কল্পকথার গল্প-কামড় দিয়েছে পায়!' by আলী হাবিব

পলিটিক্সে ট্রিকস বুঝে ওঠা যা-তা লোকের কাজ নয়। বেশি বুঝতে গেলে আবার রিস্ক থেকে যায়। কার মাথার হার্ডডিস্কে কী ফিক্স করা আছে, সেটা তো আর কারো জানা থাকে না। পলিটিক্স বড় জটিল জায়গা। পথ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পথ খুঁজে পাওয়া গেলেও যে সে পথে নির্বিঘ্নে হাঁটা যাবে, এটা বলা যায় না। অবশ্য রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
আজকের শত্রু কাল যে মিত্র হবে না, এ কথাও তো হলফ করে বলা যায় না। সমস্যা একটাই, আয়নায় নিজের আসল চেহারাটি কারো চোখে পড়ে না। আয়না যিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি বোধ হয় ভাবতেও পারেননি, আয়না জিনিসটা কেমন করে আমাদের দিন পাল্টে দেবে। আয়না ছাড়া এখন আমাদের একদিনও চলছে না। তবে ঝামেলা একটাই, আয়নায় আসল চেহারাটা আমরা কেউই দেখতে পাই না। আমাদের চেহারার আড়ালে আরেকটা চেহারা আছে। সেটাই হচ্ছে আসল চেহারা। দেখতে পেলে ভালো হতো। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার মতো আয়নায় চেহারা যদি দেখিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো নিজের সম্পর্কে অনেকের ধারণা পাল্টে যেত। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে পারেননি বলেই দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। দুর্যোধনের উপদেষ্টা হিসেবে পাওয়া যায় তাঁর মামা শকুনিকে। মহাদেব বর দিয়েছিলেন দুর্যোধনকে। সে বরের কল্যাণে তিনি ছিলেন অভেদ্য। পাণ্ডবদের সম্পদ দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন দুর্যোধন। পাণ্ডবদের যা আছে, তা কেন তাঁর হবে না? তিনি মানসিক পীড়ায় ভুগতে শুরু করলেন।
অথচ খুব একটা খারাপ ছিলেন না দুর্যোধন। দাম্ভিক হলেও ছিলেন দৃঢ়চেতা ও উদ্যোগী। উপযুক্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে জানতেন। ছিলেন প্রজাবৎসল শাসক। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন দুর্মুখ ও ক্রুর। আজীবন পাণ্ডবদের অনিষ্টসাধনেই তৎপর ছিলেন এই দুর্যোধন। পাণ্ডবদের কোনো অর্জনই তিনি সহ্য করতে পারতেন না।
এমন হয়। অন্যের সম্পদ দেখে অনেকেরই ঈর্ষা হয়। আরেকজনের যা আছে, তা নিজের করে পেতে চান অনেকেই। কিন্তু চাইলেই তো আর পাওয়াটা সহজ হয় না। অন্যের যা অর্জন, সেটা নিজে অর্জন করতে গেলে তার জন্য সময় দিতে হয়। শ্রম দিতে হয়। সেই শ্রম না দিয়েই অনেকে অনেক কিছু চেয়ে ফেলেন। তবে সহজ হচ্ছে, অন্যের বদনামটা নিজের মতো অর্জন করে নিতে পারা। অন্যরা যা করেছে বা করতে পেরেছে, সেটা কেন আমি পারব না_এমন মনোভাব নিয়ে যাদের দিন কাটে, তাদের একবার অন্তত ভেবে দেখা উচিত অন্যের অর্জনটা ন্যায়সঙ্গত কি-না। অন্যের অন্যায়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আমি নতুন করে কোনো কোনো অন্যায় করে ফেলছি কি-না, সেটা আগে থেকেই ভাবলে আমাদের সমাজ থেকে অনেক সমস্যা চলে যেত। এটা আমরা ভাবতে পারি না বলেই আমাদের সমাজ থেকে অনেক সমস্যা দূর করা যায়নি। সে যদি পারে আমি কেন পারব না_এটা ভাবতে গিয়ে আমরা অনেক সময় নিজেদের অনিষ্ট করে ফেলি। অন্য কেউ যখন কোনো অসৎ কর্ম করে ফেলে, তার দেখাদেখি নিজেরাও করি। কেন? ও যদি পারে, আমি পারব না কেন_এই মনোভাব থেকে। কিন্তু সবকিছু করা কিংবা করতে পারা যে আমাদের সবাইকে মানায় না, সেটা আমরা কাজ করার আগে বুঝতেই পারি না। সব কাজ যে সবার জন্য নয়, এমন একটা গল্প বলা যাক। গল্পটা অনেকেরই জানা। অন্তত কবিতায় এটা আমরা অনেকেই পড়েছি। সেই যে এক পথিক ও কুকুরের গল্প। 