শোকাঞ্জলি-বন্ধু আমার পাশেই আছে by ফরিদুর রেজা সাগর

বাংলাদেশ টেলিভিশনের ডিআইটি স্টুডিওর বাইরে বারান্দা ছিল একটা! সেই বারান্দায় আমরা অনেক সময় হাঁটতাম। কখনো বসে থাকতাম সিঁড়ির ওপর। বারান্দার বাইরে বাগান। বাগানের সঙ্গে রেলিং। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে চলত আড্ডা। সেই সময় আমরা সাধারণত অংশ নিতাম ছোটদের টিভি অনুষ্ঠানে।


তখন বড়দের অনুষ্ঠান মানে গানের অনুষ্ঠান আর নাটক। যাঁরা নাটকের সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা খুব দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন সেই বারান্দায়, বাগানে। সে সময়কার বিখ্যাত এক নাট্যকার কবির আনোয়ার। বিখ্যাত টিভি নায়ক উজ্জল। চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের ছবিতেও তখন কাজ করছেন তিনি।
কবির আনোয়ার আর আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জল খুব বন্ধু ছিলেন। তাঁদের সখ্যতা, আড্ডাবাজি দূর থেকে দেখতাম।
প্রায়ই দেখতাম দুজন কাঁধে হাত দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বাগানে হাঁটছেন। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে চুটিয়ে গপ্পো করছেন। সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে সিরিয়াস কোনো টপিক নিয়ে আলোচনা করছেন।
ওই সব দৃশ্য চোখের সামনে দেখতাম আর ঈর্ষান্বিত হতাম!
বুকটা কেমন চিনচিন করত এই ভেবে: কত বড় একজন নাট্যকার কত বড় একজন নায়কের মধ্যে কী সাংঘাতিক সখ্য! তাঁরা কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু! বন্ধুত্বের ফাঁকে ফাঁকে নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছেন। ভাবছেন নতুন প্রযোজনার কথা। যেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, সবার দৃষ্টি সেদিকেই চলে যাচ্ছে।
ভাবতাম, আমার যদি এই রকম বিখ্যাত বন্ধু থাকত! তখনো কল্পনা করতে পারিনি, আমার জীবনেও সুবিখ্যাত কয়েকজন বন্ধু পাশে পাওয়ার ঘটনা ঘটে যাবে।
স্পষ্ট মনে আছে, আমার এক বন্ধু নাটকে প্রচণ্ড জনপ্রিয় আফজাল হোসেন বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক রোববার-এর পাতায় এক সাক্ষাৎকারে ঘোষণা দিলেন, ‘সামনে একজন অভিনেতাকে পাবে টেলিভিশনের দর্শকেরা, যে সব প্রথা ভাঙচুর করে নায়ক হিসেবে খ্যাত হবে। নিশ্চিত করছি, সেই অভিনেতা সব শ্রেণীর দর্শকের কাছে প্রবল জনপ্রিয়তা পাবে।’
তিনি এলেন। জয় করলেন। নায়ক বলতে যে প্রতিষ্ঠিত ফর্মুলা আছে তা পাল্টে দিলেন হুমায়ুন ফরীদি। যিনি পরবর্তী সময়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন ভাবতে গর্ব অনুভব করি। চার দশক ধরে যিনি অভিনয়ে অম্লান।
অভিনেতা আফজাল হোসেন তখন অভিনয়ের পাশাপাশি আঁকছেন, নাটকও লিখছেন। তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় সেই নায়ক যখন পত্রিকায় অকপটে ঘোষণা দিলেন, আরেকজন নায়ক আসছেন, তখন সবার চোখ সেই মন্তব্যে পড়বে। আমারও পড়েছিল।
আফজাল সাপ্তাহিক রোববারে বলেছিলেন, ‘আমি খুব শিগগির পর্দায় এমন একজন শিল্পীকে হাজির করব, যে ঢাকা শহরের বাইরে থেকে এসে পুরো দর্শককে ভয়ংকরভাবে নাড়িয়ে দেবে। দর্শকেরা বুঝতে পারবে, সত্যি সত্যি অভিনয় মাটিতে একটা ভূমিকম্প ঘটছে। কারণ, আমাদের এত দিন ধরে চলা গৎবাঁধা নাটকে, গৎবাঁধা চরিত্রে, গৎবাঁধা নায়কের যে সন্নিবেশ তার থেকে এ শিল্পীটা আলাদা। সম্পূর্ণ আলাদা।’
আফজালের সেই সাক্ষাৎকার পড়ে আমাদের অনেকের তখন সেই মন্তব্য নজর কেড়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস কি করেছিলাম মন্তব্যটা?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা, চাঁদপুর থেকে আসা সেই ছেলেটি সাধারণ এক চেহারা নিয়ে অভিনয়জগতের সব ধারণা লন্ডভন্ড করে দিলেন। আগের মতো তারকা ইমেজের হিসাব পাল্টে দিলেন আমূল।
ফরীদি তাঁর বৈশিষ্ট্যেই হয়ে উঠলেন নতুন স্মার্টনেসের নতুন সংজ্ঞা। দর্শকপ্রিয় হয়ে উঠলেন একক স্বকীয়তায়।
চলচ্চিত্রকার সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর একটি ছবির মহরত অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। শিশু একাডেমীতে অনুষ্ঠিত সেই মহরতে ফরীদি হঠাৎ এত উচ্চস্বর ও শরীরী ভাষা প্রয়োগে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন যে মুহূর্তে সবার মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি বুঝি দৈত্য পড়েছে শিশুদের মাঝখানে। সবাই জানতাম, সত্যি নয়, এটা অভিনয়। তবু মুহূর্তের জন্য পিলে চমকে গিয়েছিল!
