ও আলোর পথযাত্রী by রাজীব নন্দী

মাঘের পড়ন্ত বিকেল। ধানকাটা শেষে অলস ক্ষেতের বুকে বানানো হয়েছে মঞ্চ। মাইকে বাজছে 'ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি এখানে থেমো না।' হলুদ শাড়ি পরা সারিবদ্ধ কিশোরী-তরুণীর দল ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করছে অতিথিদের। কুড়ি বছরের তরুণদের সঙ্গে সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণদের হাসি-গান-মেলা। দৃশ্যটি অভিনব।


গ্রামের নাম মির্জাপুর। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার একটি গ্রাম। যে গ্রামে সম্প্রতি প্রবীণ বাচস্পতি, ধারালো বাক্যবাগীশ আর অনন্য তর্কালঙ্কার গুণী শিক্ষকরা মিলিত হয়েছেন। উপলক্ষ_ গুণী শিক্ষক সম্মাননা।
দিনটি ছিল মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথি। যে পুণ্য তিথিতে শ্রীশ্রী সরস্বতী দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা, সঙ্গীত ও শিল্পকলায় সফলতার আশায় শিক্ষার্থীরা এই দেবীর পূজা করে থাকে। প্রতি বছরের মতো এবারও মির্জাপুর গ্রামের পূর্ব নন্দীবাড়ী তরুণ সংঘ আয়োজন করে শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা মাতৃরূপ দেবী সরস্বতী পূজার। এই উৎসবে তরুণ সংঘের পক্ষ থেকে হাটহাজারী উপজেলায় প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় গুণী শিক্ষক সম্মাননার।
দেশের হাজারো সরস্বতী পূজামণ্ডপের মাইকে ভেসে এসেছিল সেদিন সরস্বতী বন্দনার 'জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে' শ্লোক, কিন্তু তরুণ সংঘ নমহস্তুতে জানিয়েছে সেই গ্রামেরই সাত প্রবীণ শিক্ষককে। দুপুর ১২টায় ছিল দেবী পূজা ও পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণ। বিকেল ৩টা বাজতেই অতিথিবরণ ও পিঠাভোজনে মুখর হয়ে ওঠে উৎসব প্রাঙ্গণ। রাত সাড়ে ৯টায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র আমার বন্ধু রাশেদ প্রদর্শনী। শেষরাতে মশালনৃত্যের মাধ্যমে কর্মসূচির সমাপ্তি হয়।
অনুষ্ঠানের সর্ববয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক অক্ষয় কুমার দাশ। ১৯৫৮ সালে মির্জাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যোগ দেন। ইংরেজি, গণিত, সমাজবিদ্যা_ সবই পড়াতেন তিনি। ১৯৭৩ সালে শুরু করেন চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যাপনা। ১৯৯৪ সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যিনি এই গ্রাম থেকে গড়ে তুলেছিলেন শত শত শিক্ষার্থী। ব্যোমকেশ দাশ, নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান। গ্রামের গরিব এবং পিছিয়ে পড়াদের বিজ্ঞান শিক্ষায় এগিয়ে নিতে ১৯৬৬ সালে অধ্যাপনায় আসেন। ২০০৫ সালে অবসরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মির্জাপুর গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে পড়িয়েছেন তিনি। বলরাম সোম, সবার প্রিয় বলাই স্যার। সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন মির্জাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। গ্রামের এমন কোনো পাড়া নেই বলাই স্যার টিউশনি করাননি। আলহাজ হোসনে আরা বেগম চৌধুরী। পাখি ম্যাডাম নামে পরিচিত এই প্রবীণ শিক্ষিকা মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় ইংরেজি পড়িয়েছেন। তার গর্ব এই, তার হাতে গড়া শিক্ষার্থীরা আজ ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। হোসনে আরা শুধু নিজের জীবনকেই শিক্ষকতায় ব্রতী করেননি; দুই পুত্র ও এক কন্যাকেও শিক্ষকতায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। অনুষ্ঠানে আবেগ যোগ করেছেন মোহাম্মদ আলী। মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গণিত পড়াতেন। সত্তরোর্ধ্ব এই শিক্ষক শোনালেন অর্থাভাবে মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কাহিনী। সেই থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান দানকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। অনুষ্ঠানের মঞ্চে ঘাড় গুঁজে চুপচাপ বসে ছিলেন অনিল কান্তি শীল। আশির কোটা পেরোনো এই শিক্ষকের মুখভর্তি সাদা দাড়ি-গোঁফ। তার পরিচয় তিনি চারিয়া নেজামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বক্তব্যের শুরুতেই ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার কথা। এসেছিলেন শ্রীমৎ শাসনানন্দ মহাস্থবির। মির্জাপুর পালি ডিগ্রি কলেজ ও গৌতম আশ্রম বিহারের অধ্যক্ষ। গেরুয়া পোশাকের এই শিক্ষক সবার মাঝে বিলিয়ে দিলেন এক অসাধারণ স্মৃতিকাতরতা।
গ্রামের এই প্রবীণ শিক্ষকদের আগের মতো হাটবাজারে দেখা যায় না। শরীরে বেরাম এলেই বড়জোর ঘর থেকে দুই পা ফেলা। কিন্তু সেদিন তরুণ সংঘের সম্মাননায় তারা ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন। সেই গুণী শিক্ষকদের সম্মাননা জানাতে হাজির হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও কবি ড. ময়ূখ চৌধুরী, চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, বিপিএম, পিপিএম (বার) বাবুল আক্তার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও হালদা নদী গবেষক মঞ্জুরুল কিবরিয়া, লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সভাপতি ড. হানিফ সিদ্দিকী। ছিলেন প্রকৌশলী স্বপন নন্দী ও তরুণ সমাজ সংগঠক রহিম উদ্দিন চৌধুরী।
সম্মাননা সভায় কবি ময়ূখ চৌধুরী প্রশ্ন তোলেন, শিক্ষা কীভাবে জাতির মেরুদণ্ড হতে পারে? শিক্ষা একটি বায়বীয় ধারণা। বরং এই শিক্ষা যারা ছড়িয়ে দিচ্ছেন সেই শিক্ষক সম্প্রদায়ই জাতির মেরুদণ্ড। একজন মানুষকে সচল ও দণ্ডায়মান রাখতে যেমন মেরুদণ্ড প্রয়োজন, তদ্রূপ কোনো জাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে মেরুদণ্ডসম শিক্ষকের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই শিক্ষকই জাতির মেরুদণ্ড।
জগৎসংসার থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে এই প্রবীণ শিক্ষকরা সমাজ থেকেই হারিয়ে যাচ্ছিলেন। কানে কম শোনেন, চোখে ছানি পড়েছে। দাঁত নড়বড়ে। সেই নড়বড়ে প্রবীণদের নিয়ে মির্জাপুর গ্রামে সেদিন জ্ঞানের আলো জ্বলেছিল। কুড়ি বছরের কিছু তরুণ মির্জাপুর গ্রামে অভিনব দৃশ্যটি মঞ্চায়ন করেছে। আসুন কুড়ি বছরের তরুণদের সঙ্গে সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণদের হাসি-গান মেলাকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিই। শ্রমবিমুখতা আর বিদ্যাচুরির এই দুঃসময়ে আজ যখন তরুণরা ডিজে-ডিসকো-মোবাইল কালচারে ফেঁসে যাচ্ছে, তখন ওই গুণী শিক্ষক সম্মাননা অনুষ্ঠান থেকেই না হয় হারানো তারুণ্যকে ফেরত
পাওয়া যাক।
rajib1nandy@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.