উইল ইংলান্ড এবং মাইকেল বার্নবাম-নরওয়ে হামলা : ওকলাহোমার চিত্রই যেন

অন্তত ৯২ জন মানুষের মৃত্যুর পর নরওয়ের অধিবাসীরা ভাবতে থাকে বোধ হয় আরেকটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। যাকে মনে করা হতে থাকে ওকলাহোমা নগরীতে বোমা হামলারই মতো কোনো ঘটনা। এখানে এই জঘন্য অপরাধের সংঘটক হিসেবেও মুসলমানদের দিকেই দৃষ্টি গিয়েছিল এখানকার মানুষের। কিন্তু নরওয়ের মানুষ এখন দেখল ৩২ বছর বয়সের একজন খ্রিস্টান যুবক অসলো এবং নিকটবর্তী দ্বীপের বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণের জন্য দায়ী।


যে নাকি বহু সংস্কৃতির মিশ্রণের প্রক্রিয়ার প্রচণ্ড বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত, অন্তত এই পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় তাকে ছাড়া আর অন্য কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তার নাম এন্ডার্স বেরিং ব্রেভিক। নরওয়ের একটি পত্রিকা তার ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ করেছে, সে সম্প্রতি অনেক সার কিনেছিল। সারগুলো দিয়ে বোমা তৈরি করা সম্ভব বলেও মনে করা হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে ওকলাহোমা নগরীতে যে বোমা হামলা হয়েছিল, সেখানেও একইভাবে বোমা তৈরিতে সারের ব্যবহার লক্ষ করা গেছে।
ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ব্রেভিক নরওয়ের চরম দক্ষিণপন্থীদের অনুসারী ছিল। আর তারা এক দশককাল আগে সেখানে একটি আন্দোলন করেছিল। ওয়েবসাইটেই দেখা গেছে, সে রাজনীতিবিদদের সরাসরি জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছে বলে দোষারোপ করেছে। কিন্তু কোথাও এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যে তার জন্য সেখানে কোনো রকম সন্ত্রাস কিংবা মারামারির মতো কোনো ঘটনা ঘটতে পারে।
৪৫ লাখ মানুষের দেশ নরওয়ে গেল শনিবার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। বিশেষ করে, দ্বীপভূমি অটোয়াতে লেবার পার্টির একটি সম্মেলনে যোগ দিতে আসা কিশোরদের ৮০ জনের প্রাণহানির ঘটনাটি তাদের জন্য বড় রকমের একটি ধাক্কা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
অসলো নগরী নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যদিও সেখানে ঘটনার বিস্তারিত জানার জন্য কিংবা এই মর্মান্তিক ঘটনায় একাত্মতা প্রকাশের জন্য রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছিল।
নরওয়ের সংগীতশিল্পী ও গীতিকার সমিতির নেতা নাট এফ্লয় জোর দিয়েই বললেন, এটা আমাদের নগরী। যেখানে এমন ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে মানুষ একত্রিত হতে চাইছে। কিংস গার্ডের সৈনিকরা সশস্ত্র অবস্থায় বোমা বিস্ফোরণের জায়গাটি ঘিরে রেখেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের দেশটির অধিবাসীরা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে এমন ঘটনায়। প্রধানমন্ত্রী জেন্স স্টুলেনবার্গ দ্বীপের ঘটনায় বেঁচে থাকা মানুষজনের কাছে গিয়েছেন। নিহতদের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে বৈঠক করেছেন নগরীর একটি হোটেলে। তিনি তাদের বলেছেন, 'এই ঘটনা আমাদের নরওয়ের সমাজব্যবস্থাকে কতটা পরিবর্তন করে দেবে সেটা বলার সময় এখনো আসেনি।' স্টুলেনবার্গ বলেছেন, 'আমাদের নরওয়ের মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক সমাজের কোনো পরিবর্তন হতে পারে না। আর যারা আমাদের বিপথে নিয়ে যেতে চাইছে, নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি তাদের পরাজয় হবেই।'
