের অনুমতি দিয়েছে? না দিয়ে থাকলে ওই রাষ্ট্রদূতকে ডেকে তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি সেই দায়িত্ব পালন করেছে? না করে থাকলে কেন করেনি, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। শুধু সাহায্য দেন বলে রাষ্ট্রদূতরা নিয়মিত তাঁদের সীমা লঙ্ঘন করবেন তা হয় না, সরকারও তা মেনে নিতে পারে না।
চীন-জাপানও তো বাংলাদেশকে সাহায্য দিচ্ছে এবং তথাকথিত দাতাদেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে জাপান কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই সাহায্য দিচ্ছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে চীনও বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে বিস্তর সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। আর পশ্চিমা দেশগুলো সামান্য সহায়তা দিয়ে বেশি বেশি নাক গলাচ্ছে।
তবে হ্যাঁ, সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কোনো শর্ত থেকেই থাকে তাহলে তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারকে অবহিত করবে। প্রয়োজনে তারা সহায়তা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কোনো ইস্যু তৈরি করবে না।
সম্প্রতি পদ্মা সেতু ইস্যুতে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে সাদুবাদ জানাই। তিনি বিশ্বব্যাংককে উদ্দেশ করে বলেছেন, 'পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে প্রমাণ করতে না পারলে সাহায্য নেব না।' অনেকেই হয়তো বলবেন, ছোট মুখে বড় কথা মানায় না। কিন্তু আমি মনে করি, বাংলাদেশের সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে, পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি দুটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে উল্লেখ করেছি, বিশ্বব্যাংক যে প্রকল্পে অর্থই ছাড় করল না, সেই প্রকল্পে দুর্নীতি হলো কী করে? তবে হ্যাঁ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর হয়তো কোনো অভিলাষ ছিল। সেটা যখন আগেই বিশ্বব্যাংক টের পেয়েছিল, সেহেতু তারা অপেক্ষা করতে পারত। নিশ্চয়ই মন্ত্রীকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণের সুযোগ তৈরি হতো। আগেভাগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তারা পদ্মা সেতুতে সহায়তার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে নিল। পরে মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হলেও বিশ্বব্যাংক নতুন করে সহায়তার ঘোষণা দেয়নি। মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বব্যাংক এখনো প্রমাণ করতে পারেনি। তবে এতে সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের আলোচনায় বসা উচিত।
পরিশেষে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোকে বলতে চাই, এই দেশ এবং এ দেশের মানুষকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র আমরা মানব না। এ দেশের গণতন্ত্র, শাসনতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনীতি_এসব নিয়ে নাক গলানো ঠিক হবে না। এসব ক্ষেত্রে আমাদের ত্রুটি থাকতে পারে এবং উন্নয়ন সহযোগীরা তাতে সহায়তা করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। আমাদের জনগণই মূল শক্তি। তারাই রাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.