আগামী এক শ' বছরে বিলুপ্তি ঘটবে, চার দশকে হ্রাস ৫০%- আবাদী জমি by মামুন-অর-রশিদ

প্রতিদিন কমছে দেশের আবাদী জমি। মূলত আবাসন আগ্রাসনেই হ্রাস পাচ্ছে আবাদী জমি। প্রতিবছর শতকরা প্রায় এক ভাগ কৃষিজমি অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ হিসেবে আগামী এক শ' বছরে দেশে কৃষিজমির বিলুপ্তি ঘটবে। স্বাধীনতাউত্তর গত চার দশকে দেশের আবাদী জমি হ্রাস পেয়েছে ৫০ শতাংশ। গত শতকের '৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে '৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যনত্ম মাত্র ১০ বছরে আবাদী জমি হ্রাস পেয়েছে ৪০ থেকে ৭০ লাখ একর। পাহাড় কিংবা জলাশয়ের চেয়ে সমতল ভূমিই অধিকমাত্রায় আবাসনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এভাবে আবাদী জমি হ্রাস পেতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। দেশের খাদ্য ঘাটতি বেড়ে যাবে। কৃষিপ্রধান অর্থনীতির জন্য যা ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের শঙ্কা বহন করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাপানে ব্যবহৃত 'লাইন ড্রয়িং সিস্টেম' পদ্ধতিতে শহরায়নের ধারায় প্রত্যনত্ম অঞ্চলে আবাদী জমি বাঁচানোর সম্ভাবনার কথা বলছেন দেশের পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পস্ন্যানার্সের (বিআইপি) সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
শরীফ মোহাম্মদ তারিকুজ্জামানের 'জাপানিজ কনসেপ্ট অব আরবান প্রমোশন কন্ট্রোল এরিয়া (এইসিএ) টু সেভ এগ্রিকালচার ল্যান্ড ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে বাংলাদেশে আবাদী জমি রৰায় জাপানী অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছে। জাপানে ব্যবহৃত 'আরবানাইজেশন প্রমোশন এরিয়া' (ইউপিএ) এবং 'আরবান প্রমোশন কন্ট্রোল এরিয়া' (ইউসিএ) দু'টির সমন্বয় 'লাইন ড্রয়িং সিস্টেম' গড়ে তুলেছে। এতে 'শহরায়নে কার্যকর সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা, শহরায়নে অনিয়ন্ত্রিত আবাদী জমি ও বনভূমি ব্যবহার রোধ করার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে জাইকা বাংলাদেশে কাজ করছে বলে সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ১৯৬৮ সালে জাপানে আবাদী জমির দ্রম্নত হ্রাসপ্রবণতার কারণে জাপান সরকার এ পদ্ধতি গ্রহণ করে। গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, ১৯৬৮ সালে আবাদী জমি হ্রাসে যে পরিস্থিতি হয়েছিল বাংলাদেশ আজ আবার ঠিক একই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে আবাসন আগ্রাসনের পাশাপাশি ইটখোলা নির্মাণ, জাতীয়-আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়ক, ভূমিদখল, সিনেমা, কিনিক-মেডিক্যাল, কাব, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিৰাপ্রতিষ্ঠান, ডক ইয়ার্ড, জেটি, হাইকমিশন, খাদ্য ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো, হাসপাতাল, হোটেল, গেস্ট হাউস, বাংলো, সরকারের প্রশাসনিক অবকাঠামো, আনত্মর্জাতিক মানের হোটেল, শিল্পায়ন, পার্কিং, পেট্রল অকটেন ডিজেল ফিলিংস্টেশন, মাঠ, উদ্যান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বাজার, গুদামঘর, পুকুর, জলাশয়, সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে প্রাথমিক স্কুল, বাস-লঞ্চ ও রেল টার্মিনাল, বিমানবন্দর, বাণিজ্যিক অঞ্চল, শিল্পাঞ্চল, বন্যা, খোলা মাঠের ব্যবহারে প্রতিদিন আবাদী জমি হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ আয়তনের তুলনায় ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চাপ দেশের কৃষিভূমির ওপর অব্যাহত রয়েছে। বিরাজমান পরিস্থিতি চলতি শতকের মাঝামাঝি সময়েই বাংলাদেশের সব আবাদী জমি নিঃশেষিত হতে পারে। প্রতিদিন যে হারে কৃষিজমি আবাসনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে সেদিন বেশি দূরে নয় যে বাংলাদেশে চাষাবাদের কোন ভূমি থাকবে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪৮ ভাগ। বার্ষিক শহরায়ন প্রক্রিয়ায় জমি ব্যবহৃত হয় শতকরা ৭ ভাগ। বছরে কর্মসংস্থানসহ নানা কারণে মোট জনসংখ্যার ২৩ দশমিক ১ ভাগ, যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮০ লাখ লোক শহরমুখী হয়। প্রতি একযুগ বা ১২ বছরে শহরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। শহরায়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কথা বলা হলেও প্রকৃতপৰে অপরিকল্পিত নগরায়নে অধিকমাত্রায় আবাদী জমি নিঃশেষিত হচ্ছে। বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, বাংলাদেশে ১৯৮৩-৮৪ সালে আবাদী জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ একর। ১৯৯৭ সালে আবাসন আগ্রাসনসহ নানা কারণে আবাদী জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৭০ লাখ ৪৫ হাজার একর। এভাবে নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে আবাদী জমি হ্রাস পেতে থাকলে ভয়াবহ বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে বলে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। আবাদী জমি সংরৰণ করতে গিয়ে শহরায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করা যাবে না। তাই জাপানে প্রচলিত 'লাইন ড্রইং সিস্টেমে' পরিকল্পিত নগরায়নের পথে হাঁটতে হবে বাংলাদেশকে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসতির সংখ্যা ১৮ হাজার। আর ঢাকা জেলায় সিটি কর্পোরেশনের বাইরের এলাকায় এ বসতির সংখ্যা কমপৰে ৬ হাজার। আমাদের জেলা শহরগুলোতেও জনসংখ্যার চাপ রয়েছে। শিল্পাঞ্চল এবং থানা, উপজেলা-জেলা এবং বিভাগীয় এলাকাসংলগ্ন আবাদী জমি প্রতিদিন আবাসন আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে শহরায়ন প্রক্রিয়া নিয়নণ এবং পরিকল্পিত পরিবর্ধনের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারী উদ্যোগে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আবাদী জমি বাঁচাতে আবাসন শিল্পে বিজ্ঞানসম্মত কোন পরিবর্তন আনা যায় কিনা সে ব্যাপারে জাপান সরকারের সহায়তায় তাদের দেশের মডেল এ দেশে কার্যকর করার ব্যাপারে সরকারী নির্দেশনায় শুরম্ন হয়েছে বিশেষ গবেষণা কার্যক্রম। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসিক চাহিদা মেটাতে আবাদী জমিতে বাড়িঘর গড়ে তোলার প্রবণতা থেকেই মূলত আবাদী জমি কমছে। এতে খাদ্য সঙ্কট আগামীতে আরও প্রকট হবে। এমনিতেই বিশ্বমন্দার সময় বাংলাদেশের মানুষ খাদ্য সঙ্কট হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে আবাদী জমি ব্যবহার করে আবাসনের ব্যবস্থা না করে নতুন কোন পথ খুঁজে বের করতে হবে এখনই। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিনত্মা করে সরকারকে আবাদী জমি রৰায় বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিতে বলে মনে করছেন সংশিস্নষ্ট গবেষকরা।

No comments

Powered by Blogger.