রাজপরিবারের পক্ষ থেকেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। যুবরাজ হাকন ও রাজপরিবারের আরো কিছু সদস্যকে নিয়ে রানি সনজা অসলোর গির্জা ডমক্রিকে গেছেন। তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, দেখেছেন অসংখ্য মানুষ নীরবে ওই এলাকা প্রদক্ষিণ করছে আর ওই সময় সেখানকার ডিন তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এরপর রাজপরিবারের সদস্যরা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রাচীন গির্জায় ঢোকেন, সেখানে তখন নিহতদের উদ্দেশে প্রার্থনা চলছিল। অনেক মানুষ সেখানে জমায়েত হয়েছিল, কিন্তু সেখানে ছিল পিনপতন নীরবতা। এমন নীরবতা ভেদ করেও নরওয়ের মানুষের মনে একটা কথাই বারবার আঘাত করে_বোমা বিস্ফোরণে ভবন নষ্ট হয়েছে। সেগুলো তো সংস্কার করা হয়ে যাবে। কিন্তু নিষ্পাপ এই শিশুগুলো, যাদের জীবন চলে গেছে, তাদের তো ফিরে পাওয়া যাবে না। নীরব গির্জা থেকে বেরিয়ে আসা ৭০ বছর বয়সের মার্গেট এরিকসেন তা-ই বলেন।
টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বেঁচে থাকা কয়েকজন। তাঁদেরই একজন বলেন, সেই লোমহর্ষক দৃশ্যের কথা। কী দুর্বিষহ দৃশ্য ছিল সেটা। পুলিশ অফিসারের পোশাক পরিহিত সেই বন্দুকধারীটি দুটি বন্দুক বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ৯০ মিনিট ধরে সে যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। পুলিশের ধারণা, কিছু মানুষ সাঁতার কেটে বেঁচে যেতে পারে। তবে এই হত্যাকাণ্ডটি দুজন খুনির কাজ বলেও পুলিশ মনে করছে। এখনো নিখোঁজদের তালিকায় চারজনের নাম পাওয়া যায়।
পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার এক ঘণ্টা আগেই এই নৃশংসতা ঘটেছে। যদিও পুলিশ বলছে, গুলি হওয়ার ৪০ মিনিটের মধ্যেই তারা ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছে। ব্রেভিককে ধরে নিয়ে একটি নৌকায় তোলা হয়। তখন তাকে একবারে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। যেন কিছুই হয়নি তার সামনে। তবে নরওয়ের মানুষের আশ্বস্ত হওয়ার মতো একটি বার্তাও কিন্তু আছে। তারা এটা ভেবে কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করতে পারে যে এই ঘটনা ঘটার পেছনে আল-কায়েদার মতো কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের হাত নেই। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট শ্বেতাঙ্গ দ্বারা যখন এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়, এটা পাগলামির ফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ডিকা ওমের নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'আমরা খুবই ছোট একটি দেশের মানুষ। আমরা একে অন্যকে চিনি-জানি। আমাদের শহরটা খুবই সুখের ও সুন্দর।' সোমালিয়া থেকে আসা এই মুসলিম নারী বিশ্বাসই করতে পারেন না, এমন একটি ঘটনা সেখানে ঘটতে পারে।
ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ভার্থল্যান্ড পত্রিকার অফিস। সেখানকার সাংবাদিকরা ভয়ে দৌড়ে আসেন। তাঁদের বর্ণনাও ঠিক একই রকম। তাঁরাও বলেন, ঘটনাটি যেন ওকলাহোমা সিটির ঘটনাকেই মনে করিয়ে দেয়। সেখানকার একজন গবেষকও প্রথম অবস্থায় মুসলমানদেরই সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা তেমন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানরা যে কাজটি করেছিল, তেমনি একটা ঘটনা ঘটে গেল এখানে। নরওয়ের মানুষ এমন ঘটনার কথা চিন্তাও করতে পারে না। এমন যেন আর কখনো না ঘটে।

লেখকদ্বয় সাংবাদিক। ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর : এম. হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.