সত্যের সন্ধানে পার্থিব চিন্তাধারা (সেক্যুলারিজম) অপরিহার্য by ডা. ওয়াহিদ নবি

আরবের রক্ষণশীল দার্শনিক ইবনে গাজ্জালি মুক্তচিন্তার অনুসারী দার্শনিকদের আক্রমণ করে 'ডেসট্রাকশন অব দ্য ফিলসফারস' নামে একটি বই লেখেন। এর উত্তরে স্পেনের মুসলমান দার্শনিক ইবনে রুশদ 'ডেসট্রাকশন অব দ্য ডেসট্রাঙ্ন' নামে আরেকটি বই লেখেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এ বইটির মাধ্যমে ইবনে রুশদ পার্থিব চিন্তাধারা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। ইবনে গাজ্জালি ও ইবনে রুশদের মধ্যে এই মসিযুদ্ধ ছিল দর্শনশাস্ত্র চর্চা বিষয়ে।


কিন্তু ইবনে রুশদের চিন্তাধারায় সাধারণভাবে পার্থিব চিন্তাধারা ফুটে ওঠে। যদিও প্রাচীন দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস বা প্রোটাগোরাস প্রমুখের চিন্তাধারায় পার্থিবতা প্রকাশ পেয়েছিল; কিন্তু সম্ভবত ইবনে রুশদ প্রথম স্পষ্টভাবে পার্থিব চিন্তাধারা ব্যক্ত করেন। ইরানের ইবনে সিনা, যিনি চিকিৎসক হিসেবে জগদ্বিখ্যাত এবং একজন বিদগ্ধ দার্শনিকও ছিলেন_তিনি পার্থিব চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন। অনেকে মনে করেন, ইবনে রুশদ (একজন চিকিৎসকও ছিলেন) ছিলেন ইবনে সিনার চিন্তার অনুসারী। কাজেই দেখা যাচ্ছে, মুসলমান চিন্তাবিদরাই ছিলেন পার্থিব চিন্তাধারার প্রবর্তক। দুর্ভাগ্যবশত মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ (ক্রুসেড) আরব তথা মুসলমানদের চিন্তাধারাকে পেছনের দিকে নিয়ে যায়।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, কালের আবর্তে একটা বিশেষ চিন্তাধারা যখন গতি হারিয়ে স্থবিরতার শিকার হয় তখন একটা নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব হয়। পুরনো চিন্তাধারার ধারক ও বাহকরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে না পারলে নতুন চিন্তাধারার প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করে। অনেক সময় নিজেদের প্রতিপত্তি সংরক্ষণের জন্যও তারা তাদের পশ্চাৎমুখী চিন্তাধারা আঁকড়ে ধরে থাকে। এই পরিবেশে রক্ষণশীলদের মনোভাব আক্রমণাত্মক হতে পারে। ইতিহাসে এসবের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। গ্যালিলিও তাঁর মুক্তচিন্তা অনুসরণ করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ করার প্রমাণ খুঁজে পান। ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে লড়ার কোনো অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। তিনি শুধু তাঁর খুঁজে পাওয়া সত্যের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ধর্মযাজকরা তাঁকে অন্ধকার নির্জন প্রকোষ্ঠে পচে মরতে বাধ্য করলেন। স্পেনের বৈজ্ঞানিক মাইকেল সার্ভেটাস মানুষের রক্ত সঞ্চালন প্রণালীর কথা বলে হৃদয়হীন ধর্মযাজকদের বিরাগভাজন হন। ধর্মযাজকরা তাঁকে পুড়িয়ে মারেন। গবেষণালব্ধ সত্যের কথা বলার অপরাধে ধর্মযাজকরা জিওরডেনো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারেন। ব্রুনো সূর্যকে আরেকটি নক্ষত্র বলে গণ্য করতেন। ব্রুনো এই বিশ্বের বিশালতার কথা বলেছিলেন, যা সংকীর্ণমনা ধর্মযাজকরা বুঝতে পারেননি। বৈজ্ঞানিক সত্য বলার অপরাধে ডারউইনকেও কম নাজেহাল হতে হয়নি। আজ আমরা দেখি, পার্থিব চিন্তাধারার অনুসারী মহাপুরুষদের খুঁজে পাওয়া তথ্য সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর তাঁদের নির্যাতনকারীরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তা সত্যেও পার্থিব চিন্তাধারার বিরুদ্ধবাদীরা আজও চোখ রাঙিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা চিন্তার অগ্রগতিকে বাধা দিচ্ছে। নিজের জন্মভূমির অগ্রগতি তাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। পার্থিব চিন্তার অনুসারী দেশগুলো যখন এগিয়ে যাচ্ছে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, তখনো রক্ষণশীলরা তা দেখেও দেখছে না।