'কুকুর আসিয়া এমন কামড় দিল পথিকের পায়...।' কামড়ে কুকুরের বিষদাঁত ফুটে গেল পথিকের পায়। কুকুরের কামড় খেয়ে পথিক শয্যাশায়ী। তাঁর ছোট মেয়েটি রাত জেগে বসে থাকে বাবার শিয়রে। বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে, মেয়ের আর কিছুই ভালো লাগে না। বাবাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখতেও তো তার ভালো লাগে না। শিশুমনেও কিছুটা ক্ষোভ জন্ম নেয়। বাবা তো সব সন্তানেরই প্রথম নায়ক। সেই বাবাকে কুকুরের কামড় খেয়ে এসে এভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখলে কারোরই তো ভালো লাগার কথা নয়। মেয়েটিরও লাগেনি। তার মনে প্রতিশোধ নেওয়ার গোপন ইচ্ছে বোধ হয় একটু একটু করে চাড়া দিচ্ছিল। অথবা শিশুমনের সরলতায় সে তার বাবার কাছে জানতে চায়, কুকুর যখন তার পায়ে কামড় দিল তখন তার বাবা উল্টো ওই কুকুরটার পায়ে কামড় দিল না কেন? মেয়ের প্রশ্ন শুনে ক্ষতের ব্যথা ভুলে বাবা বলেন, 'কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে/ কামড় দিয়েছে পায়/ তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে/ মানুষের শোভা পায়?' এটাই হচ্ছে মোক্ষম কথা। অন্যের যা সাজে সেটা আমার সাজে না, এটা বুঝতে হবে। স্বভাবদোষে কেউ অন্যায় করলে আমি সেটা যে করতে পারি না, এই বিবেচনাবোধটা যদি মনের ভেতর না জন্মায়, তাহলে অন্যের সঙ্গে আমার পার্থক্যটা কোথায়? কী দেখে আমাকে আলাদা করে চেনা যাবে? আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে গেলে আমি তো কেবল দেখব এক দানবের চেহারা। কিন্তু আমি তো দানব নই। দানব হতেও চাই না। ঠাঁই নিতে চাই মানব মনের কোণে। কিন্তু দানবের পাশে নিজেকে দাঁড় করাতে গিয়ে আমিও দানব হয়ে যাচ্ছি কি না, এটা নিয়ে এখন কেউ ভাবিত বলে মনে হয় না। 'ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়'_এ কথাটি প্রচলিত হলেও আমাদের রাজনীতির ন্যাড়া বেলতলায় যাচ্ছে বারবার। কেন যাচ্ছে? নিশ্চয় পেছনে কোনো শক্তি কাজ করছে। দুর্যোধনকে যেমন সামনের দিকে ঠেলে দিতেন শকুনি, তেমনই কেউ হয়তো পেছন থেকে ঠেলছে। মাথার ভেতরে ঢুকে কামড়াচ্ছে।
আবার একটা গল্প বলা যাক। এক বালক তার নানার সঙ্গে নদীতে গোসল করতে গেছে। মা-বাবা তাকে কখনো একা ছাড়ে না। নানার সঙ্গে নদীতে গোসল করতে গিয়ে বালকটি পানিতে নেমে বেশ খুশিমনেই লাফালাফি করছিল। একসময় একটা অজগর এসে ছেলেটিকে গিলে ফেলতে চাইল। অজগর কি পানিতে থাকে? গল্পের অজগর পানিতে কেন আকাশে থাকলেও কোনো দোষ নেই। গল্প তো। তো নানা দেখলেন, আদরের নাতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অজগর সাপ। গিলে ফেলতে চাইছে। তিনি ছুটে গেলেন। শুরু হলো যুদ্ধ। 'বাঘে-মোষে' লড়াই বলে একটা ব্যাপার আমরা জানি। অনেকটা সে রকমই। নাতিকে নিয়ে নানার সঙ্গে অজগরের লড়াই শুরু হয়ে গেল। অজগর চায় নাতিকে গিলে ফেলতে। নানা চান আদরের নাতিকে অজগরের মুখ থেকে বাঁচাতে। নানার ভালোবাসার কাছে পরাজিত হলো অজগরের লোভ। রণে ভঙ্গ দিল অজগর। বালকটিকে ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। নানা বালকটিকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। এর মধ্যে অনেক সময় চলে গেছে। নদীর পাড়ে বেশ বড় ভিড় জমে গিয়েছিল। নানা বিজয়ীর বেশে বাড়ির পথ ধরলেন। পথে লোকে নানা কথা জানতে চায়। এ সময়ে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে নিশ্চয় টিভি ক্যামেরায় সেটা লাইভ প্রচার করা হতো। সে সময়ে তো আর আজকের দিনের মতো সুযোগ ছিল না। যাহোক, বাড়িতে যাওয়ার পথে বালকটির কাছে একজন জানতে চাইল, এরপর সে আর কোনোদিন নদীতে গোসল করতে যাবে কি না। ছেলেটি সোৎসাহে বলল, অবশ্যই যাবে। 'কেন? ভয় করবে না!' বিস্মিত প্রশ্নকর্তা। বালকের সরল জবাব, 'আমার নানা আছে না!'
নেপথ্যে এমন অভয় থাকলে বালক থেকে সাবালক অনেকেই যে অনেক কর্ম (!) করে ফেলতে দ্বিধা করবে না, সে কথা আমাদের অর্বাচীন রাজনীতি কবে যে বুঝবে?
বুঝলে বোধ হয় রাজনীতি অন্যের অনুসারী হতো না।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.