সেই হুমায়ুন ফরীদি টিভি নাটকে সুবর্ণার পাশে কখনো, কখনো অন্য নায়িকার পাশে রোমান্টিক অভিনয়ে কত পরিমিত! কত স্মিতভাষী!
অত্যাশ্চর্য জাদুকরি ক্ষমতায় শক্তিমান ছিলেন তিনি এখানেই। যাঁর তুলনা তিনি নিজে। তাঁর লো-প্রোফাইল অভিনয় দেখে যখন দর্শক কেঁদেছে, ব্যক্তি জীবনে আমরা তাঁর রসবোধ দেখে তখন হাসতে হাসতে মরেছি।
সদাহাস্যময়। চারপাশ জমিয়ে রাখা সেই বন্ধু আবার যখন ছবির জগতে গেলেন, প্রতিনায়ক হিসেবে জায়গাটা নিয়ে নিলেন সবার ওপরে।
তাঁর তুল্য ভিলেন এখন পর্যন্ত কারও চোখে পড়ে না। সার্থক সেই অভিনেতার কমেডি অভিনয় দেখেও চলচ্চিত্র দর্শকেরা মুগ্ধ হয়েছে। শুধু তাঁর অভিনয়সমৃদ্ধিতেই ছবি হিট করেছে একটার পর একটা।
পুরস্কার পেতে থাকলেন তিনি। স্বীকৃতি পেতে থাকলেন। পেতে থাকলেন জনপ্রিয়তা। ক্রমে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন। তাঁর প্রতি মানুষের অসামান্য ভালোবাসা হয়ে গেল বর্ণনাতীত।
যে মুহূর্তে খবর এল, তিনি নেই, তখন সব শ্রেণীর মানুষের ‘ভেতর থেকে আসা’ শ্রদ্ধা প্রদর্শনই তাঁর জননন্দিত ইমেজের সাক্ষর দিচ্ছে।
ফরীদির শেষ অসুস্থতার খবর বন্ধু চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন বুলুর কাছ থেকে পেয়ে গেলাম দেখা করতে।
ফরীদি বসে ছিলেন একটা চেয়ারে।
আশপাশের মানুষ ফিসফিস করে আমাকে বললেন, শরীরটা তাঁর আসলে খুব একটা ভালো নেই। দেখা করতে এসে ভালোই করেছেন।
মাথায় নিচ্ছিলাম না কথাগুলো। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার এ বন্ধুটি তো সেই জাদুকর, যিনি মুহূর্তে সব পাল্টে দেবেন। কারণ তিনি মানুষকে আনন্দ দিতে জানেন। দুঃখ দিতে নয়।
এটা ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। ফরীদির সঙ্গে এটা আমার শেষ দেখা হতেই পারে না। আবার যখন আমার বন্ধুটির সঙ্গে দেখা হবে, দেখব, তিনি অসাধারণ ভূমিকায় একটার পর একটা চরিত্রে অভিনয় করছেন!
সব দর্শককে কাজ করে বোঝাচ্ছেন, এই যে দেখো। আমি আবার নতুন রূপে তোমাদের সামনে হাজির হলাম।
ফরীদি চলে গেছেন। কিন্তু আসলেই কি গেছেন? ফরীদি যান না। ফরীদিরা থেকেই যান।
আর হয়তো সবার সামনে হাজির হবেন না, এটা ঠিক। তবু ফরীদি আছেন। দর্শকের মধ্যে আছেন।
বন্ধু হিসেবে আমার কাছেও আছেন। কারণ এমন একটা দিনে ফরীদি চলে গেলেন যে দিনটা বন্ধুর মতোই কাঙ্ক্ষিত। দিনটি পয়লা ফাল্গুন, বসন্তের প্রথম দিন।
ফরিদুর রেজা সাগর: শিশুসাহিত্যিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.