'সেক্যুলারিজম' কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ জ্যাকব হলিওক। তিনি ছিলেন এগনিস্টিসিজম আদর্শের অনুসারী। দর্শনের এই মতের প্রবক্তা হ্যাঙ্লি বিশ্বাস করতেন, তাঁর মতে কোনো একটা বিশ্বাস নয় বরং এটা হলো একটি প্রক্রিয়া, যার দ্বারা কোনো একটি মতামতের সত্যাসত্যকে যাচাই করে নেওয়া যায়। হলিওক বলেছিলেন, সেক্যুলারিজম খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। তাঁর মতামত ধর্ম থেকে স্বাধীন। সত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই সেক্যুলারিজমের উদ্দেশ্য। সত্যকে জানার অন্য কোনো উৎস বা উপায় নেই_এ কথা তিনি বলেননি; কিন্তু সত্যকে জানার একটি পথ নিশ্চিতভাবে সেক্যুলার চিন্তাধারা। তাঁর মতে, সেক্যুলার জ্ঞানের ভিত্তি আমাদের জীবন। আমাদের কল্যাণ এই আদর্শের সঙ্গে জড়িত। জীবনের অভিজ্ঞতার দ্বারাই আমরা এই আদর্শের সত্যাসত্য যাচাই করে নিতে পারব।
আমরা মনে করি, সেক্যুলার দর্শনের ভিত্তি যখন এই পৃথিবী, তখন সেক্যুলার শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে পার্থিব শব্দটি বেছে নেওয়া উচিত। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি অযথা কিছু ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ করে দিয়েছে। মুক্তচিন্তার বিরোধীরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে মানুষের কাছে ধর্মহীনতা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এসব নিয়ে তারা অপপ্রচার চালিয়েছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে পার্থিব চিন্তাধারার অনুসারীরা স্বাধীনভাবে এবং খোলামেলাভাবে পার্থিব চিন্তাধারা সম্বন্ধে আলোচনা করার সুযোগ পায়নি। সব সময় একটা রাখঢাক পন্থা অনুসরণ করা হয়েছে। ফলে প্রতিক্রিয়াশীলরা লাভবান হয়েছে; মুক্তচিন্তা বিকশিত হয়নি আমাদের দেশে। এ কারণে অগ্রগতির আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা; বৈজ্ঞানিক চিন্তা বিকাশ লাভের সুযোগ পাচ্ছে না। এ কথা আমাদের পরিষ্কার এবং স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে এসব কারণে আমরা পরমুখাপেক্ষী থেকে যাচ্ছি। পার্থিব চিন্তাধারার বিরোধীরা অন্যান্য পার্থিব দেশের আবিষ্কৃত জিনিস ঠিকই ব্যবহার করছে, কিন্তু নিজের দেশে পার্থিব চিন্তার বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে দেশকে পিছিয়ে রাখছে।
পার্থিব চিন্তার ব্যাপক প্রসার ঘটে ইতালির রেনেসাঁ শুরুর পর। রেনেসাঁর শুরু চতুর্দশ শতাব্দীতে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। এটা ধীরে ধীরে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। রেনেসাঁর পথিকৃৎ ফ্রান্সেস্কো পেত্রার্ক। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। রেনেসাঁ ইউরোপের সাংস্কৃতিক জীবনে নবজাগরণ নিয়ে আসে। ইউরোপের শিল্পে, সাহিত্যে, রাজনীতিতে, বিজ্ঞানে রেনেসাঁ এক বিশাল বিপ্লব ঘটায়। রোমান ক্যাথলিকরা ইউরোপের চিন্তার জগতে একটি স্থবিরতা এনে দিয়েছিল। কিন্তু ইতালির মানুষ চিন্তার অগ্রগতির জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, পার্থিব জীবনে উন্নতির জন্য প্রয়োজন মুক্তচিন্তা। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন প্রাসঙ্গিক তথ্য_এ কথা তারা বুঝতে পারে। জ্ঞানের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন উৎস। সামন্তবাদ আর ধর্মযাজকরা মিলে একটা বদ্ধ আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিলেন, যার গণ্ডিতে মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছিল। পার্থিব চিন্তাধারা মানুষকে দিল নতুন প্রাণের সন্ধান। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সাহিত্য-শিল্পে, রাজনীতিতে ইউরোপে একটা নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো।
আমাদের নিজেদের দেশের পটভূমির কথা চিন্তা করা যাক। ইংরেজরা ভারতের রাজ্য ক্ষমতা দখল করার পর মুসলমানরা দিশেহারা হয়ে পড়ল। যদিও ৫০০ বছরের মুসলিম শাসনের সময় স্থানীয় মুসলমানরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে বহু দূরে অবস্থান করছিল, তবু শাসকদের সঙ্গে এক ধরনের মানসিক সম্পর্ক ছিল তাদের। সম্ভবত এ কারণে তারা ইংরেজ সরকারের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখে। ইংরেজি তারা গ্রহণ করল না। অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে গেল। যেখানে হিন্দু ধর্ম শিক্ষা প্রচলনের সরকারি প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে রাজা রামমোহন রায় আধুনিক শিক্ষা প্রচলনের দাবি জানালেন, সেখানে মুসলমানরা মাদ্রাসা শিক্ষা প্রচলনে সন্তুষ্ট হয়ে যুগের থেকে পিছিয়ে পড়ল। এই বিরাট পার্থক্যের কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি উচ্চারিত হলো। এ দাবির ভিত্তি ছিল ধর্ম। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পরই ধর্মীয় ভিত্তির অসারতা প্রমাণিত হলো। মোহমুক্ত বাঙালি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার রক্তসূর্য ছিনিয়ে আনল। এই নুতন রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভ হলো_জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও পার্থিবতা। কিন্তু জাতির পশ্চাৎমুখী চিন্তার মানুষরা এটা গ্রহণ করতে পারল না। দুই সেনানায়ক একের পর এক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সংবিধানে পশ্চাৎমুখী চিন্তার সস্তা স্লোগান ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁদের পেছনে সমবেত হলো প্রতিক্রিয়াশীল মানুষরা। জাতি হিসেবে যে গ্যাঁড়াকলে আমরা পড়ে গেলাম, এ দুই সেনানায়কের অবিমৃশ্যকারিতায়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সহজ মনে হচ্ছে না। এর সঙ্গে আরো দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো পার্থিব চিন্তার অধিকারীদের অনেকের দৃঢ়তার অভাব; আরেকটি পার্থিব চিন্তা সম্পর্কে জনগণের অজ্ঞতা। এই অজ্ঞতার কারণ হলো_পার্থিব চিন্তায় বিশ্বাসীরা জনগণকে পার্থিব চিন্তার আশীর্বাদের কথা বলার সময় বা সুযোগ পাননি। কিন্তু আমাদের হতাশ হলে চলবে না। জনগণকে পার্থিব চিন্তার কথা বিরতিহীনভাবে বলে যেতে হবে। পার্থিব চিন্তাধারাই পারে আমাদের প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিতে।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.